খাজিম আহমেদ: আন্তর্জাতিক কমিনটার্ন-এর অন্যতম বিশিষ্ট নেতা, র্যাডিকাল হিউমানিস্ট এম. এন. রায় বলছেন, ইবনে সিনা, বিত্তবান ভূস্বামী আর সফল ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান ছিলেন। গৌরবময় শহর বোখারা-র তার জন্ম (৯৮০-১০৩৭)।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে মুসলমান আরবীয়রা কর্ষতার শীর্ষ বিন্দু স্পর্শ করেছিলেন। আরবীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠতম খ্যাতিসম্পন্ন পুরুষটির নাম আল্ রাজি (৮৬৫-৯২৫ খ্রিস্টাব্দ)। ঠিক এর পরেই বিস্ময়ের সঙ্গে স্মরণ করতে হবে, তিনি অবশ্যই ইবনে সিনা।
ইবন সিনা / ইবনে সিনা / বু আলি সিনা নামেরও তিনি উচ্চারিত। ল্যাটিনে ‘Avicenna’ ‘হিব্রুতে’ ‘Avencina’ নামেই তিনি ইউরোপীয় দুনিয়ায় সমধিক পরিচিত। আরব জাহানে তাঁকে ‘আল্ শায়খ-আল্ রইস’ (দ্য শেইখ অ্যান্ড প্রিন্স অব দ্য লাার্নেড) হিসেবে পরম শ্রদ্ধা অর্পণ করা হয়। ইবনে সিনা ইউরোপের চিকিসাবিজ্ঞান চর্চায় এবং চিকিৎসাকেন্দ্রে প্রায় পাঁচশ বছর বিশেষজ্ঞ হিসেবে সম্মানিত হয়েছিলেন। প্রগাঢ় সম্মান পেয়েছিলেন।
ইউরোপের চিকিৎসা কেন্দ্র হিসেবে স্যালারনো (SALERNO) নির্ভরযোগ্য দক্ষতা আর নৈপুণ্যের পরিচয় রেখেছিল। আরবীয় মুসলমানদের অধীত জ্ঞানই ইউরোপীয় চিকিৎসকদের অনুপ্রাণিত আর উদ্বুদ্ধ করেছিল। স্যালারনো চিকিৎসা শিক্ষা কেন্দ্র ইবনে সিনার জ্ঞানের আর পদ্ধতির চর্চায় করা হত।
গণিত আর পদার্থবিদ্যার ওপর তাঁর গবেষণা কর্মগুলো অশেষ গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিল। চিবিৎসাবিজ্ঞানে তাঁর অবদান এবং ‘আল্ কানুন’ নামক অসাধারণ গ্রন্থটির জন্য তিনি আদম সখ্যতার ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন।
ইবনে সিনা চিকিৎসক, দার্শিনিক, ভাষাতাত্ত্বিক এবং কবি। জীবনের শেষ অধ্যায়ে দর্শন চর্চায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করেছিলেন।
ইবনে সিনার ধর্মীয় এবং দর্শন সম্পর্কে নিজস্ব সুনির্দিষ্ট মতামত ছিল। তিনি যুক্তিবাদ-এর প্রতি অশেষ মর্যাদা আর গুরুত্ব আরোপ করতেন। বোখারার উদারপন্থী শাসকগোষ্ঠী সিনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন কিন্তু ধর্মীয় উলেমা গোষ্ঠীর প্ররোচনায় ইবনে সিনাকে দরবার ছাড়তে হয়। এরপরে আরব সাম্রাজ্যের প্রান্তে প্রান্তে তিনি চিকিৎসা শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষাদান করতে থাকেন। ‘ইমান িসপেশন অব্ হিউম্যান ইনটেলেক্ট’ (মানবীয় বুদ্ধি ও বিবেকের মৃুুক্তি) সংক্রান্ত দার্শিনিক মতবাদও প্রচার করেছিলেন আমৃত্যু (১০৩৭ খ্রিস্টাব্দ)। এর জন্য আরবীয় পণ্ডিত সমাজ তাঁকে ‘আল্ মুয়াল্লিম আল্ খানি’ অভিধায় ভূষিত করেন। অর্থাৎ ‘দ্য সেকেন্ড টিচার আফটার অ্যারিস্টটল প্লেটো’র (আফলাতুন) ‘নিও প্লেটোনিক’ তত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
‘ইসলাম তার ইতিহাসের প্রথম পাঁচশ বছরে এমন অনেক জ্ঞানীর জন্ম দিয়েছে যাঁরা স্বর্গীয় দেবদূত ইত্যাদির দিকে মন দেওয়ার চেয়ে গ্রহ নক্ষত্রের চর্চায় বেশি মনোনিবেশ করেছিলেন।’ বিজ্ঞানের চর্চায় বেশি আগ্রহী ছিলেন। (দেখুন: এফ. এ. ল্যানজে, দ্য হিস্ট্রি অব মেটেরিয়ালিজম’ প্রথম খণ্ড, পৃ: ১৮৪)। আল্ কিন্দি, আল্ ফারাবি, েইবনে সিনা, ইবন রুশদ ছিলেন এই ধারার বিপ্রবী চিন্তানায়ক। ইবন রুশদ-এর মৃত্যু ১১৯৮ খ্রিস্টাব্দ। আল গাজ্জালি ছিলেন প্রখর যুক্তিবাদী ধর্মবেত্তা দার্শনিক। মৃত্যু ১১১১ খ্রিস্টাব্দ। উপরোক্ত বিদ্বৎসমাজ (আহল-ই-কলম) এর কথা ‘আপনজন’-এর পাঠক সজ্জনের দরবারে ক্রমানুসারে পেশ করা হবে।
কৌতূহলোদ্দীপক একটি তথ্য এখানে উল্লেখ করা গেল। চিকিৎসা বিদ্যাশাস্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং চিকিৎসা গ্রন্থের অশেষ মান্যতা আর স্বীকৃতি প্রাপ্ত লেখক হিসেবে ইতিহাস যাঁদের পেয়েছে, তাঁরা প্রায় সকলেই ‘পার্শিয়ান’, কিন্তু তাঁদের মূল গবেষণা বা গ্রিক জ্ঞানবিজ্ঞানের গ্রন্থের অনুবাদক হিসেবে আরবি ভাষাকেই ব্যবহার করেছেন। এঁদের মধ্যে বিশিষ্টরা হলেন আলি আল্ তারাবি, আল্ রাজি, আলি ইবন আল আব্বাস আল মাজুসি প্রমুখ।
প্যারিস বিশ্বাবদ্যালয়ের ‘স্কুল অফ মেডিসিন’-এর বিশাল হলঘরের দেওয়ালে আল্ রাজি এবং ইবনে সিনার প্রতিকৃতি মর্যাদার সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে আজও, এখনও।
দার্শনিক-বিজ্ঞানী আল্ ফারাবির পরে ইবনে সিনা (মৃত্যু ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দ) আরবীয় সাংস্কৃতিক জগতে সঙ্গীত সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আর চমকপ্রদ কাজ করেছিলেন। অধ্যাপক পি. কে. হিট্টি মন্তব্য করেছেন এই ভাবে, ‘ইবনে সিনা, আল ফারাবির স্টাইল অনুসরণ আর অনুপ্রেরণায় দারুণ দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। এবং তাঁর গবেষণা কর্মগুলোকে ‘পারফেকশন’ নিয়ে এসেছিলেন। খোলাখুলি বলা দরকার, গ্রিক সভ্যতার উন্নত আর পূর্ণ জ্ঞানরাশিকে ইবনে সিনা সুসংহত করে এসেছিলেন এবং এর ফলে তাবৎ মুসলিম দুনিয়া আলোকিত হয়ে উঠেছিল। বিশেষত গ্রিক দর্শনের সঙ্গে কঠোরভাবে একেশ্বরবাদী ইসলাম সম্পর্কে নিবিড় করে তুলেছিলেন।
ইবনে সিনা শিক্ষাবিদের ভূমিকাতেও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন। শিক্ষা ও সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর একটি অনিঃশেষ গুরুত্বপূর্ণ ’কিতাব’ রয়েছে। সেটির ক্যাতি বিশ্বজোড়া। গ্রন্থটির নাম ‘রিসালাত আল্ সিয়াসা’। এই গ্রন্থে শিশুদের যথার্থ লেখাপড়া আর সুশিক্ষার জন্য বিশেষ পরামর্শ নির্দেশ আর নীতিমালার সূত্র সন্ধান করেছেন। বস্তুত সর্বার্থে তিনি একজন ‘এডুকেটর’ এবং ‘পেডাগগ’ (শিক্ষক)।
শৈশবে ইবনে সিনা বোখারাতেই লেখাপড়া করেছেন। তিনি রাজকীয় গ্রন্থাগারে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এটি তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। কেননা বুখারার রাজকীয় প্রাসাদের গ্রন্থাগারটি ছিল প্রায় অবিশ্বাস্য রকমের উন্নত। গ্রন্তাদির শেষ ছিল না। অধ্যাপক হিট্টি বলছেন, ‘এখানে সিনা ‘Imexhaustible fund of knowledge’- অর্জন করেছিলেন।
সাধারণ্যে এটি প্রচলিত ধারণা যে, ড্যানিয়েল ডিফো, ‘Robibson Crusoe’র লেখক বা নির্মাতা, কিন্তু তিনি যে গ্রানাডার চিকিৎসক এবং অ্যারিস্টটলীয় দার্শনিক ইবন আল তোফায়েল (পুরো নাম, আবু বকর মুহাম্মদ ইবন আবদ আল্ মালিক ইবন তোফায়েল) এর ‘Hayy ibn Yaqzan’-এর ভাবানুবাদ করেছেন তা অজানা আর অজ্ঞাত রয়ে গেছে।
আদতে ইসলামাশ্রয়ী হুকুমতের ক্রমপতনের ডর থেকে পাশ্চাত্যের খ্রিস্টীয় সম্প্রসারণবাদীরা ইসলামের হৌরবময় বিষয়গুলোকে প্রায়শই কবরস্ত করার ‘কোশেশ’ জারি রেখেছে। আজকের দায়িত্ব হল সেই স্বর্ণোজ্জ্বল যুগের বিষয়গুলোকে নয়া প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের সামনে হাজির করা। অতি সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার বলেছেন, আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন, মিথ্যে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে বারবার সত্যটাকে জোরেশোরে জনসমক্ষে তুলে ধরতে হবে।
আগ্রহ উদ্দীপক একটি তথ্যের উল্লেখ করি, ইবনে তোফায়েলের যে গ্রন্থটির উল্লিখিত হল, সেই নামেই ইবনে সিনার একটি ছোট গল্পের বই রয়েছে। সেটির চরিত্রের নামগুলোও ইবনে তোফায়েল ‘ইস্তেমাল’ (ব্যবহার) করেছেন। যদিও গল্প বলার রেওয়াজটি বা রীতিটি গ্রহণ করেছিলেন আল্ ফারাবির স্টাইল থেকে।
অ্যারিস্টল রচিত, ‘Zoology’-র অনুবাদ করেছিলেন ইবনে সিনা। সেই গ্রন্থটির নাম ‘Abbreviation Avicenne de animalibus’. আরবি মুসলিম পণ্ডিত, দার্শনিক আর বিজ্ঞানীবর্গের দ্বারা চর্চিত, বর্ধিত, সংরক্ষিত আর অনুবাদিত জ্ঞানচর্চা করে ইউরোপে নয়া জাগরণের উন্মেষ সম্ভব হয়েছিল এ বাবদে অনেকেই ওয়াকিবহাল নন। আর কতদিন মরুবারুরাশির মধ্যে অস্ট্রিচ বা উট পাখির মতো নাক, কান, চোখ গুঁজে থাকবেন; উন্নাসিক নস্যাৎপ্রবণ পণ্ডিতবর্গ?
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct