মুঘল প্রাসাদের সুকন্যা বর্গ
মুঘল প্রাসাদের মহীয়সী রমণীদের নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে চর্চা অব্যাহত রয়েছে। মুঘল ‘হারেমের’ মহীয়সী মহিলাদের মধ্যে যে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চেতনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নিহিত রয়েছে তার প্রকৃত চিত্র সেভাবে আসেনি বা এক শ্রেণির ইতিহাসবিদদের জন্য তা পাঠকের অগোচরেই রয়ে গেছে। অথচ, মুঘল হারেমের মহীয়সী রমণীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন উচ্চ সংস্কৃতি-মনস্ক, শিক্ষিতা ও আরবি-ফার্সি ভাষায় বিশেষভাবে দক্ষ। আর তাই মুঘল পরিবারে তাঁদের একটা বড় প্রভাব কাজ করেছে। মুঘল আমলের সেই সব অনালোকিত মহীয়সী নারীদের ভাষা শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চেতনার কথা তুলে ধরেছেন আত্মানুসন্ধানী ইতিহাস-গবেষক খাজিম আহমেদ।
_______________________________
ইসলাম নারী শিক্ষা সম্পর্কে অত্যুচ্চ ধারণা আর আগ্রহ প্রকাশ করে। ইসলামি ‘হিন্দুস্তান’-এ মুসলমান নারী শিক্ষা উপেক্ষিত ছিল না, তার অগণন নজির রয়েছে। সে বাবদে হাল আলোচনায় শুধুমাত্র মুঘল ‘হারেমের’ মহীয়সী মহিলাদের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চেতনা এবং অবদান সম্পর্কে সীমিত পরিসরে আলোচনা করা গেল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ‘হারেম’ শব্দটি নিয়ে অনেকেরই ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। শব্দটি ‘তুর্ক-পারসিক’। অর্থ হল: ‘The women’s quarters of an aristocratic Muslim household’ (দেখুন: Oxford Eng. Dictionary, Page 255.).
মুগল যুগে নারী শিক্ষা উপেক্ষিত হয়েছিল এমন ভ্রান্ত ধারণা যথার্থ নয়। আলোচ্য আমলে বেশ কয়েকজন মার্জিতা উচ্চ শিক্ষিতা মহিলার অবস্থান ঐতিহাসিক ঘটনা। ‘কানুন-ই ইসলাম’-নামক গ্রন্থে এর বিস্তর প্রমাণ রয়েছে। রাজকুমারী, ‘বাদশাহ’-এর নিকট আত্মীয় বর্গের কন্যা, আমির-উমরাহ এবং খানদানি (অভিজাত) শ্রেণির মহিলারা গৃহেই শিক্ষার্জন করেন।
মধ্যবিত্ত হিন্দু ও মুসলমান পরিবারেও নারী শিক্ষার কদর ও মর্যাদা ছিল। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, হিন্দু পরিবারের মেয়েরা, ছেলেদের সঙ্গেই প্রাথমিক শিক্ষা ও বিদ্যার্জন করত। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে, ‘The Auxiliary Committee of the Indian Statutory Commission’ রিপোর্ট পেশ করেছিল, মুঘল শাসনামলে হিন্দু মুসলিম কোনও নারীর-ই শিক্ষার পথে কোনও বাধা বা অন্তরায় ছিল না। বাদশাহ আকবর (মুঘল-ই-আযম)-এর সময়ে, ‘Regular training was given to the ladies of the royal household’. মুঘল আমলের কিছু সংখ্যক মহিলা শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে শিক্ষিতাই ছিলেন না, অধিকন্তু তাঁরা সমানে সাহিত্য চর্চাও করতেন।
মুহাম্মদ জহিরউদ্দিন বাবরের কন্যা এবং হুমায়ুনের বৈমাত্রেয় ভগিনি গুলবদন বেগম, ‘হুমায়ুননামাহ’-র সারা জাহান বন্দিত লেখিকা। ইউরোপীয় পণ্ডিতবর্গ গ্রন্থখানির অনিঃশেষ প্রশংসা করেন। গুলবদন তাঁর মার্জিত মানবীয় গুণের জন্য সম্মানিত মহিলা হিসেবে ইতিহাসে স্বীকৃত। তৈমুরীয় পরিবার, বেগম গুলবদনের জন্য গর্বানুভব করতেন। গুলবদন বেগম পুরুষসিংহ বাবর, ভাগ্যহীন হুমায়ুন আর মহামতি আকবরের ‘হুকুমত’-এর প্রাথমিক কাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। সেই সময়তক তাঁর ‘সিয়াসত-ই’ ধারণাও (‘political concept’) ছিল স্বচ্ছ। তৎকালীন বিচারে তিনি ছিলেন একজন উঁচুমানের মহিলা।
১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দে গুলবদন ‘হুমায়ুননামাহ’-র রচনা শেষ করেন। এই গ্রন্থখানির পাণ্ডুলিপি ‘ব্রিটিশ মিউজিয়ামে’ সংরক্ষিত। তিনি শুধুমাত্র গদ্যনির্মাণেই তাঁর দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন বিষয়টি তেমন নয়, অসাধারণ ফার্সি কবিতারও সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। অসংখ্য গ্রন্থ সংগ্রহ এবং তার পরিচর্চা ছিল স্বভাব বৈশিষ্ট্য। বিশাল গ্রন্থাগার স্থাপন করেছিলেন। সুতীব্র জ্ঞানসাধনার প্রতীক ছিলেন তিনি। তাঁর ‘আত্মজীবনী’ এবং অন্যবিধ স্মৃতিকথা লন্ডনের ভারতীয় দফতরে মওজুদ রয়েছে। মিসেস এ. এস. বেভারিজ ‘হুমায়ুননামাহ’-র ইংরেজি অনুবাদ করেছেন, ‘Life and Memories of Gulbadan Begum’ নামে। এই মহীয়সী রাজকুমরি তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির মধ্যেই অমর হয়ে রয়েছেন।
সম্রাট বাবরের দাদি আম্মা (ঠাকুরমা) এহসান দৌলত বেগম এবং এই মহিলার কন্যা বেগম কুতলুগ নিগার খানুম মর্যাদাময়ী হিসেবে সম্মানিতা ছিলেন।
মুঘল রাজকীয় প্রাসাদের দ্বিতীয় বিশিষ্ট মহিলা হলেন সুলতানা সলিমা। বাদশাহ হুমায়ুনের অতি উচ্চ শিক্ষিতা, বিদূষী ভগিনী গুলরুখ বেগমের কন্যা সুলতানা সলিমা। বিদূষী মায়ের প্রভাব পড়েছিল তাঁর শিক্ষা আর মননচর্চায়। ‘তাহজীব তামাদ্দুন’ সম্পর্কে সচেতন গুলরুখ বেগম তাঁর কন্যাকে শৈশব থেকেই ফার্সি ভাষায় পারদর্শিনী করে তোলার অভিপ্রায়ে যথার্থ ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিলেন। বেগম গুলরুখের ‘কোশেশ’ ব্যর্থ হয়নি। হুমায়ুনের দুঃসময়ের বন্ধু তুর্ক-আফগান সর্দার বৈরাম খাঁর সঙ্গে সলিমা সুলতানার বিবাহ হয়েছিল।
বৈরাম খাঁ-র ইন্তেকালের পর সম্রাট আকবর এই মর্যাদা সম্পন্না গুরুত্ববাহী বিদূষী মহিলার গুণে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিবাহ করেন। যুবরাজ সেলিম, সুলতানা সলিমাকে গভীর শ্রদ্ধা করতেন। সলিমা সুলতানা ও যুবরাজ সেলিমকে পুত্রাধিক স্নেহ-ভালবাসায় সিক্ত করে রেখেছিলেন।
১৬০৪ খ্রিস্টাব্দে সেলিম, আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং এলাহাবাদে একটি স্বতন্ত্র রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। চঞ্চলমতি পুত্রকে, সলিমা বেগম; দিল্লিতে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। সুলতানা সলিমা একজন উঁচুস্তরের রোমান্টিক ফার্সি কবি। নিরবচ্ছিন্ন অবসর তিনি সাহিত্যচর্চায় ব্যয় করতেন। প্রাসাদ প্রাচীরের অন্তরালে বসে বহিঃপ্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ণনায় অস্বাভাবিকতা থাকলেও আন্তরিকতায় কৃত্রিমতা ছিল না। ফার্সি কবিতা রচনার সময় তিনি ‘ম্যাকফি’ এই ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। ‘ম্যাকফি’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘Behind the Screen’.পর্দার অন্তরালে। সে সময়ে অনেকেই এই ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন।
বাদশাহ আকবরের মাতা হামিদা বানু বেগমও মানসিক উৎকর্ষ সম্পন্না মহিলা। অতীব দুের্যাগ এবং বিড়ম্বনা-বিপন্নতার মধ্যেও তিনি তাঁর স্বামী হুমায়ুনের সঙ্গ পরিত্যাগ করেননি। ১৫৪২ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে সম্রাট হুমায়ুন এই অভিজাত মহিলাকে বিবাহ করেন। হামিদা বানু বেগম, শেইখ আলি আম্বার জৈনি-র কন্যা। উচ্চশিক্ষত হুমায়ুনের যোগ্য সহধর্মিণী হওয়ার যোগ্যতা তাঁর ছিল। তিনি শিল্প ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। আকবরের জীবনদর্শন ও বোধের ওপর হামিদা বানুর অপরিসীম প্রভাব পড়েছিল। ঐতিহাসিক বর্গ এ বাবদে সহমত পোষণ করেন। ‘মরিয়ম মাকানি’ নামেও তিনি পরিচিতা ছিলেন।
মহামতি আকবরের পালক মাতা এবং আদম খানের মাতা মহাম অংগা মুঘল হারেমের অন্যতম বিশিষ্টতর প্রভাবশালী মহিলা ছিলেন। কাব্যচর্চা করতেন। সমসাময়িক রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ সর্বজনবিদিত। ইতিহাসবিদ বদায়ুনি এই মহিলার ভূয়সী স্তুতি করেছেন। তৎকালীন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক কাফি খাঁ, মহান অংগা-কে ‘খাদিজা-ই-অজামিনী’ অর্থাৎ ‘বর্তমানের খাদিজা’ নামে ভূষিত করেছিলেন। রাজধানীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি ব্যক্তিগতভাবে ব্যাপক প্রয়াস করেছিলেন। মক্তব-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যক্তিগতভাবে দান করতেন এই বিদ্যোৎসাহী মহিলা। হুমায়ুন প্রতিষ্ঠিত সামরিক দুর্গের বিপরীতে সুবৃহৎ একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নিজ পুত্রের রাজকীয় প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনের শেষ পর্যায়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে ওঠেন। প্রাকৃতিক প্রবৃত্তির এটি স্বাভাবিক কিন্তু সফল হননি। পুত্র আদম খাঁ নিহত হন। পুত্র েশাকে; এই ঘটনার চল্লিশ দিন পর তাঁর মৃত্যু হয়।
মুঘল হারেমের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও প্রভাবশীল মহিলা নূরজাহান। জনাব মুতাবিদ খাঁ ‘ইকবালনামাহ-ই-জাহাঙ্গিরি’ নামক প্রামাণ্য গ্রন্থে নূরজাহান সম্পর্কে বিস্তর তথ্য আর খবরাদি সন্নিবেশ করেছিলেন। আদতে তাঁর পিতৃ-মাতৃ দত্ত পারিবারিক নাম মেহেরউন নিশা। পিতা মির্জা গিয়াসউদ্দিন বেগ ভাগ্যের অনুসন্ধানে ‘হিন্দুস্তান’-এ এসেছিলেন। নূরজাহান-এর জন্ম কান্দাহারে। মির্জা বেগ তখন এসেছিলেন হিন্দুস্তানের পথে। ‘ডেসটিনি’ তাঁকে অনেক ওপরে ওঠার মওকা দিয়েছিল। তিনি তখন তামাম হিন্দুস্তান-এর ইৎমাতউদ দৌলাহ নামে সামরিক পরিচিত। অসাধারণ কর্মতৎপরতা আর দক্ষতার বদৌলতে আকবরের রাজসভায় উচ্চপদে আসীন হয়েছিলেন। নূরজাহানের সঙ্গে বর্ধমানের গভর্নর শের আলি কুলি খানের শাদি মোবারক সম্পন্ন হয়। বিশেষ প্রেক্ষিতে কুতুবউদ্দিনের হাতে শের আলি কুলি খানের মৃত্যু হলে নূরজাহান কন্যাসহ রাজধানী দিল্লি ফিরে গেলেন। সুলতানা সলিমার তত্ত্বাবধানে আর পৃষ্ঠপোষকতায় চার বছর মুঘল প্রাসাদে অবস্থান করেছিলেন। ১৬১১ খ্রিস্টাব্দের সার্চ মাসে অচানক জাহাঙ্গিরের সঙ্গে শৌখিন মীনাবাজারে ‘মোলাকাৎ’ হয়ে যায়। জাহাঙ্গির ছিলেন ‘Maverick’ প্রকৃতির মানুষ। নূরজাহান ছিলেন একজন অনিন্দ্য সুন্দরী ‘হুরি’ (Hourie- a beautiful young lady)। জাহাঙ্গির তাঁর নিরুপম সৌন্দের্য বিমোহিত হলেন। সুলতানা সলিমা অভিবাবিকার দায়িত্বে জাহাঙ্গিরের সঙ্গে নূরজাহানের বিবাহ সম্পন্ন করলেন। তিনি ‘নূরমহল’ নামেও (Light of the Palace) পরিচিতা ছিলেন।
প্রবাদপ্রতিম ঐতিহাসিক ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ এ বাবদে অভিমত পেশ করেছেন, নূরজাহান ‘Lord of Hindustan’-এর পত্নী হওয়ার সুযোগ পেয়ে তাঁর বংশের ইতিহাসে এক নয়া অধ্যায়ের সূচনা করেন। বিবাহের পর মেহেরউন নিশার নামকরণ করা হল: নূরমহল এবং পরে নূরজাহান হিসেবে ইতিহাসে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর পূর্বতন স্বামী শের আলি কুলির মৃত্যু সম্পর্কে নানান কহাবৎ রয়েছে। ড. বেণীপ্রসাদ, গ্লাডউইন এবং ডি লায়েটের বীক্ষণ পরস্পর বিরোধী। এহোবাহ্য। বস্তুত বিশেষ একটি সময়ে তামাম হিন্দুস্তান-এর হুকুমতি ক্ষমতা নূরজাহানের হাতে কেন্দ্রীয়ভূত হয়। পিতা ইৎমাতউদ দৌলাহ এবং ভ্রাতা আসফ খান ‘ওমরাহ’ শ্রেণির ‘জানে-মানে’ সদস্য হয়ে যান। শের আলি কুলি খান মুঘল ধারার যুবক ছিলেন না। তিনি ছিলেন পাঠান অর্থাৎ তুর্ক-আফগান ধারার সন্তান। তাঁর ঔরসজাত নূরজাহান দুহিতা লাডলি বেগম অশেষ যত্নে লালিত হয়েছিলেন। নূরজাহানের ‘পরবরিশ’-এ এই গুণবতী তরুণীর বিবাহ হয়েছিল সম্রাট জাহাঙ্গিরের পরম স্নেহের কনিষ্ঠ পুত্র শাহরিয়রের সঙ্গে। ক্রমেই সম্রাজ্ঞী নূরজাহান অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন। ব্যক্তি জীবনে ‘কামিয়াবির’ শিরে তিনি ‘সরতাজ’ পরিয়ে দিয়েছিলেন।
‘অ্যান অ্যাডভানসড হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’-য় মন্তব্য করা হয়েছে এইভাবে: ‘Mihar-un-Nissa’s charming appearance caught the kings far seeing eye and so captivated him that he married her, and made her chief Queen’.
ফার্সি এবং আরবি ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর গভীর জ্ঞান তাঁকে যথার্থ বিদূষী করে তুলেছিল। জ্ঞানে-গরিমায়, আভিজাত্যে তিনি নিজেকে ‘আইকনিক’ স্টেটাসে উন্নীত করেছিলেন। কবিতা চর্চা ও সঙ্গীত শিল্পেও তাঁর নিপুণতা তৎকালে আলোচ্য বিষয় ছিল। সংস্কৃতি চর্চার জন্য নূরজাহানের খ্যাতি সর্বজনবিদিত। ওড়না, কাঁচুলি, গোলাপ, আতর, নির্যাস, ডিমকে ফুলের মতো করে সাজানোর পদ্ধতিও তিনি উদ্ভাবন করেন। উৎকৃষ্ট কাঠ নির্মিত জালি ব্যবহার করে বিশাল কোনও কক্ষের কিয়দাংশে হালকা গোপনীয়তা নিয়ে আসার কৌশলও তিনি প্রয়োগ করতেন। এই সব বিষয় তাঁর ‘ডিসেন্ট লাইফ’-এর প্রতি আসক্তি প্রমাণ করে। রঙ-বাহারের রাজকীয় ‘লেবাস’ আর আগরবাতি নির্মাণের পদ্ধতিও তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। খানাপিনার টেবিলের সরঞ্জামও নূতনভাবে তৈরি করেছিলেন। ‘হারেম’ অর্থাৎ খাস মহিলা মহলে কী ধরনের পর্দা ব্যবহার করা হবে তা তাঁরই নির্দেশে করা হতো। সুতি ও রেশমি কাপড় এবং স্বর্ণালঙ্কারে তিনি যে ধরনের কারুকৃতির প্রচলন করেন তা আজও ‘ফ্যাশনিস্ট’দের অজানা রয়ে গেছে। তাঁর অভূতপূর্ব সৌন্দর্য প্রীতি তাঁর সুরুচির পরিচয় বহন করে। ‘আ শর্ট হিস্ট্রি অব মুসলিম রুল ইন ইন্ডিয়া’ নামক দিক-নির্দেশক গ্রন্থে ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ মন্তব্য করেছেন,
দ্বিতীয় উমর শায়খ মির্জার বড় মেয়ে খানজাদ বেগম, হুমায়ুনের প্রথম স্ত্রী বেগা বেগম, বাবরের তৃতীয় স্ত্রী মাহিম বেগম (আনার চাঁদ), গুলশারী (বাবরের কন্যা) প্রমুখ মুঘল হারেমের উজ্জ্বল সদস্যা।
নূরজাহানের ভাগনি ও আসফ খানের কন্যা আলেয়া বেগম আরজুমন্দ বানু শিক্ষাদীক্ষা এবং মানসিক বিকাশের দিক থেকে তাঁর ফুপি-আম্মার (পিসিমা) ‘সার্থক প্রতিনিধি’। ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে আরজুমন্দ বানুর জন্ম। ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে বাদশাহ জাহাঙ্গিরের তৃতীয় পুত্র খুররমের সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল তাঁর। সেই সময় তিনি বিশ বছরের তরুণী। জাহাঙ্গির পুত্রবধূকে অতলান্তিক স্নেহভরে ‘মমতাজ’ বলে ডাকতেন। তাঁর কুদরতি সৌন্দর্য ছিল বর্ণনাতীত। গৌরবময়ী এই মহিলা জাহানারা ও রৌশনারার মতো কন্যাদ্বয়ের জননী। রৌশনারার (রওশানারা) জন্মের পর মমতাজের জীবনদীপ নির্বাপিত হয়ে যায়। বাদশাহ শাহজাহান পত্নীপ্রেমের উজ্জ্বল স্মৃতি হিসেবে নির্মাণ করেন তাজমহল। এই স্মৃতিসৌধ মমতাজকে অমর করে রেখেছে। মমতাজ ফার্সি ভাষায় কাহন কাহন কবিতা রচনা করেছেন। আরবি সাহিত্যেও তাঁর জ্ঞান ছিল অপরিসীম। তাঁর অকাল প্রয়াণের ফলে মুঘল রাজ পরিবার হারিয়েছিল এক চমকপ্রদ মহিলাকে।
যুবরাজ খুররম যখন রাজপুত সৈনিকদের বিতাড়নে ব্যস্ত, সে সময়ে খাজা মইনউদ্দিন চিশতির মসজিদের কাছাকাছি স্থানে ১৬১৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে আরজুমন্দ বানুর দ্বিতীয় কন্যা জাহানারা বেগমের জন্ম হয়। জাহানারাকে সম্রাট জাহাঙ্গির প্রভূত স্নেহ করতেন। বিদূষী মহিলা সিতি-উন নিশার তত্ত্বাবধানে জাহানারা তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করেছিলেন। সিতি-উন নিশাও উদার ও সুশিক্ষিতা ছিলেন। তিনি জাহাঙ্গিরের সভাকবি (Poet Laureate) জনাব তাবিল আমুলির ভগ্নি। জাহানার তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন ছিলেন; স্বভাবতই সীমিত সময়ের মধ্যেই আল কুরআন, আরবি ফার্সি ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি খাজা মইনউদ্দিন চিশতিও তাঁর কতিপয় রচনা নিয়ে ‘মুনসি-উল-আরউই’ নামক একটি জীবনী গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। দেহলির জামা মসজিদের কাছে একটি বৃহৎ মাদ্রাসা স্থাপনের কৃতিত্বও তাঁরই। সম্মানিতা জননীর ইন্তেকালের পর তিনিই প্রাসাদের মহিলা-মহলের ‘প্রধান মহিলা’ নির্বাচিত হন।
প্রখ্যাত ব্রিটিশ ঐতিহাসিক স্টেইনলি লেনপুল মন্তব্য করেছেন, ‘৬৭ বছর বয়সে অবিবাহিতা অবস্থায় ‘পূর্ব সৌন্দর্য ও খ্যাতিসম্পন্ন বিরাজিত থাকাকালীন তাঁর মৃত্যু হয়।’
হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সমাধির সন্নিহিত স্থানেই তাঁর সমাদি রয়েছে। সমাধির উপরে একটি স্মৃতিফলক রয়েছে- সেটি ফার্সি ভাষায় লেখা। বাংলা ভাষায় তার মর্মার্থ হচ্ছে এই:
‘কোনা ধনী চাঁদোয়ায়
আমার বিশ্রামস্থল ঢেকো না,
এই তৃণ- একটি সরস হৃদয়ের
কবরের শ্রেষ্ঠ চাঁদোয়া।’
এটি তাঁর স্বরচিত ফার্সি কবিতার সরল বঙ্গানুবাদ। জাহানারর হস্তাক্ষর ছিল নিটোল ঝকঝকে অার পরিচ্ছন্ন। তৎকালীন একজন অতি উচ্চ শিক্ষিতা মহিলা সফিউন নিসা, জাহানারাকে অধিকতর শিক্ষিতা করে তোলার প্রশ্নে বিশেষ যত্নবান ছিলেন। গত শতকের আটের দশকে নিচুমানের দু’একজন সাম্প্রদায়িকতায় আচ্ছন্ন গদ্যকার ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনার নামে সাংস্কৃতিক ইতরামি করেছে জাহানারার ব্যক্তিজীবন নিয়ে। সময়ের বিচারে অাস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপিত হয়েছে সেইসব বদমাইশির উপজাত কর্মগুলো। বিশ শতকে তিনের দশকেও এই ধরনের সাহিত্য সম্পর্কিত শয়তানি হয়েছিল। নবোত্থিত সাবেক বাঙালি মুসলিম সাহিত্যিক বর্গ সে সবের জওয়াব দিয়েছিলেন সঙ্গতভাবে ব্যাপক ক্ষমতাধর পত্রপত্রিকায়।
জাহানারার ছোট বোন রৌশনারাও আদব-কায়দায় মুঘল প্রাসাদের মহিয়সী মহিলা। রাজনীতিতে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। মহান সম্রাট আওরঙ্গজেব বহুবিধ বিসয়ে রৌশনারার সঙ্গে শলা-পরামর্শ করতেন। মেহেরউন নিসা (কাজি রুকুনউদ্দিনের ভ্রাতৃবধূ) রৌশনারার শিক্ষিকা ছিলেন। মেহেরউন নিসার জ্ঞান ও কোমল ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে আরজুমন্দ বানু বেগম তাঁর কন্যার অভিভাবিকা নিয়োগ করেন। সম্রাট শাহজাহানের অন্যতম কন্যা জোবিন্দা বেগমও গুণবতী মহিলা। তৈমুরীয় খানদানের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য এই সুকন্যাবর্গ নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ ছিলেন। এঁরা ছিলেন আভিজাত্যের প্রতীক।
রৌশনারার নির্মল জীবনযাপন, পরার্থপরতা, এতিম-মিশকিনদের প্রতি দয়া তাঁকে সম্মানিতা ব্যতিক্রমী নারীত্বে রূপান্তরিত করেছিল। বিশ শতকের সাত অার আট দশকে কলকাতা কেন্দ্রিক কিছু নগণ্য কলমচি রৌশনারার চরিত্র হনন করে উপন্যাস লেখায় মত্ত ছিল। নরক গুলজার-এ কেউ কেউ আনন্দ পেয়ে থাকে। যথার্থ ইতিহাসবর্জিত এই সব কল্পকাহিনী সামাজিক সম্পর্ক ন্থাপনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
হিন্দুস্তান-এর সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা আর সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের বিশিষ্টতা সম্পর্কে দারা-শিকোহ-ও একটি শুভবোধসম্পন্ন ধারণা ছিল। ইসলামি সহনশীলতার তিনি এক প্রত্যক্ষ প্রতীক। তাঁর সম্মানিতা স্ত্রী বেগম নাদিরা অশেষ গুণমানসম্পন্না মহিলা হিসেবে পরিচিতা ছিলেন। শুধুমাত্র ইসলামি আদর্শ সম্পর্কে তিনি আগ্রহী ছিলেন তা নয়- এতদ্দেশীয় আচার-আচরণ, সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কেও তাঁর স্বচ্ছ ধারণা ছিল। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কেও তিনি পরিচিত ছিলেন। এই কৃতিত্ব অবশ্য তাঁর জীবনসঙ্গী দারা-শিকোহ-র প্রাপ্য। যুবরাজ দারা তাঁকে অশেষে ভালবাসতেন। প্রিয়তমা পত্নীকে দারা-শিকোহ চিত্র শিল্পকলার যে ‘অ্যালবাম’টি তোহফা হিসেবে দিয়েছিলেন, তা এখন লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে রয়েছে। বেগম নাদিরা ফার্সি ভাষার সমঝদার এবং একজন কবি হিসেবে পরিচিত আর মান্যতা পেয়েছিলেন। প্রিন্স দারার জ্ঞানসাধনার তিনি প্রেরণাদাত্রী হিসেবে ইতিহাসে স্বীকৃত। আফশোসের কথা খুব অল্প বয়সেই তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন।
প্রিন্স দারা আর বেগম নাদিরার দুহিতা, জঁহানাজ বেগম যোগ্য পিতা-মাতার যোগ্য সন্তান। মায়ের মতোই তিনি বিদূষী মহিলা ছিলেন। শাহজাদা আযমের সঙ্গে ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। জাহানারার তত্ত্বাবধানে মুঘল সংস্কৃতির ছায়ায় তিনি লালিত হয়েছিলেন। দার্শনিক-সুফি তাত্ত্বিক পিতা আর গুণবতী মাতার গুণগুলোও তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল। যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিনী ছিলেন। ফার্সি ভাষায় সাহিত্য চর্চা করতেন। তাঁর রচনার অলংকার চমকপ্রদ। পিতার মতো তিনিও জ্ঞানার্জনে আন্তরিক ছিলেন।
দরবেশ-বাদশাহ আওরঙ্গজেবের প্রথমা স্ত্রী দিলারা বানুর কন্যা জেবউন নিসা বেগম মুঘল রাজকীয় প্রাসাদের একটি অত্যুজ্জ্বল নাম। মুঘল হারেমের মহীয়সী মহিলাদের মধ্যে তাঁর স্থিত স্থান চতুর্থ। নূরজাহান, জাহানারা, রৌশনারার পর যদি কারো নাম হীরক খণ্ডে লিখিত হয়, তবে তিনি হলেন জেবউন নিসা। ফার্সি আর আরবি সাহিত্যে তাঁর বিস্ময়কর স্থান ও প্রতিভা, সৃজনশক্তি প্রায় অতুল্য। জেবউন নিসার ‘দিওয়ান’ আজও উর্দু-ফার্সি ভাষাভাষি মহলে ব্যাপক পঠিত, আলোচিত আর বিশ্লেষিত হয়ে তাকে। ‘দ্য ইলাসট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া’-র সম্পাদনা কালে প্রখ্যাত সাংবাদিক-সাহিত্যিক খুশবন্ত সিং জেবউন নিসার ‘দিওয়ান’-এর ইংরেজি আনুবাদ বহু আলোচনায় ব্যবহার করেছেন। বস্তুত জেবউন নিসা আজও সংশ্লিষ্ট মহলে সমানভাবে আধুনিক। তাঁর ‘ক্যালিগ্রাফিক আর্ট’ বিষয়ে অনুপম দক্ষতা দৃষ্টি আকর্ষক হয়ে উঠেছিল। বহুবিধ বিষয়ে নানা গ্রন্থ তিনি সংগ্রহ করেছিলেন, তাঁর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে রক্ষিত ছিল। বাদশাহ আওরঙ্গজেব তাঁর এই বিদূষী কন্যাকে প্রাণাধিক স্নেহ করতেন। মনীষী পিতার সম্মান বৃদ্ধিকারী কন্যা জেবউন নিসা।
ধর্মীয় জীবনে তিনি পিতার কাছ থেকে যথেষ্ট আদেশ, উপদেশ গ্রহণ করতেন। ইসলামি জীবনাদর্শ এবং পদ্ধতি সম্পর্কে সম্রাটের সঙ্গে কন্যার আলাপ-আলোচনার তথ্যও রয়েছে। পবিত্র কুরআন ছিল তাঁর পুরো মুখস্থ। প্রয়োজনবোধে পবিত্র কুরআনের যে কোনও অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি দিয়ে বান্ধবীদের চিঠিপত্র লিখতেন। মুল্লাহ সৈফুদ্দিনের মতো আরও অনেক কবি-সাহিত্যিক জেবউন নিসার দ্বারা উৎসাহিত আর পুরস্কৃত হতেন। তিনি ‘ম্যাকফি’ এই ছদ্মনামে কবিতা-মসনভি চর্চা করতেন। পিতার মৃত্যুর পাঁচ বছর আগে ১৭০২ খ্রিস্টাব্দে জীবনপ্রদীপ নির্বাপিত হয়ে যায়। আওরঙ্গজেব জীবনের শেষ পাদে এসে এই গভীর বেদনা নীরবে বহন করেন। তাঁর মৃত্যুতে মুঘল হারেম একজন উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন আরবি-ফার্সি ভাষার কবি এবং দরিদ্র সাহিত্যিক বর্গ হারিয়েছিল তাঁদের পরম শুভানুধ্যায়ী এক মহান মহিলাকে।
জেবউন নিসার আদেশে এবং পরামর্শে সৈফুদ্দিন আল বেলি ‘Zaib-ut-tafsir’ রচনা করেছিলেন। ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ মন্তব্য করেছিলেন, ‘Diwan-I-Makhfi is a noble monument of her genius’. জেবউন নিসার জীবনের উপর নির্ভর করে গত শতকের নানা সময়ে মিথ্যাচারপূর্ণ কিসসা কাহিনী তৃতীয় শ্রেণির কলমচিদের দ্বারা তৃতীয় শ্রেণির পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেসব কথা উপেক্ষনীয়।
মহান সম্রাট আওরঙ্গজেবের অন্য কন্যাদ্বয় বদরুন্নিসা, জিন্নাতউন্নিসা, প্রথম বাহাদুর শহারে স্ত্রী নূরউন নিসা এবং শেষ ‘বদনসীব’ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর (১৮৩৭-৫৮: শাসনকাল)-এর স্ত্রী বেগম জীন্নতমহল মুঘল প্রাসাদের বিশেষ উল্লেখযোগ্য নাম। বেগম জীন্নত আত্মমর্যাদা আর স্বদেশপ্রেমিকা, তেজস্বনী মহিলা। সিপাহি বিদ্রোহে তিনি প্রত্যক্ষ অংশ নিয়েছিলেন। মুঘল আমলে নারী ক্ষমতায়ন আর প্রতিভা বিকাশের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল- এ তারই ঐতিহাসিক নজির বহন করে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct