সমকালীন ইংরেজি সাহিত্যের একজন আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ লেখক ভিএস নাইপল৮৫ বছর বয়সেপরলোকগমন করেন গত ১১ আগস্ট। দীঘির্দন থেকে তিনি ভুগছিলেন পারকিনসন্স রোগে। কথাসাহিত্যিক হিসেবে তার গল্প বলার ভঙ্গিই আলাদা। সাহিত্যে তার স্বতন্ত্র ও উজ্জ্বল কণ্ঠস্বরই তাকে বিশ্ব সাহিত্যে আলাদা মযার্দা দিয়েছে। তার পূবর্পুরুষরা ছিলেন ভারতের গাঙ্গেয় সমভ‚মির কোনো এক জনপদের সন্তান। পূবর্পুরুষ ভারতীয় হলেও তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন ১৯৩২ সালে ১৭ আগস্ট দক্ষিণ আমেরিকার কাছাকাছি ক্যারিবীয় অঞ্চলের এক ছোট্ট দ্বীপে, যার নাম ত্রিনিদাদ। চাগুয়ানা নামে এক ছোট্ট মফস্বল শহরে নানাবাড়িতে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। তার পিতা ভারতীয় নাগরিক এবং একজন লেখক ও সাংবাদিক ছিলেন। ভিএস নাইপল অক্সফোডর্ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। লেখাপড়া শেষে তিনি লন্ডনেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। তার বাবার কাছ থেকেই তিনি লেখালেখির অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। জীবনের নানা প্রতিক‚লতা পেরিয়েছেন তিনি। বলা হয়ে থাকে, নাইপল এমন একজন মানুষ যার কোনো দেশ নেই। ৩০টি গ্রন্থের জনক তিনি। লিখেছেন ফিকশন, নন-ফিকশন, ভ্রমণ কাহিনী ও সমাজ সচেতনতামূলক না লেখা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি ইসলামকে কটাক্ষ করে লিখেছেন। এ ব্যাপারে তার মন্তব্য, আমি লিখেছি ধমার্ন্তরিত মানুষের ওপর। ইসলাম আদতে উৎসের দিক থেকে আরবদের ধমর্। সেই সব মুসলমান যারা আরব নয়, পরে ধমার্ন্তরিত হয়ে তাদের পশ্চাৎ সংস্কৃতিতে ফিরেছে, ফিরেছে তাদের অতীত বিশ্বাস-সভ্যতায়। তবে তারা কিছুটা বিভ্রান্ত, কারণ বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে তারা এখনো উপনিবেশিক মানসিকতার অধিকারী।
নাইপল ছিলেন বহুবণির্ল অভিজ্ঞতার অধিকারী। তার ছিল অনুসন্ধিৎসু মন। দেশ ও মানুষ সম্পকের্ জানার প্রবল আগ্রহ। সে কারণেই তিনি ইরান ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান ভ্রমণ করেছেন। অনারব বা ধমার্ন্তরিত মুসলমানদের নিয়ে লেখা দুটি ভ্রমণকাহিনী নাইপল সম্পকের্ বিরাট বিতকর্ সৃষ্টি করে। অজির্ত অভিজ্ঞতাকে লেখার রশদ হিসেবে নিয়েছেন। সমার সেট মম, আইজাক বাশেভিস সিঙার, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন ভ্রমণপিপাসু।
শিল্প বিপ্লবোত্তর ইউরোপে নতুন সমাজ বিনিমাের্ণ উপন্যাসের ভ‚মিকা কতখানি ছিল সেটা নিয়ে তিনি ভেবেছেন। তা সত্তে¡ও বালজাক, ডিকেন্সের মতো লেখকরা নতুন পৃথিবীতে বসবাসকারীদের জন্য উপহার দিলেন নতুন ফমর্ এবং বৃহত্তর গল্পের পরিসরে তা প্রকাশ পেল। তার মতে, তখন থেকেই উপন্যাস সত্য অনুধাবনের শ্রেষ্ঠ বাহন হয়ে দঁাড়ালো। তিনি মনে করেন সত্যের প্রতীক হিসেবে বই-ই টিকে থাকবে, যেগুলো প্রকৃত সত্য।
যারা আমার লেখা পড়েন, তারা নিজেদের দেখতে পান। নৈতিক মূল্যবোধের প্রতি আত্মিক-সমথর্ন ছাড়া কেউ ভালো লিখতে পারবে না। কোনো বিশেষ মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে কুসংস্কার মুক্ত হয়ে লিখতে হবে। কোনো লেখকের নৈতিক আদশের্র প্রকৃত ভিত্তি এটাই। সত্য ও উদারতা এই দুটো শব্দের প্রতি তিনি বরাবর জোর দিলেও, তার লেখার মধ্যে ধমীর্য় সংকীণর্তা ফুটে উঠেছে বলে অভিযোগ রয়েছে, তিনি নারীদেরও উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখেননি ও মূল্যায়ন করেননি।
বাস্তুচু্যুত, সংস্কৃতি বিচ্ছিন্ন নিরণœ দাসত্বের নিগড়ে বন্দি বঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। যাদের ইতিহাস চাপা পড়ে অন্ধকারে তলিয়ে গেছে। সেই অবহেলিত অনালোকিত জনপদ, যেখানে তার জন্ম হয়েছিল। তিনি দেখতে পান, পঙ্কিলতার অন্ধকারে ডুবে আছে তার পূবর্পুরুষের জন্মভ‚মি।
স্থানিক বিচ্ছিন্নতার কারণে কখনো কখনো মানুষের মধ্যে মনোবিকলন বা বিকার ঘটে, স্মৃতি-তাড়িত হয়ে বারবার ফিরে যান অতীতে। এই অতীতচারিতাই তার লেখার প্রধান উপজীব্য। তার ছিল অসাধারণ উদ্যমী সৃষ্টিশীল এক জীবন, যে জীবন বিতকির্তও। ভারত ইসলাম নারী ও উন্নয়নশীল বিশ্বের ব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গি বিতকির্ত হলেও তিনি বিশ্বসাহিত্যের একজন গুরুত্বপূণর্ লেখক। যদিও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে প্রতিক্রিয়াশীলতার অলঙ্কারও পরিধান করতে হয়েছে তাকে। তাতে কী। ব্যক্তি চরিত্রের সঙ্গে লেখক-সত্তার মিল থাকতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। লেখার মধ্যে জীবনবোধের গভীরতা, মানুষকে দেখার ও পযের্বক্ষণ করার দূরদৃষ্টি ও সক্ষমতা, মানব মনস্তত্ব, ব্যক্তিক-শূন্যতা ও সংগ্রাম এসব লেখার উজ্জ্বল দিক কিনা সেটা বিবেচ্য বিষয়। জীবনের নান্দনিকতা সৌন্দযর্ এ সবের পরিবতের্ তার উপন্যাসে মানুষের দুদর্শা ও গøানিই প্রবলভাবে উঠে এসেছে। ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে, ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। পারকিনসন্স রোগের কারণে তিনি হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতেন।
১৯৭১ সালে ‘ইন এ ফ্রি স্টেট’ উপন্যাসের জন্য বুকার পুরস্কার পান এবং ২০০১ সালে পান সাহিত্যে নোবেল। ১৯৯০ সালে তাকে নাইট উপাধি দেয়া হয়। দীঘর্ ২৭ বছর ধরে তার নাম আলোচনায় এলেও, সম্ভবত একজন বিতকির্ত লেখক হওয়ার কারণে নোবেল পুরস্কার পেতে তার বিলম্ব হয়। তার উল্লেখযোগ্য বই হচ্ছে, ‘দ্য মিস্টিক ম্যাসুর-১৯৫৭’ ‘মিগ্যেল স্ট্রিট-১৯৫৯’ দ্য মিমিক মেন-১৯৬৭’ দ্য সাফ্রেজ অব এলভিরা-১৯৫৮’ ‘আ হাউস ফর মিস্টার বিশ্বাস-১৯৬১’ ‘মিস্টার স্টোন অ্যান্ড দ্য নাইটস কম্প্যানিয়ন-১৯৬৩’ ‘আ ফ্ল্যাগ অন দি আইল্যান্ড-১৯৬৭’ ‘গেরিলাস-১৯৭৫’ ‘আ বেন্ড ইন দ্য রিভার-১৯৭৯’ ‘দি এনিগমা অব অ্যারাইভাল-১৯৮৭’ ‘আ ওয়ে ইন দ্য ওয়াল্ডর্-১৯৯৪’ ‘ম্যাজিক সিডস-২০০৪’ ‘হাফ আ লাইফ-২০০১’ ‘দ্য নাইট ওয়াচ ম্যানস অকারেন্স বুক অ্যান্ড আদার কমিক ইনভেনশন-২০০২’ ইত্যাদি। বইগুলো আলোচিত ও পাঠকনন্দিত। লেখকজীবনের একদম শুরু থেকেই তার অন্যতম প্রধান সমস্যা ছিল লেখার বিষয় খুঁজে পাওয়া, যা কারও কারও কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে।
সাহিত্যের বাইরে নাইপলের ছিল বিচিত্র জীবন। অক্সফোডের্ লেখাপড়ার সময় ইংরেজ তরুণী প্যাট্রিসিয়া হেইলের সঙ্গে তার প্রেম ও পরে বিয়ে। জীবিকার অভাবে নাইপল যখন দুদর্শাগ্রস্ত ও হতাশ তখন প্যাট্রিসিয়াই তার খরচ জুগিয়েছেন। কিন্তু একসময় তাকে উপেক্ষা করেই অ্যাংলো-আজের্ন্টাইন মাগাের্রট গুডিংকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন দেশে। প্যাট্রিসিয়া ক্যান্সারে মারা গেলে শেষকৃত্যের পরের দিনই নাইপল ঘরে আনেন দ্বিতীয় স্ত্রীপাকিস্তানি বংশোদ্ভুত সাংবাদিক নাদিরা খানম আলভিকে। যা অনেককেই বিস্মিত করেছিল।
সমালোচকরা বলেছেন, নাইপলের লেখা ভ্রান্তি আর বিদ্বেষে পূণর্, কখনো কখনো সেখানে মিশেছে গেঁাড়ামি। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ধারণাকে বিকশিত ও প্রতিষ্ঠিত করে না। ফলে মানবিক বোধশূন্যতাও কখনো কখনো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। নাইপল অবশ্য এসবকে পাত্তা দিতেন না। তিনি সব সময়েই বলতেন- একজন লেখকের লেখাকে মিলিয়ে দেখতে হবে পাঠকের জীবনের সঙ্গে। আত্ম-মনোবিশ্ব ও রসবোধ ওখানেই নিহিত, সমালোচনার মধ্যে নয়। বিশ্ব সাহিত্য-বীক্ষণের প্রেক্ষাপটে তার এই কথাটি গভীর অনুধাবনের বিষয়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct