ফৈয়াজ আহমেদ : অনুসন্ধিৎসু মনে হঠাৎই এমন প্রশ্ন উদয় হতে পারে, মামুলি এক নুড়ি-পাথর পলিশিংয়ের মাধ্যমে কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে দামি বস্তু হয়ে ওঠে? হ্যাঁ, পৃথিবীর সবচেয়ে দামি বস্তু হিসেবে এখানে হীরের কথাই বলা হচ্ছে। মানুষ সুন্দরের পূজারী। প্রাচীনকাল থেকেই মানবজাতি সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য অলংকার পরিধানের রীতি চালু করেছে। শুরুর দিকে অলংকারের প্রাথমিক নিদর্শন হিসেবে ঝিনুক, শামুক, বা হাড়ের টুকরার খোঁজ পাওয়া গেলেও, আধুনিক যুগে এই জায়গা দখল করে নিয়েছে নানা রকম উজ্জ্বল পাথর ও জেমস্টোন বা রত্ন-পাথর।
বর্তমানে হীরে বা ডায়মন্ড পৃথিবীর অন্যতম মূল্যবান, নিরেট ও দৃঢ় বস্তুগুলোর একটি। হীরে মূলত কার্বনের কঠিন রূপ যা অত্যধিক তাপ, চাপ ও একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে থাকার কারণে তৈরি হয়। বেশিরভাগ প্রাকৃতিক হীরেই পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে ১০০ মাইলেরও বেশি গভীরে, ১৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ও ৪৫-৯০ কিলোবার চাপে কার্বন পরমাণু থেকে হীরেয় রূপান্তরিত হয়। হীরে রূপান্তর প্রক্রিয়ায় সময়ও একটি বড় নিয়ামক।
প্রাকৃতিকভাবে কার্বন হীরেয় রূপান্তরিত হতে হতে প্রায় ১ বিলিয়ন থেকে ৩.৫ বিলিয়ন বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। আজ পর্যন্ত পাওয়া প্রায় সকল হীরের বয়সই পৃথিবী সৃষ্টির প্রথমদিককার উদ্ভিদগুলোর চেয়ে বেশি। বিজ্ঞানীদের ধারণা, পৃথিবী গঠন হবার সময়েই এর অভ্যন্তরে আটকে পড়া কার্বন উচ্চ তাপ ও চাপে ধীরে ধীরে হীরেয় পরিণত হয়েছে।
ইতিহাসবিদের মতে খ্রিঃ পূঃ ২৫০০ - খ্রিঃ পূঃ ১৭০০ অব্দের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে (সিন্ধু সভ্যতার ব্রোঞ্জ যুগে) দ্রাবিড় জাতি ভারতে সর্বপ্রথম হীরের সন্ধান পায়। আবার অনেকে বিশ্বাস করেন, ভারতে সর্বপ্রথম হীরে আবিষ্কার হয় খ্রিঃ পূঃ ১০০০ অব্দের কাছাকাছি সময়ে। Brilliance এর তথ্যসূত্রে উল্লেখ করা আছে, খ্রিঃ পূঃ প্রায় ৪০০ অব্দে প্রাচীন ভারতবর্ষের সংস্কৃত ভাষায় লিখিত গ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্র’ ও ‘রত্নপরীক্ষা’তে সর্বপ্রথম হীরের লিপিবদ্ধ ইতিহাস মেলে।
প্রাচীন সেই গ্রন্থে মুদ্রা হিসেবে হীরের বিনিময় প্রথার বিষয়টি উল্লেখ ছিল। বাণিজ্য মাধ্যম হিসেবে হীরে ব্যবহারের কারণে এবং ভারত ও চীনের সাথে প্রাচীন ব্যবসায়ী রুটগুলো (সিল্ক রোড) সম্পৃক্ত থাকায় মূল্যবান এই পাথরটি পৌঁছে যায় গ্রিক ও রোমান সাম্রাজ্য পর্যন্ত। পরবর্তী কয়েক শতকে মূল্যবান এই রত্ন পাথরটি রাজ পরিবার, প্রভাবশালী পরিবারগুলোর কাছে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে স্থান পায়।
একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কোনো সময়ে দক্ষিণ ভারতে বিশ্ববিখ্যাত ১৮৬ ক্যারেটের কোহিনূর হীরের সন্ধান মিলে।
এটি কখনো শোভা পেয়েছে মুঘল দরবারে, কখনো ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছে ইরানী যোদ্ধাদের হাতে, কখনো আবার সমৃদ্ধ করেছে আফগান শাসক কিংবা পাঞ্জাবি মহারাজাদের। এর বর্তমান অবস্থান টাওয়ার অফ লন্ডনে, ক্রাউন জুয়েলের অংশবিশেষ হিসেবে। তবে কোহিনূরই ভারতবর্ষের একমাত্র শ্রেষ্ঠ হীরে নয়। কোহিনূরের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ অন্তত আরও দুটি হীরকখণ্ডের প্রমাণ ইতিহাসে মেলে। এর একটি হলো দরিয়া-ই-নূর, আর অন্যটি গ্রেট মুঘল ডায়মন্ড।
বর্তমানে ‘পিংক স্টার’ নামে একটি দুর্লভ হীরা হংকং এর এক নিলামে ৭ কোটি ১০ লাখ ডলার দামে বিক্রি হয়েছে। পৃথিবীতে নিলামে বিক্রি হওয়া মূল্যবান পাথরের মধ্যে এটিই হচ্ছে দামের দিক থেকে নতুন বিশ্বরেকর্ড।
পিংক স্টার হচ্ছে অতি দুর্লভ গোলাপি রঙের হীরা - এবং এত বড় গোলাপি হীরা পৃথিবীর ইতিহাসে আর কখনোই দেখা যায় নি।
বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান সাদাবি’র নিলামে মাত্র পাঁচ মিনিট ধরে দর হাঁকাহাঁকির পরই ৫৯ দশমিক ৬ ক্যারাট ওজনের ডিম্বাকার হীরাটি বিক্রি হয়ে যায়।
আফ্রিকার এক খনিতে ১৯৯৯ সালে এটি পাওয়া যায়। তার পর দু’বছর ধরে এটি কাটা এবং পালিশ করা হয়।
১৭২৫ সালে ব্রাজিলে হীরের একটি খনি পাওয়া গেলেও, তা তৎকালীন বিশ্বের হীরের চাহিদা পূরণে পর্যাপ্ত যোগান দিতে পারত না। পরবর্তী শতকে রাশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় কিছু হীরের খনি আবিষ্কৃত হয়। তবে, হীরে জগতের চিরচেনা চেহারা পালটে যায় ১৮৬৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার অরেঞ্জ নদীর পাশে বেশ কয়েকটি হীরের খনি আবিষ্কারের পর। ১৮৭১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় De Beers ও Kimberley নামে দুটো হীরের খনি আবিষ্কারের পর হীরের উৎপাদন মাত্রা হুট করেই বেড়ে যায়। এর ফলে বাজারে হীরের সরবরাহ আবার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে শুরু।
পৃথিবীর যেকোনো হীরের গুণগত মান নির্ণয় করা হয় 4C এর মাধ্যমে। এই 4C দিয়ে বোঝায় Color, Clarity, Cut ও Carat Weight। প্রকৃতিতে প্রাপ্ত হীরের একেকটির আকার, আয়তন, বর্ণ ও স্বচ্ছতায় ভিন্নতা থাকে। তাই হীরেকে নির্দিষ্ট কোনো দামের গণ্ডিতে ফেলা সম্ভব নয়। অনেকের ভাবতে পারে, যে হীরে আকার ও আয়তনে বেশি বড়, তার দাম তত বেশি। কিন্তু এ ধারণা ভুল। জিআইএ ক্ল্যারিটি গ্রেডিং সিস্টেমের উপর ভিত্তি করে হীরেকে মোট ১১টি গ্রেডে ভাগ করা হয়েছে। এদের মধ্যে IF বা F গ্রেডের হীরেকে ধরা হয় নিখুঁত বা নিটোল হিসেবে। এসব হীরের মধ্যে কোনোরকম অপদ্রব্য থাকে না, পুরোটাই খাঁটি কার্বন পরমাণুর স্বচ্ছ স্ফটিক।
হীরের দাম নির্ধারণে বর্ণ বা রঙ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডায়মন্ডের কালার গ্রেডিং শুরু হয় D থেকে, যা শেষ হয় Z এ। শ্বেত হীরের ক্ষেত্রে হীরেতে ইংরেজি বর্ণমালার ক্রমানুসারে D থেকে যত সামনের দিকে এগোবে, হলুদ রঙের উপস্থিতি যত বাড়বে, আর হীরের দামও তত কমবে। তবে হোয়াইট ডায়মন্ড বা শ্বেত হীরে ছাড়াও বেশ কিছু রকমের হীরে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়, যেগুলোর কালারগ্রেডিং ভিন্নভাবে করা হয়, এবং সেগুলোর দামও বর্ণভেদে হয়ে থাকে ভিন্ন।
এরপর হীরের দামে যেটি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে তা হচ্ছে কাটিং আর পলিশিং। ‘জেমোলজিক্যাল ইন্সটিটিউট অভ আমেরিকা’র স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী, ডায়মন্ডের কাটিংকে গ্রেডিং করা হয়েছে মোট পাঁচটি ভাগে। এর মধ্যে ‘Excellent Cut’ হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট। এছাড়াও ডায়মন্ডের বিভিন্ন আকার লক্ষ্য করা যায়, যার মধ্যে রাউন্ড, প্রিন্সেস, ওভাল, কুশন, পিয়ার, এমেরাল্ড, হার্ট, মারকুইজ, রোজ, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সেসবের উপর ভিত্তি করেও হীরের দামে তারতম্য হয়।
বর্তমান সময়ে হীরের উৎপাদন বেশি হলেও জুয়েলারিতে ব্যবহারযোগ্য হীরে বেশ দুর্লভই বলা চলে। খনি থেকে উৎপাদিত হীরের প্রায় আশি শতাংশই রত্নপাথর হিসেবে ব্যবহারযোগ্য নয়। এগুলো ব্যবহার করা হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডায়মন্ডের জন্য। শ্বেত হীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া গেলেও ভিন্ন রঙয়ের হীরে খুবই দুষ্প্রাপ্য। যার ফলে রুবি (লাল), স্যাফায়ার (নীল) কিংবা এমারেল্ড (সবুজ) হীরে এত সহজে পাওয়া যায় না। সেগুলোর মূল্যও থাকে আকাশচুম্বী, জনসাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
হীরের মাইনিং একদিকে যেমন সময়সাপেক্ষ, অন্যদিকে কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। ফলশ্রুতিতে, হীরে উত্তোলনের পরিমাণের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে উৎপাদন খরচও। জুয়েলারির দোকানে সাজানো হীরেগুলো যেমন চকচকে, উজ্জ্বল, ও দীপ্তিমান দেখায়, উত্তোলনকৃত হীরে প্রাথমিকভাবে তেমন ঝকঝকে থাকে না। খনি থেকে প্রাপ্ত হীরেকে পালিশ করার মাধ্যমে এই দীপ্তিময় রূপ দেওয়া হয়।
মজার ব্যাপার হলো, বিশ্বের ৯০ শতাংশ হীরের কাটিং ও পলিশিং হয় ভারতে (গুজরাটের সুরাত শহরে)। ভারতে প্রায় ৭০০০ ডায়মন্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিটে ৬ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত। হীরে পৃথিবীর অন্যতম দৃঢ় বস্তু হওয়ায় এর কাটিং ও পলিশিংয়ের জন্য যে যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, তা বেশ ব্যয়বহুল।
ডায়মন্ড ইন্ডাস্ট্রিতে গত দুই দশকে বেশ বড় বড় পরিবর্তন এসেছে। খনি হতে হীরে উত্তোলন থেকে শুরু করে সাপ্লাই চেন সার্টিফিকেশন ও মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রেও এসেছে বেশ স্বচ্ছতা। তবুও দাম কমেনি হীরের। বিলাসদ্রব্য হিসাবে মানুষের কাছে হীরের চাহিদা ছিল সবসময় অন্যরকম, হয়তো ভবিষ্যতেও বজায় থাকবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct