ফৈয়াজ আহমেদ: হ্যাঁ: অবিশ্বাস্য শোনালেও এটাই সত্যি। ‘ডাইভিং বেল স্পাইডার’ নামের এই প্রজাতির মাকড়শা জলের নিচেই বসবাস করে। এর বৈজ্ঞানিক নাম Argyroneta aquatica। ল্যাটিন ভাষায় যার অর্থ ‘জলের ভেতর রুপোর জাল’। এর নাম ডাইভিং বেল স্পাইডার হলেও একে ওয়াটার স্পাইডার বা জলজ মাকড়শা নামেও ডাকা হয়। ডাইভিং বেল স্পাইডার হলো তার গ্রুপের একমাত্র সদস্য যারা পুরো জীবন জলের নীচে কাটিয়ে দেয়। এরা শুধু জলের নিচে বসবাসই করে না, সেই সাথে শিকার, প্রজনন, ডিম পাড়াসহ যাবতীয় কাজ করে জলের নিচেই।
উত্তর ও মধ্য ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়ার অগভীর জলে এদের দেখা মেলে। জাপানেও এদের দেখা মেলে, তবে সেখানে এরা একটু ভিন্ন প্রকৃতির হয়। জাপানে পাওয়া এ ধরনের মাকড়শার বৈজ্ঞানিক নাম Argyroneta aquatica japonica।
জলের নিচেও তো শ্বাস নিতে হয়। তাহলে জলের নিচে এরা অক্সিজেন পায় কীভাবে? এই প্রজাতির মাকড়শারা জলের নিচে এয়ার বাবল তৈরি করে। এই বাবলগুলোকে বলে ডাইভিং বেল। এই বেল/বাবলের ভেতরই অক্সিজেন মজুদ করে রাখে এরা।
এই প্রজাতির মাকড়শারা নিজস্ব ডাইভিং বেল তৈরি করে শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ করে। প্রথমত, এরা জলের নিচে থাকা উদ্ভিদের সাথে সিল্কের জাল বুনে ঘর তৈরি করে। এদের ঘর দেখতে অনেকটা গম্বুজাকৃতির হয়।
জাল বোনার সময় এরা মূলত বায়ুভর্তি বাবল (বুদবুদ/জলবিম্ব) তৈরি করে। মাকড়শার নির্মিত কিছু ডাইভিং বেল (বাবল) খুবই ছোট হয়, যেগুলো শুধুমাত্র মাকড়শার পেট ধরে রাখ। বাকি বাবলগুলো ধরে রাখে পুরো দেহ। কিন্তু একটা বাবলে তো আর সারাজীবন কাটিয়ে দেয়ার মতো অক্সিজেন থাকে না। বাবলের ভেতর অক্সিজেন ফুরিয়ে গেলে তাতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেশি হয়। এতে বাবলটি সংকুচিত হয়ে ফেটে যায়। ফলে মাকড়াশাকে নতুন বাবল সংগ্রহ করতে হয়।
এজন্য মাকড়শারা জলের উপরিপৃষ্ঠে উঠে আসে এবং পায়ের ও পেটের লোমের সাথে বেধে জলের বুদবুদ (বাবল) নিজের বাসস্থানে নিয়ে যায়। এভাবে তারা গম্বুজাকৃতির ঘরয় অক্সিজেন ভরে নেয়। পুরো ঘরয় অক্সিজেন ভরা হয়ে গেলে তারা সেই জমাকৃত অক্সিজেনের মাধ্যমে শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ চালায়। লোমে আটকে থাকা এয়ার বাবল টেনে নিয়ে এরা আগে বাবলের জায়গায় প্রতিস্থাপন করে।
জলের নিচের বাবলগুলোই (বুদবুদ) এই মাকড়শাদের বাড়ি, শিকার ধরার ফাঁদ, ডিমের নার্সারি। এই বাবলগুলো মাকড়শার ফুলকার মতো কাজ করে। শারীরিক ফুলকা হিসেবে এই ডাইভিং বেল/বাবল ঠিক কতটা কার্যকর তা খুঁজে পেতে ইউনিভার্সিটি অফ অ্যাডিলেডের বিজ্ঞানী রজার সেইমুর এবং বার্লিনের হামবোল্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী স্টেফান হেটজ উত্তর জার্মানির ওডার নদী থেকে ডাইভিং বেল মাকড়শা সংগ্রহ করেন এবং জলজ আগাছা দিয়ে পূর্ণ অ্যাকুরিয়ামে রাখেন। এরপর গরমের দিনের একটি পুকুরের অনুকরণে গবেষকরা অ্যাকুরিয়ামে নতুন জল প্রতিস্থাপন বন্ধ করে জলকে স্থির করে দেন।
বুদবুদগুলোর অভ্যন্তরে এবং আশেপাশের জলে অক্সিজেনের মাত্রা পরিমাপ করার জন্য তারা ক্ষুদ্র অক্সিজেন সংবেদনশীল অপ্টোড দিয়ে বুদবুদগুলোকে খোঁচা দেন। এর মাধ্যমে গবেষকরা বুদবুদে প্রবাহিত অক্সিজেনের পরিমাণ এবং পরবর্তীকালে অক্সিজেন খরচের হার পরিমাপ করতে সক্ষম হন।
এর আগে ধারণা ছিলো ওয়াটার স্পাইডার প্রতি ১০-১৫ মিনিট অন্তর জলের উপরিপৃষ্ঠে উঠে আসে অক্সিজেনপূর্ণ বাবল নিতে। কিন্তু রজার সেইমুর এবং স্টেফান হেটজ তাদের গবেষণা থেকে সম্পূর্ণ নতুন ফলাফল পান। পূর্ববর্তী গবেষণার বিপরীতে তারা দেখতে পান, মাকড়শাগুলো পুনরায় বাতাস পূর্ণ করা ছাড়াই বুদবুদের ভেতরে এক দিনেরও বেশি সময় ধরে টিকে থাকতে পারে। এছাড়া এরা একদম স্থির জল থেকেও অক্সিজেন নিয়ে নিতে পারে।পুরুষ মাকড়শার তুলনায় স্ত্রী মাকড়শাই বেশি উপরে উঠে আসে অক্সিজেন বাবল নিতে।
জলের নিচের বাবলগুলো মাকড়শার ফুলকার মতো কাজ করে। প্রকৌশলীরা ডাইভিং বেলে বাতাস পাঠানোর জন্য হোস বা ব্যারেল ব্যবহার করতো। কিন্তু মাকড়শার বুদবুদে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তৈরি হয়। বেলের মধ্যে যে বাতাস থাকে তার চেয়ে আশেপাশের জলে বেশি পরিমাণে অক্সিজেন থাকে। তাই স্বাভাবিকভাবেই গ্যাসটি বুদবুদে বিভক্ত হয়। অনুরূপ কারণে, কার্বন ডাইঅক্সাইডও বিচ্ছুরিত হয় এবং ভেতরে বাতাস বিশুদ্ধ ও বাসযোগ্য থাকে। বুদবুদ একটি অতিরিক্ত ফুলকা হিসেবে কাজ করে, যার ফলে মাকড়সাটি শ্বাস নিতে পারে। এই বুদবুদগুলো যেন মাকড়শারই নিজস্ব অঙ্গ। এটি মাকড়শার সাথেই থাকে যখন এটি শিকার করতে যায়, সাঁতার কাটতে যায়। এর ফলে এরা সব পরিস্থিতিতে শ্বাস নিতে পারে।
এই প্রজাতির মাকড়শা জলের নিচে কীভাবে টিকে থাকে তা তো জানা হলো। এবার চলুন এদের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলো জেনে নেয়া যাক।
জলের নিচে এদেরকে দেখতে রুপার মতো উজ্জ্বল দেখায়। জলের উপরে এদের উপরের দিকটা দেখতে বাদামি আর পেটের দিকটা কালো রংয়ের। অন্যান্য মাকড়শার মতো এদেরও পেটের দিকে লোম থাকে।
এই প্রজাতির পুরুষ মাকড়শা ৭.৮-১৮.৭ মিলিমিটার লম্বা হয়। আর স্ত্রী মাকড়শা লম্বায় ৭.৮-১৩.১ মিলিমিটার হয়। সাধারণত অন্যান্য প্রজাতির পুরুষ মাকড়শারা স্ত্রী মাকড়শার তুলনায় ছোট হয়। কিন্তু এই প্রজাতির ক্ষেত্রে তা ব্যতিক্রম। পুরুষদের এই বড় হওয়ার কারণ হিসেবে বিশ্বাস করা হয়, পুরুষরা লম্বা হওয়ার কারণে এরা দ্রুত নাড়াচাড়া করতে পারে। এ কারণেই এরা সহজে শিকার করতে পারে এবং সহজে যৌনমিলন করতে পারে। আরো একটি বিশ্বাস প্রচলিত আছে, এ প্রজাতির স্ত্রী মাকড়শা আকারে ছোট হয় যেন তারা ছোট্ট ঘর-এ অনেকগুলো ডিম পাড়তে পারে।
প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ মাকড়শা মিলনের জন্য স্ত্রী মাকড়শার ডাইভিং বেলে ঢুকে যায় এবং তাকে তাড়া করে জলে নিয়ে আসে। স্ত্রী মাকড়শা মিলনে ইচ্ছুক হলে পা নাড়াচাড়া করে এবং পুরুষ মাকড়শার কাছাকাছি চলে যায়। আর মিলনে অনিচ্ছুক হলে রাগান্বিত ভাব দেখায়, পুরুষ মাকড়শাকে তাড়া করে। মিলনের ইতিবাচক সাড়া পেলে মাকড়শারা বেলের ভেতরে ঢুকে যায় এবং মিলনে লিপ্ত হয়। স্ত্রী মাকড়শা একসাথে ৩০-৭০টির মতো সাদা রঙের ডিম পাড়ে। এসময় স্ত্রী মাকড়শা ঘরটিকে উপর এবং নিচ দুই ভাগে ভাগ করে। উপরের অংশে থাকে ডিম আর নিচের অংশে সে নিজে বসবাস করে।
একবার ডিম পাড়লে বাচ্চা ফোটা পর্যন্ত স্ত্রী মাকড়শা পাহারা দেয়। দুই থেকে চার সপ্তাহ পর্যন্ত এরা মায়ের ঘরতেই বড় হয়। চার সপ্তাহের দিকে চতুর্থবারের মতো এদের খোলস ছাড়ানো হয়ে যায়। এরপর থেকেই বাচ্চা মাকড়শাগুলো নিজেদের ঘর তৈরি করতে শুরু করে।
এই মাকড়শাগুলো সাধারণত জলজ পোকা এবং ছোট ছোট মাছ খেয়ে বেঁচে থাকে। তাছাড়া মশার লার্ভা খেয়ে এরা আমাদের উপকারও করে। তবে এর কামড় বেশ যন্ত্রণাদায়ক। এর কামড়ে জ্বর, বমি এবং প্রচন্ড ব্যাথা হতে পারে। এরা সাধারণত এক থেকে দুই বছর বেঁচে থাকে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct