প্রায়শ কিডনির সমস্যার কথা শোনা যায় একটু কা পাতলেই। কিডকে সুস্থ না রাখলে শারীরিক সমস্যা কিছুতেই মেটানো সম্ভব নয়। তাই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অন্ত্রাঙ্গ কিডনিকে সবসময় যত্ন নেওয়ার কথা বলে থাকেন ডাক্তাররা। কারণ কিডনি খারাপ হয়ে গেলে প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু কিডনি জোগাড় করা খুবই মুশকিল। কারণ, কিডনি বিক্রি করা অপরাধ। দাই কিডনি দাতাকে খুঁজে বের করতে হিমশিম খেতে হয়। নানা কারণে কিডনি খারাপ হয়। যদি দুটো কিডনিরই কার্যকারিতা নষ্ট হতে থাকে তখন তাকে ক্রনিক বা ধীরগতিতে কিডনি ফেইলুর (Kidney Failure) বলা হয়। একটি কিডনি সম্পূর্ণ সুস্থ থাকলে এবং অপরটির কার্যকারিতা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেলেও সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব। দুটো কিডনিরই শতকরা ৫০ ভাগ বিনষ্ট হলেও শরীর সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকে, যার ফলে একজন সুস্থ মানুষ (কিডনি ডোনার – Kidney Donor) তার নিকট আত্মীয় বা অন্য আর একজন কিডনি বিকল রোগীকে (কিডনি গ্রহণকারী) একটি কিডনি দান করেও সুস্থ থাকেন, স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন। কেবল দুটো কিডনির ৫০ ভাগের উপর নষ্ট হলেই কিডনি বিকল হওয়ার প্রবণতা শুরু হয় এবং ৭৫ ভাগ নষ্ট হলেই শরীরের লক্ষণগুলো ধরা যেতে পারে আর ৯৫ ভাগের উপর নষ্ট হলে কৃত্রিম উপায়ে (ডায়ালাইসিস বা কিডনি সংযোজন) ছাড়া রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয় না, যাকে বলে এন্ড স্টেজ রেলাল ফেইল্যুর (End Stage Renal Failure)।তাই ডাক্তাররা সর্বদাই সতর্ক করে থাকেন, খেয়াল রাখা দরকার দীর্ঘ রোগে যেন কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়ার প্রাথমিক কিছু কারণ বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বলে থাকেন। তার মধ্যে অন্যতম হল:
১. গ্লোমেরুলো নেফ্রাইটিস বা কিডনির ছাকনি প্রদাহ রোগ ৫০-৫৫%। ২. ডায়াবেটিসজনিত কিডনি রোগ ১৫-২০%। ৩. উচ্চ রক্তচাপজনিত কিডনি রোগ ১০-১৫%। ৪. কিডনি বা প্রস্রাবের রাস্তায় পাথর ও অন্য কোনো কারণে বাধাজনিত রোগ ৭-১৯%। ৫. কিডনি বা প্রস্রাবের রাস্তায় জীবাণুজনিত রোগ ৫-৭%। ৬. বংশানুক্রমিক কিডনি রোগ ৩-৫%। ৭. ওষুধজনিত কিডনি রোগ ৩-৫%। ৮. অন্যান্য ও অজানা।
কিডনি নষ্ট হওয়ার উপসর্গ অনেক সময় আমরা দেখে থাকি। কিন্তু তাকে আমরা সহজেই আমল দিই না। যে যে উপসর্গ দেখলে বোঝা যায় কিডনি খারাপের পথে সেগুলি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। সাধারণত শতকরা ৭৫ ভাগের উপর কিডনি অকেজো হয়ে গেলে রোগীর ক্ষুধা মন্দা, আহারে অনীহা, বমি বমি ভাগ, বমি হওয়া, শরীর ক্রমান্বয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, শারীরিক দুর্বলতা প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দেয়। এছাড়াও প্রস্রাবের পরিমাণের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, রাতে প্রস্রাব করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। রোগী শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেলে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট, তীব্র গতিতে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস, ঝিমানো ভাব, এমনকি এক পর্যায়ে রোগী জ্ঞানও হারিয়ে ফেলতে পারে।দু টো কিডনির শতকরা পঁচাত্তর ভাগ কার্যকারিতা নষ্ট না হওয়া পর্যন্ত কিডনি বিকলের উপসর্গ দেখা যায় না। রোগী প্রাথমিক পর্যায়ে সামান্য ধরনের কিডনি রোগ থাকার দরুন গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে না।
কিডনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তা নির্ণয় করা যেতে পারে বিভিন্ন যায়াগনস্টিক পরীক্ষা-নিরীক্ষণ করে। ক্রনিক রেনাল ফেইলুর (Chronic Renal Failure) রোগ নির্ণয়ের জন্য রোগীর উপসর্গের ইতিহাস, শারীরিক পরীক্ষা ছাড়াও প্রাথমিকভাবে রক্তের ইউরিয়া (Serum Urea), ক্রিয়েটেনিন (Serum Creatinin) এবং ইলেকট্রোলাইট (Electrolyres)পরীক্ষা করা হয়। কিডনির কার্যকারিতা কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্তের ইউরিয়া, ক্রিয়েটেনিন বেড়ে যায়। পটাশিয়ামের পরিমাণ বাড়তে থাকে ও বাইকার্বোনেট কমে যায়। এছাড়াও ফসফেট শরীরে জমতে শুরু করে, যার ফলে ক্যালসিয়াম কমে যেতে বাধ্য হয় এবং অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও শুরু হতে থাকে। এরপরে কি কারণে ধীরগতিতে কিডনি বিকল হয়েছে তা বের করার জন্য প্রস্রাব পরীক্ষা করে এ্যালবুমিন (Albumin) আছে কিনা তা দেখা হয় এবং লোহিত ও শ্বেত কণিকা আছে কিনা তাও দেখে নেয়া হয়। প্রয়োজনের ২৪ ঘণ্টার প্রস্রাবের প্রোটিনের পরিমাণও দেখা হয়। প্রস্রাবে এ্যালবুমিন ২৪ ঘণ্টায় এক গ্রামের বেশি হলে প্রাথমিকভাবে কিডনি ফেইলুরের কারণ হিসেবে গ্লোমারুলোনেফ্রাইটিস ধরে নেয়া হয়। দুটো কিডনিতে যদি অনেকগুলো সিস্ট থাকে তাহলে বংশানুক্রমিক কিডনি রোগ বা পলিসিসটিক কিডনি ডিজিজ (Polycystic Kidney Disease) ভাবা হয়। এছাড়া পাথরজনিত কারণে বা প্রোস্টেটজনিত জটিলতায় কিডনি বিকল হলো কিনা তাও আলট্রাসনোগ্রাম ও এক্স-রের মাধ্যমে ধরা যেতে পারে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াও কিডনি বিকল রোগীদের হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস, সি-ভাইরাস, এইডস (AIDS) ভাইরাস আছে কিনা তাও দেখা প্রয়োজন। বুকের এক্স-রে, ইসিজি রক্তের হিমোগ্লোবিন, ব্লাড গ্রুপ, এইচএলএ টিস্যু এন্টিজেন এসব পরীক্ষাও বিশেষ ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়।
কিডনির চিকিত্সা ও প্রতিকার সম্ভব। তবে তা নির্ভর করে কতটা খারাপ কিডনি। কিডনি অকেজো রোগীর চিকিত্সা নির্ভর করে কি কারণে এবং কত পরিমাণে কিডনির কার্যকারিতা নষ্ট হয়েছে তার উপর। কেননা এমন অনেক কারণ রয়েছে যেগুলোকে আমরা সঠিক চিকিত্সার মাধ্যমে ভালো করে দিতে পারি, যেমন বাধাজনিত কিডনি রোগ। আবার কিছু কারণ আছে ভালো করা না গেলেও কিডনি আরো বেশি অকেজো না হয়ে যায় তার ব্যবস্থা নিতে পারি, যেমন উচ্চরক্তচাপ। অবশ্য যে কোনো কারণেই হোক না কেন দুটো কিডনির শতকরা ৯৫ ভাগের উপরে যদি নষ্ট হয়ে যায় তখন কোনোভাবেই কিডনির কার্যকারিতা ফেরানো সম্ভব হয় না। আর এসব ক্ষেত্রেই প্রয়োজন পড়ে ডায়ালাইসিস বা কিডনি সংযোজনের মাধ্যমে চিকিত্সার ব্যবস্থা করা। উল্লেখিত দু ধরনের চিকিত্সাই অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct