মেধা ও অধ্যাবসায় থাকলে আর্থিক বাধা যে মানুষের জীবনে প্রগতির অন্তরায় হয় না এই আপ্তবাক্যকে বাস্তবে পরিণত করেছে রাকিবা সুলতানা। হ্যাঁ এমনটাই সত্যি। পূর্ণিমা রাতে টালির ঘরের এক চিলতে ফুটো দিয়ে যেমন ঝিকমিকি প্রবেশ করে আলো। সেই আলো এঁকে দেয় রঙিন পথরেখা, ঠিক তেমনি নুন আনতে পান্তা ফুরোনো পরিবারে ও ছিল একটা স্বপ্ন। প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসে স্নাতকোত্তর পাশ অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে দীনমজুর আব্বাস আলি গাজী মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। তার মনের অতৃপ্ত বাসনা পিছিয়ে পড়া দরিদ্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে মেয়ে ডাক্তারি পড়ুক। হ্যাঁ বাবার সেই স্বপ্ন আজ সফল হতে চলেছে। পথ কিন্তু এতটুকুও সহজ ছিল না। জীবন যন্ত্রণার বাস্তব ছবি এখনও রাকিবা সুলতানার মুখে ফুটে ওঠে।
রাকিবা সুলতানা দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার মগরাহাট থানার অন্তর্গত ডিহি কলসের বাসিন্দা মহ. আব্বাস আলি গাজীর কন্যা। গ্রামের স্কুল থেকে প্রাথমিকের পাঠ এবং কলস হাইস্কুল থেকে ২০১২ সালে প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পাশ করে। না আছে বই না আছে টিউশনি আছে শুধু জেদ। নজর এড়ায়নি আল আমিন মিশনের। সামান্য খরচে পড়াতে রাজি হয় মিশন কর্তৃপক্ষ। আল আমিন মিশনের রামপুরহাট শাখা থেকে রাকিবা সুলতানা ২০১৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে আশি শতাংশ নম্বর সহ। ডাক্তারি পড়ার অদম্য ইচ্ছা জাগে ওর মনে। হতদরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা রাকিবার এটা ছিল আরেকটি চ্যালেঞ্জ। মিশন কর্তৃপক্ষ ও পরিবার ওর প্রতি আস্থা রেখেছিল। মিশনের সাঁত্রাগাছি সেন্টার থেকে শুরু হয় কোচিং ক্লাস। প্রথম দুবার তেমন সাফল্য না পেলেও ২০১৭ সালে রাজ্য স্তরে এগারশো এবং ওবিসি তালিকায় ঊনসত্তর তম স্থান দখল করে রাকিবা। ভর্তি হয় উত্তর ২৪ পরগনার সাগরদত্ত মেডিকেল কলেজে। রাকিবা সুলতানা এখন ডাক্তারির প্রথম বর্ষ পাশ করে দ্বিতীয় বর্ষে উঠল। রাকিবা সুলতানা ছাড়াও ওর বাবার পরিবারে আরও চার ছেলে। ওর পড়ার খরচ জোগাড় করতে প্রতিদিন হিমশিম খাচ্ছেন বাবা । বাবার কষ্ট দেখে সংসারের হাত ধরেছে মেজ দাদা। বোন ডাক্তার হবে এই স্বপ্নে মেজদা শাহরিয়ার হোসেন বাধ্য হয়েছে দর্জির কাজ করতে। মগরাহাট কলেজে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে উঠলেও আর পড়া হয়নি। বড় দাদা ইস্তেকার হোসেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা আজাদ কলেজ থেকে এবছর জুওলজিতে অনার্স পাশ করে। দারিদ্র্যতার জন্য ওরও আর পড়া হলোনা। কিন্ত খেদ নেই মনে। রাকিবার বাবার মতো একজন দীনমজুর মানুষের পক্ষে এতবড় পরিবার সামলানো ও পড়ার খরচ জোগাড় করা যে অত্যন্ত কষ্টকর সেকথা বলা বাহুল্য। আব্বাস আলি গাজীর কথায়, আমি তো তেমন কিছু করতে পারিনি। মেয়ে ডাক্তারি পড়ছে এতেই আমার আনন্দ। ছেলেদের স্বভাব ও বোনের প্রতি দরদ দেখে তিনিও মাঝেমাঝে অবাক হন। এমন কথাও শোনা গেল রাকিবার মা লালবানু বিবির কণ্ঠে। অষ্টম শ্রেণি পাশ লালবানু বিবি বুঝেছেন মুসলিম মহিলাদের বিভিন্ন গোপন রোগ বা মাতৃত্বকালীন সময় ইজ্জত আব্রু রক্ষার জন্য মহিলা ডাক্তার কতোটা প্রয়োজন। তিনি চান রাকিবা প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞ হোক। হ্যাঁ বাবা মার স্বপ্ন পূরণ করতে চান রাকিবা সুলতানাও।হাজার বাধা অতিক্রম করে এগোচ্ছে মেয়েটি।
কৃতজ্ঞতা: পুবের কলম
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct