কবি কাজী নজরুল ইসলাম যে সাম্যবাদী আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন তা তার লেখনীতে তুলে ধরেছেন। তিনি যে একজন প্রকৃত সাম্যবাদী কবি ছিলেন, তার প্রতিফলন আমরা তার কবিতা-গানে দেখতে পাই। কবির মন ছিল অত্যন্ত কোমল মানুষের সামান্যতম দুঃখ কষ্টকেও তার হৃদয়ে বেদনার রেখাপাত করে গেছে। যা আমরা কবির লেখা পাঠ করলে সহজেই অনুধাবন করতে পারি। চরম দরিদ্রতা তাকে কষাঘাতে নিষ্পেষিত করেছে বলেই কী তিনি নিজেকে এই ঘুনে ধরা সমাজ থেকে মুক্তির আহ্বান জানিয়েছেন? হয়তো তাই। তা না হলে তিনি তার কবিতায় কী সহজেই এভাবে সমাজের কুলি মজুরদের নিয়ে তাদের ওপর নিযার্তনের যে রেখাচিত্র তুলে ধরেছেন তা কী তিনি পারতেন? হয়তো পারতেন। তার পরেও বলব তিনি জীবনকে, সমাজকে আপন আয়নার দেখেছেন আর ছবির মতো করে তুলে এনেছেন তার একের পর এক কবিতায়।
কৈশোরেই নজরুলের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার ভিত্তি গড়ে ওঠে, যা পরবতীের্ত তাকে সাম্যবাদী হতে পথ মসৃণ করে দেয়। ‘রাণীগঞ্জে নজরুলের শৈলেন্দ্রকুমার ঘোষ নামে একজন প্রিয় বন্ধু জুটেছিলেন। নজরুল ইসলাম মুসলমান, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় হিন্দু-ব্রাহ্মণ, আর শৈলেন্দ্রকুমার ঘোষ খ্রিষ্টান। তিন বন্ধু একসঙ্গে খেলাধুলা করতেন, একসঙ্গে বেড়াতেন। এই যে তিন ধমের্র তিন বন্ধু একত্রে মেলামেশার কারণেই নজরুলের ভেতর সেই কৈশোর থেকেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা গেড়ে বসেছে। পরবতীের্ত তারই প্রতিফলন, তাকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত করেছে।
দ্রারিদ্র্যের কারণেই তিনি ব্রিটিশ পরিচালিত ঊনপঞ্চাশ নম্বর বেঙ্গলী রেজিমেন্টের সৈনিক হিসেবে করাচী সেনানিবাসে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। তার সৈনিক জীবনই তাকে মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সেখানেই তিনি কাজের অবসরে বসে বসে কাব্যচচার্ শুরু করেন। রুশ বিপ্লবের সময় সারা দুনিয়ার যখন সবর্হারার জয়গান সমুচ্চারিত হতে থাকে, ঠিক তখনই কবি নজরুলকেও তা নাড়া দিয়ে যায়। দোল খায় তার মনেও, আর তখনই নজরুল লিখে ফেললেন :
‘সিন্ধুপারের সিংহদ্বারে ধমক হেনে ভাঙল আগল।’
এই কবিতা দিয়েই নজরুল তার সাম্যবাদী আদশের্র জানান দেন বলেই ধরে নেয়া যায়। আমরা তার প্রথম প্রকাশিত এই কবিতার দিকে তাকালে দেখতে পাই তার ‘মুক্তি’ কবিতাটিই তার সাম্যবাদী চেতনার স্ফুরণ ঘটিয়েছে। নজরুল তার মুক্তি কবিতাটি ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির দফতরে পাঠান। সেই সুবাদেই বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সংগঠক মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ও পরিচয় হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মুজফ্ফর আহমদের পরামশের্ই নজরুল সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেন। নজরুল কমরেড মুজফ্ফর আহমদের সাহচযের্ এসেই আরও বেশি সাম্যবাদী আদশের্র দিকে ঝঁুকে পড়েন। তখন থেকেই সাম্যবাদী চিন্তার প্রকাশ পুরোদমে ঘটে নজরুলের লেখায়। নজরুল কতৃর্ক প্রকাশিত ও পরিচালিত ‘ধূমকেতু’, ‘লাঙল’, ‘নবযুগ’, ‘গণবাণী’ প্রভৃতি পত্রপত্রিকা হয়ে ওঠে সাম্যবাদী চিন্তার মুখপত্র। ১৯২২ সালের ১২ই আগস্ট নজরুলের একক চেষ্টায় প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’। ‘ধূমকেতু’ রাজনৈতিক কাগজ হিসাবে প্রকাশিত হতে থাকে। নজরুলই এ কাগজটির নামকরণ করেন।
১৯২৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর মুজফ্ফর আহমদ লেবার স্বরাজ পাটির্র মুখপত্র হিসাবে সাপ্তাহিক ‘লাঙল’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। কাজী নজরুল ইসলামকে ‘লাঙল’-এর প্রধান পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। ‘লাঙল’ এর প্রথম সংখ্যাতেই নজরুল ‘সাম্যের গান’ নামের কবিতাটি লিখলেন:
গাহি সাম্যের গান।
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।
।গাহি সাম্যের গান!
কে তুমি পাসির্? জৈন? ইহুদি? সঁাওতাল, ভিল, গারো?
কন্ফুসিয়াস্? চাবার্ক চেলা? বলে যাও, বলো আরো!
।বন্ধু, যা খুশি হও,
পেটে পিঠে কঁাধে মগজে যা খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরআন-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক।
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব পড়ে যাও, য্ত সখ
কিন্তু, কেন এ পÐশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর কষাকষি? পথে ফুটে তাজা ফুল!
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখ নিজ প্রাণ!
‘গণবাণী’তেই নজরুল ১৯২৭ সালে মে দিবসে শ্রমজীবীদের আন্তজাির্তক সংগীত বা ‘ইন্টারন্যাশনাল’ গানের বঙ্গানুবাদ করেন। গানটি ফরাসি শ্রমিক কবি ইউজিন পাতিয়ের রচিত। এই গানটি এখনো সারা বিশ্বের কমিউনিস্টরা তাদের দলীয় সংগীত হিসেবে গেয়ে থাকেন। নজরুল অনুবাদটির নাম দিয়েছিলেন ‘অন্তর ন্যাশনাল সংগীত’। সাম্যবাদী এ কবি পরবতীর্কালে তিনি একের পর এক লেখেন, ‘শ্রমিকের গান’, ‘লাল পতাকার গান’, ‘ধীবরের গান’ ইত্যাদি শ্রমজীবী অংশের মানুষের শ্রেণি চেতনার গান। মাকর্সীয় চেতনার গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে নজরুলের ‘সাম্যবাদী’ ও ‘সবর্হারা’ কবিতায়। ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে মেহনতী মানুষের হৃদয়ের বেদনার কথা।
সাম্যবাদীরাই অসম্প্রদায়দিক তাইতো কবি নজরুলও ছিলেন অসা¤প্রদায়িক চেতনার এক মূতর্ প্রতীক। তিনি মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ খঁুজে পাননি। তার কাছে কোন জাত পাত ছিল না। সকল মানুষকে শুধু মানুষ পরিচয়ে তিনি দেখতে চেয়েছেন। তাই তিনি কবিতায় বলেছেন :
‘সকল কালের সব দেশের সব মানুষ আসি
এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শুন এক মিলনের বাঁশি।’
নজরুলের অনেক কবিতায় সাম্যবাদের উচ্চকিত উচ্চারণ ধ্বনিত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম কবিতাগুলো হলো।সাম্যবাদী, সাম্য, প্রলয়োল্লাস, বিদ্রোহী, কান্ডারী হুঁশিয়ার, সবর্হারা, কুলি-মজুর, সাম্যের গান, মানুষ, আনন্দময়ীর আগমনে, কামাল পাশা, আনোয়ার পাশা, ভাঙার গান, বন্দি বন্দনা, রণভেরী, আত্মশক্তি, মরণ বরণ, বন্দনাগান, আগমনী, ধুমকেতু, ধীবরদের গান, ঈশ্বর, কৃষাণের গান, দীপান্তরের বন্দিনী, শ্রমিকের গান, মুক্তিসেবকের গান, ছাত্রদলের গান, সাবধানী ঘণ্টা, উদ্বোধন, ইত্যাদি।
নজরুলই প্রথম কবিতায় ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণা করলেন। প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন সকল অন্যায় শোষণ আর নিযার্তনের বিরুদ্ধে। তাই তিনি তার ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় উচ্চকিত উচ্চারণ করলেন।
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল-বোশেখীর ঝড়।
নজরুলের অসা¤প্রদায়িক চেতনার মূল অংশ জুড়ে আছে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’।এ মমর্বাণী। তিনি বিশ্বাস করতেন হিন্দু হোক, মুসলমান হোক, বৌদ্ধ হোক, খ্রিস্টান হোক।নিপীড়িত মানবতার একটাই পরিচয়, তারা শোষিত বঞ্চিত মানুষ। আর তার কলম সব সময় শোষিত লাঞ্ছিত নিপীড়িত মানুষের জন্য সোচ্চার ছিল। গজের্ উঠেছে নানা মাত্রিকতায়, যা সমসাময়িক অন্য কবিদের চাইতে ভিন্নমাত্রায় বিচার করা যায়। নজরুলের সাম্যবাদী ভ‚মিকার জন্যই সে সময় তিনি সমধিক পরিচিতি লাভ করেন। কারণ, তিনি মানুষের শোষণকে, নিযার্তনকে সরাসরি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। কবিতায় মানবিকতার দিকপাল কাজী নজরুল তাইতো উদাত্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন।
দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুবর্ল!
মানবতাবাদী নজরুল ছিলেন অসা¤প্রদায়িক মানবতাবাদী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ। তিনি অনুভব করেন মানবধমের্ক, মানুষকে, মানবীয় চেতনাকে, তাই সাম্যবাদই তার কাছে প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে, কবিতায় প্রস্ফুটিত হয়েছে বারংবার। দেশ-জাতি-মাতৃভ‚মিকে নজরুল মানবপ্রেমের সঙ্গে দেশপ্রেমকে মিশিয়েছেন, মাতৃভ‚মিকে মা’র সাথে তুলনা করেছেন। তাইতো জাতিকে নিয়ে তার উচ্চকিত উচ্চারণ।
‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,
কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!
‘‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?” ঐ জিজ্ঞাসে কোন্ জন?
কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।
তবে নজরুলের সাম্যবাদী কবিতার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত তার বিদ্রোহী কবিতা, যা অনস্বীকাযর্। এ ছাড়াও সাম্যবাদী নজরুলের নিচের কবিতাটি সাম্যবাদের আরেকটি চমৎকার দৃষ্টান্ত :
‘গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।’
অবার দেখা যায়।
‘গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধমর্-জাতি
সব দেশে-সবকালে, ঘরে ঘরে মানুষের জ্ঞাতি।’
‘হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ’ কবিতায় হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার চিত্র উঠে এসেছে অবলীলায়।
‘মাভৈ! মাভৈ! এতদিনে বুঝি জাগিল ভারতে প্রাণ,
সজীব হইয়া উঠিয়াছে আজ শ্মশান-গোরস্তান!
ছিল যারা চির-মরণ-আহত,
উঠিয়াছে জাগি’ ব্যথা জাগ্রত,
‘খালেদ’ আবার ধরিয়াছে অসি, ‘অজুর্ন’ ছেঁাড়ে বাণ।
জেগেছে ভারত, ধরিয়াছে লাঠি হিন্দু-মুসলমান।
মরে হিন্দু, মরে মুসলিম এ উহার ঘায়ে আজ,
বেঁচে আছে যারা মরিতেছে তারা, এ মরণে নাহি লাজ।’
নজরুল তার শেষ ভাষণে উল্লেখ করেছেন : ‘কেউ বলেন আমার বাণী যবন কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনোটাই না। আমি শুধু হিন্দু মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।’
এ থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায় কালজয়ী বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার কবিতায় প্রেম, মানবতা, দ্রোহ সবকিছুকে ছাড়িয়ে তিনি যে একজন খঁাটি দেশপ্রেমিক সাম্যবাদী ছিলেন তা সহজেই অনুমেয়। যদিও একটি গোষ্ঠী নজরুলকে দ্বিখণ্ডিত করতে চেয়েছেন, একদল বলেছেন, নজরুল মুসলমানের কবি, আর একদল বলেছেন নজরুল হিন্দুদের কবি। প্রকৃতপক্ষে তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূতর্ প্রতীক। তিনি ছিলেন সাম্যের কবি। সাম্যবাদী কবি। বাঙালির প্রাণের কবি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct