১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে শের-এ বাংলা এ কে ফজলুল হকের উৎসাহে তৎকালীন বিধায়ক হাসিনা মোর্শেদ (১৯০৩-১৯৬৩) উদ্যোগ নিয়েছিলেন মুসলিম মহিলাদের উচ্চশিক্ষার জন্য কলেজ তৈরির। সে সময়ে হাসিনা মোর্শেদ ও অন্যান্য মুসলিম শিক্ষিতা নারী তৎকালীন ব্রিটিশ বাংলার গভর্নর লর্ড ব্রেবোর্নের স্ত্রী লেডি ডোরিন ব্রাউন ব্রেবোর্ন-এর কাছে এই কলেজটির আর্থিক সাহায্যের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। লেডি ব্রেবোর্ন সে অনুরোধে সাড়া দিয়ে সরকারি আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করে ১৯৩৮-৩৯ খ্রিস্টাব্দে মুসলমান মেয়েদের জন্য একটি নতুন কলেজ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা সরকার অনুমোদন করে। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১ জুলাই কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরে প্রয়াত লেডি ব্রেবোর্নের নামে কলেজটির নামকরণ করা হয়। ব্রিটিশ ভারতে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত মুসলিম নারীদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যা ‘পর্দা কলেজ’ নামে পরিচিত ছিল। কলকাতার ঐতিহ্যবাহী এই কলেজের প্রথম ব্যাচের সব ছাত্রী ছিলেন মুসলিম। তাদের মধ্যে একজন এখনও জীবিত রয়েছেন। তিনি হলেন জাহান অারা রহমান। তাকে নিয়ে এই বিশেষ প্রতিবেদনটি লিখেছেন শাকিলা হক। আজ প্রথম কিস্তি।
শিক্ষার প্রসার ছিল বিংশ শতাব্দীতে বাঙালি মুসলমানদের রেনেসাঁর উৎস। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে মুসলমান পুরুষদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার শুরু হয়। কিন্তু মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তারে একটি বড় বাধা ছিল কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে নবাব ফয়জুন্নেসা ও বেগম রোকেয়ার মতো মহীয়সী নারীদের নেতৃত্বে মুসলমান মেয়েরা লেখাপড়া ও সমাজসেবা শুরু করে। এর পরবর্তী প্রজন্মে শামসুন্নাহার মাহমুদ এবং খোদেজা খাতুনের মতো শিক্ষাবিদেরা বাংলার মুসলমান নারীদের জাগরণের পথ সৃষ্টি করেন। তৃতীয় প্রজন্মে কলকাতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষিত অনেক মুসলমান নারী শিক্ষা বিস্তারে এবং সমাজসেবায় অংশগ্রহণ করেন। তবে বেশির ভাগ সমাজসেবীই পরবর্তীকালে রাজনীতিতে যোগ দেন। এই প্রজন্মের যে কজন মুষ্টিমেয় নারী রাজনীতির প্রলোভন সত্ত্বেও রাজনীতি থেকে অনেক দূরে থেকে শুধু সমাজসেবা করে গেছেন, তাঁদের মধ্যে জাহান আরা রহমানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
জাহান আরা রহমান ১৯২২ সালের ২৭ আগস্ট কুমিল্লা শহরে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মফিজউদ্দিন আহমদ ছিলেন বাংলাপ্রদেশের সিভিল সার্ভিসের সদস্য। ১৯৫০-এর দশকে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের রিলিফ কমিশনারের পদ থেকে তিনি অবসর নেন। মায়ের নাম ছিল সালেহা খাতুন। সরকারি আমলার কন্যা হওয়ায় জাহান আরাকে পরিবারের সঙ্গে নানা জায়গায় ঘুরতে হয়েছে। সে সময় অনেক জেলা শহরে মেয়েদের হাইস্কুল ছিল না। তাই কখনো স্কুলের বদলে তাঁকে প্রাইভেট পড়তে হয়েছে।
১৯৩৮ সালে তাঁর বাবা দার্জিলিং থেকে বদলি হয়ে গেলেন এমন এক স্থানে, যেখানে কোনো মেয়েদের স্কুল ছিল না। তিনি তখন দশম শ্রেণির ছাত্রী। এই পরিস্থিতিতে তাঁর মা–বাবা তাঁকে জলপাইগুড়ির মেয়েদের স্কুলে আবাসিক ছাত্রী হিসেবে হোস্টেলে ভর্তি করিয়ে দেন। তখনকার দিনে প্রত্যেক ছাত্রীকে আরবি, ফারসি, সংস্কৃত বা পালি—এসব ভাষার মধ্যে একটি ভাষায় পরীক্ষা দিতে হতো। জলপাইগুড়ি স্কুলে আরবি বা ফারসি পড়ানোর কোনো শিক্ষক ছিলেন না। তাই তাঁকে সংস্কৃত ভাষায় পরীক্ষা দিতে হয়। এই অসুবিধা সত্ত্বেও তাঁর প্রধান শিক্ষিকা সুনীতিবালা চন্দ্রের বিশেষ তত্ত্বাবধানে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় ১৯৩৯ সালে প্রথম বিভাগে পাস করেন এবং প্রথম শ্রেণির বৃত্তি পান।
১৯৩৯ সালে কলকাতায় মুসলমান ছাত্রীদের জন্য লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই কলেজে মুসলিম ছাত্রীদের জন্য হোস্টেল করা হয়। একই ক্যাম্পাসে হোস্টেল ও কলেজ থাকায় মুসলিম ছাত্রীরা পর্দা মেনে পড়াশোনা করতে পারছিল। তাই এই কলেজ ‘পর্দা কলেজ’ নামে পরিচিত ছিল। কলেজটির প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। এই কলেজে জাহান আরা চার বছর পড়েছেন। আইএ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তবে তিনি দ্বিতীয় শ্রেণির বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ব্রেবোর্ন কলেজে তাঁর সব সহপাঠী ইতিমধ্যে ইন্তেকাল করেছেন। ২০১৪ সালে তিনি কলকাতা সফরে গেলে ব্রেবোর্ন কলেজের প্রথম ব্যাচের একমাত্র জীবিত ছাত্রী হিসেবে তাঁকে বিশেষ সংবর্ধনা দেওয়া হয়। (ক্রমশ...)
(লেখক প্রথম আলোর সহ-সম্পাদক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct