ইসলাম চর্চিত জ্ঞান-বিজ্ঞান, মর্যাদা, গাম্ভীর্য আর সম্ভ্রম সম্পর্কে ওয়াকিফহাল করে তোলার অভিপ্রায়ে বর্তমান আলোচনাটির উপস্থাপনা। ‘হাফ বেকড ’ তথাকথিত পণ্ডিতবর্গ ‘মধ্যযুগের বর্বরতা’ বলে আলটপকা মন্তব্য করে বসেন। ইসলাম ‘মিস আন্ডারস্টুড রিলিজিয়ন’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। ক্রুশেডের কাল থেকে এই বেতমিজ অপপ্রচার চলছে। সদ্যতন সভ্যতার আলোকবর্তিকাটি ইসলাম-ই মধ্যযুগ থেকে জ্বালিয়ে রেখেছিল। চার্চ এবং যাজক সম্প্রদায়ের কুসংস্কার আর অমানবিক কার্যাদির কারণে বহু বৌদ্ধিক ব্যক্ত্বিকে তারা নির্মভাবে হত্যা করেছে। ইসলাম তার ‘আহল-ই-কলম’ (বিদ্বৎসমাজ)-কে কস্মিনকালেও বিড়ম্বিত করেনি। সর্বোত্তম পৃষ্ঠপোষকতায় জ্ঞানের অন্তহীন বিকাশে মদদ করেছে। অত্যুজ্জ্বল এই মহত্তম বিষয়টির উপর আলোকপাত করলেন এই বঙ্গের মেধা আর মননের অন্যতম বিশিষ্ট প্রতিনিধি খাজিম আহমেদ।
‘অ্যান অ্যাডভান্সড হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’-তে বলা হয়েছে এশিয়া ইতিহাসের বিশাল শক্তিধর পুরুষ সুলতান মাহমুদ হিন্দুস্তানে এসেছিলেন প্রচুর ধনরত্ন সংগ্রহের অভিপ্রায়ে। সুলতানের সে ‘খোওয়াশেস’ পূর্ণ হয়েছিল তা বলা যায়। সুলতান মাহমুদ রেখে গিয়েছিলেন তুলনারহিত এক রত্নকে। সেই মহারত্নের নাম আলবেরুনি। হিন্দুস্তানের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক বিরাট ব্যক্তিত্ব। ‘দারা শিকোহ’ নামক সমন্বয়ধর্মী গ্রন্থে তাঁকে ‘সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের অগ্রদূত’ হিসেবে অভিহিত করেছেন ড. অধ্যাপক রেজাউল করিম।
তাঁর পুরো নাম আবু রিহান (রায়হান) মাহমুদ। পিতার নাম আহমাদ। সাধারণভাবে তিনি বু, রিহান, ওস্তাদ (Master) নামে পরিচিত। কিন্তু এই দেশে তিনি আলবেরুনি এবং আলবিরুনি নামে বিস্তৃতভাবে খ্যাত। আলবেরুনি শব্দের অর্থ হল ‘The foreigner’. সুলতান মাহমুদ ফার্সি সাহিত্য বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। ফার্সি সাহিত্যের মহাকাব্য বিশ্ববন্দিত ‘শাহনামা’-- তাঁর সভাকবি ফেরদৌসির রচনা। সুলতান তনয় মাসুদ আলবেরুনিকে ইজ্জত দিয়েছিলেন। তাঁর পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতি দিয়ে মাসুদ নিজস্ব মানসিক উৎকর্ষের নজির সৃষ্টি করেছিলেন।
খোওয়ারিজম (খিবা) নামক ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থানে আলবেরুনি ৯৭৩ খিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জীবনদীপ নিভে গিয়েছিল ১০৪৮ খ্রিষ্টা্ব্দে। খুব সম্ভব যুদ্ধবন্দী হিসেবে তাঁকে গজনি নিয়ে আসা হয়েছিল। গজনি থেকে হিন্দুস্তান। সুলতান মাহমুদ পাঞ্জাব দখল করে নেওয়ার পর আলবেরুনি সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। তাঁর অবস্থান সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের পক্ষে অনিঃশেষ কার্যকরী হয়েছিল।
অতিদূর অতীতেও আলবেরুনি এক সংস্কৃত পরিশীলিত মনের পরিচয় রাখলেন। পাঞ্জাবে অবস্থানকালে গভীর আগ্রহ ও উৎসাহের সঙ্গে ভারতীয় দর্শনের ওপর পড়াশোনা করেছিলেন। জ্ঞানান্বষণের আজীবন স্পৃহা তাঁর চরিত্রে, জীবনে দেদীপ্যমান। ভারতীয় বিজ্ঞান সাধনার সঙ্গে আলবেরুনির সখ্যতা জন্মেছিল। সংস্কৃত ভাষার ওপর তাঁর দখল ছিল অসাধারণ। তৎকালীন এতদ্দেশীয় পণ্ডিতবর্গ আলবেরুনির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বস্তুত তাঁর উদার চিন্তাবোধ ছিল প্রশংসনীয়। তাঁর বিচারশক্তির সূক্ষ্মতা ভারতীয় পণ্ডিতদের আলবেরুনির অনুরাগী করে তোলে। জ্ঞানসাধক এই মনস্বী-পণ্ডিত পুরাণ পর্যন্ত অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ সহকারে পড়েছিলেন। স্বীকরণ করেছিলেন। ভারতের সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ধ্যান-ধারণা, আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি ধর্মীয় চেতনা পুরো জীবনধারা সতর্কতার সঙ্গে বিচার করেছিলেন। পর্যবেক্ষণ আর উপলব্ধির মারফত তিনি হিন্দুস্তানের জীবনচর্যার ওপর বিশাল গ্রন্থ রচনা করেন। যৌবনের প্রাথমিক পর্যায়ে গ্রীক দর্শন সম্পর্কেও জ্ঞানার্জন করেছিলেন। আলবেরুনির আগে কোনো বিদেশী পণ্ডিত বা ভ্রমণকারী ভারত সম্পর্কে এমন বিস্তারিত অনুভব রেখে যেতে পারেননি। বস্তুত তিনি ছিলেন ‘Indologist’ বা ভারতত্ত্ববিদ।
আলবেরুনির যুক্তি ও বিচারশীল চিন্তায়, মানববাদী ভাবনার একটি বিশিষ্ট প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। ভারতে অধীত জ্ঞানের পূর্ণ বিকাশ তাঁর ‘তহকক-ই-হিন্দ’-গ্রন্থে দৃশ্যমান। এই সুবৃহৎ, কেতাবটি ‘An Enquiry into India’ নামে ইংরেজি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। ‘Alberuni’s India’ নামে একটি চমকপ্রদ গ্রন্থও দীর্ঘদিন আগেই ইংরিজিতে অনুবাদ করা হয়েছে। তুর্ক-আফগান বা মোগল যুগ পর্যন্ত ফার্সী ভাষায় যে গ্রন্থসমূহ বিভিন্ন পণ্ডিতবর্গ রচনা করেছিলেন তার মধ্যে এই গ্রন্থের গুরুত্ব সবার উপরে কালের ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। ‘মোগলযুগের বেকন’-- হিসেবে খ্যাত আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’-তে (Institutes of Akbar) আবু রিহান আলবেরুনির প্রভাব পড়েছিল। আবুল ফজল অবশ্য একথা কোথাও উল্লেখ করেননি।
এই ভারততত্ত্ববিদ মহাপণ্ডিত আলবেরুনি ভারতের সাহিত্যচর্চার পদ্ধতি ও রীতিকে সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু সংকীর্ণ কোনও চিন্তা তাঁর বিরাট ভাবনাকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। ভারতীয় দর্শন বিশেষ করে ‘ভাগবৎ গীতা’ সম্পর্কে আগ্রহ ও অনুসন্ধিৎসা তাঁর উদার স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বহন করে। উপনিষদে বর্ণিত একেশ্বরবাদের যে প্রকাশ, যার থেকে তৎকালীন হিন্দু সমাজ বিচ্যুত হয়েছিলেন, একটা জড়তা ও অবসাদ ঘিরে ধরেছিল, তার সঙ্গে তৎকালীন বিজয়ী মুসলমানদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে মহাত্মা আলবেরুনির এ একটি বিরাট সাধনা। ভারতীয় হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলনের সেতু গড়ার কাজ মহাত্মা আলবেরুনিই শুরু করেছিলেন। হিন্দুস্তান সম্পর্কিত তঁার গ্রন্থ সম্পর্কে ‘দ্য অক্সফোর্ড হিস্ট্রি অন ইন্ডিয়া’-গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘যখন তরবারির সঙ্গে তরবারির সংঘর্ষ চলছে, শহর-আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যাচ্ছে, লুট হয়ে যাচ্ছে মন্দির, তেমন সময়ে আলবেরুনি নিঃশব্দ দ্বীপে বসে যেন নির্মোহ আর নিরপেক্ষভাবে গবেষণা করে যাচ্ছেন।’ বিধ্বস্ত, বিপন্ন সময়ে এমন নিরপেক্ষ বিবেচক ইনসান তো আর কেউ ছিলেননা।
আলবেরুনির জ্ঞানের পরিধি ছিল দিগন্ত প্রসারী। অংকশাস্ত্র, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, ধাতুবিদ্যা, ঘটনাপঞ্জীর বিশ্লেষণ এবং জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাকার যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে তঁার পণ্ডিত্য সত্যিই বিস্ময়ের। প্রতিটি বিষয়েই তাঁর চিন্তাভাবনার ফসল যে রচনা, তিনি আদম সভ্যতার দরবারে রেখে গেছেন তা অমূল্যসম্পদ হিসেবে গ্রহণীয় হয়ে রয়েছে। তাঁর সমস্ত বিজ্ঞান-ভিত্তিক রচনা পাশ্চাত্যে অনুবাদ করা হয়েছে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. ভি স্মিথ লিখেছেন, ‘Alberuni ... was one of the most gifted scientific men known to history.’ গ্রীক ও রোমান সভ্যতা সম্পর্কে আলবেরুনি’-র স্বচ্ছ ধারণা ছিল। এর ফলে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কালের বিচারে অনেকটাই প্রাগ্রসর হতে পেরেছিল।
আবু রিহান মুহম্মদ আলবেরুনির বহু রচনা সময়ের সঙ্গেই হারিয়ে গেছে। কিছু লেখা, পাণ্ডুলিপি আকারে এখনও রয়েছে। ১৮৭৯-খ্রিস্টাব্দে ‘Chronology of Ancient Nationas’ ইংরাজিতে অনুদিত হয়েছে। তৎকালীন ভারতীয় ইতিহাসের জীবন্ত দলিল আলবেরুনির গ্রন্থখানি। কিন্তু এই গ্রন্থখানিও শিক্ষিত লোকেদের জন্যই। স্বকাল ও স্বদেশ সম্পর্কে এমন অগ্রবর্তী, মহৎ ভাবনার মানুষ বিরলদৃষ্ট। বস্তুত হিন্দুস্তানের জীবন সম্পর্কে তিনি যে শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন তা এই মনীষার মহত্বের বিষয়টিই প্রমাণ করে।
ইরানের এই মহান সন্তান ভিন্নধর্মী হিন্দুস্তানে এসে অনিঃশেষ উদারতার সঙ্গে একটি পৌত্তলিক সভ্যতা-সংস্কৃতির যে পরিচয় অশেষ সহিষ্ণুতার সঙ্গে পুরো বিশ্বসভ্যতার সামনে তুলে ধরেছেন তা বিস্ময়কর। আধুনিক যুগের পূর্বে এমন একজন হিন্দুস্তানি দার্শনিক বা ঋষি পাওয়া যাবে না যিনি কিনা ইসলাম সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আসলে কূপমুণ্ডকতা ছিল এতদ্দেশীয় মানসিতার হীন বৈশিষ্ট্য। এ সম্পর্কে মহাত্মা আলবিরুনির উপলব্ধি এবং পর্যবেক্ষণ-বিশ্লেষণ উদ্ধৃত হল:
“হিন্দুদের নিজেদের ছাড়া অন্য কারো বিষয়ে কোন কিছু অবগত ছিল না। তাদের বিশ্বাস, তাদের দেশ ছাড়া আর কোনও নেই। তারা ছাড়া আর কোন মনুষ্য জাতি নেই, তাদের ছাড়া আর কারোরই কোন জ্ঞানবিজ্ঞান নেই। এমন কি তাদের নিকট যদি খোরাসান বা পারস্যের কোনো পণ্ডিত ব্যক্তির কথা বলা হয় তাহলে তারা তাকে মিথ্যেবাদী ও নির্বোধ মনে করে।” এ বাবদে মহামনীষী-সমাজবিজ্ঞানী আলবেরুনির বিশ্লেষণ হল, “তারা যদি বিদেশ ভ্রমণ করত এবং অন্য জাতির সাথে মেলামেশা করত, তাহলে তাদের ভ্রান্তধারণা দূর হত।” ইসলাম এখানে প্রবেশ করছে তেমন সময়ে হিন্দুরা অত্যন্ত রক্ষণশীল হয়ে পড়ে।
মহাত্মা আলবেরুনির উদারতা ও মহত্ত্ব এইখানে যে প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার পণ্ডিতরা অন্যের জ্ঞানকে স্বীকার করত এবং প্রশংসার যোগ্য--সে কথাও উল্লেখ করেছেন। উদ্ধৃতিটি দেওয়া যাক তাহলে বিষয়টি খোলসা হবে।
‘‘তাদের পূর্বপুরুষরা এরূপ ছিলনা, তারা অপর জাতি থেকে উপকার গ্রহণে দ্বিধা করত না। বরাহমিহির বলছেন যে, ‘গ্রীকরা যদিও অস্পৃশ্য ও অশুচি তবুও জ্ঞানবিজ্ঞানে কৃতিত্বের জন্য তারা সম্মানের অধিকারী হয়।”
“কিতাবুল হিন্দে’--ভারতের ভৌগলিক যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে তিনি, সমগ্র ভারতকে পরিমাপ করে দিয়েছেন।” ভারতের বড় বড় শহরের দ্রাঘিমা ও অক্ষাংশ-ও তিনি উল্লেখ করেছেন। অধ্যাপক স্যাচাউ, আলবেরুনি সম্পর্কে অসাধারণ একটি মন্তব্য করেছেন এইভাবে, “তিনি (আলবেরুনি) ভারতের উপর এইরূপ অনুগ্রহ করেছেন যে, সেখানকার প্রাচীন সংস্কৃতি, প্রাচীন শিক্ষা ও প্রাচীন চিন্তাধারাকে সমগ্র বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত ও টিকিয়ে রেখেছেন।”
মহাত্মা আলবিরুনি হিন্দু ও মুসলমানকে অপরিচয়ের আড়াল দূর করে কাছাকাছি আনতে চেয়েছিলেন। আরব-ইরানিদের শিক্ষা ভারতে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। হিন্দুস্তানি শিক্ষা আরব-ইরানে পরিচিত করতে আগ্রহী ছিলেন।
আলবিরুনি সম্পর্কে মাওলানা সৈয়দ সুলাইমান নাদভীর মূল্যায়ন:
‘তিনি আরবী পণ্ডিতদের জন্য সংস্কৃত ভাষা থেকে এবং সংস্কৃত ভাষার পণ্ডিতদের উদ্দেশ্যে আরবী থেকে বহু গ্রন্থ অনুবাদ করেন।’
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct