দিল্লিতে জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও জাতীয় নাগরিক পঞ্জির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে শামিল হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের সেই বিক্ষোভের উপর দিল্লি পুলিশের লাঠি চার্জ সহ দমন নিয়ে চরম সমালোচনা হয়েছিল। এ বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি কমপক্ষে ৪৫ জন জামিয়ার পড়ুয়া পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয় বলে অভিযোগ ওঠে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ওই দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে পুলিশ শিক্ষার্থীদের উপর যৌন নির্যাতন ও রাসায়নিক গ্যাসও ব্যবহার করে। সোমবার সেই ঘটনার ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট পেশ করেছে মহিলা সংগঠন ‘ন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান উইমেন’ বা এনএফআইডব্লিউ। এই ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং দলে ছিলেন এনএফআইডাব্লিউ’র ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য কনীনিকা রায়, রুশদা সিদ্দিকী ও সুপ্রিয়া চোটানি। এই ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ইংরেজি নিউজ পোর্টাল মুসলিম মিরর ডট কম। মুসলিম মিরর-এ প্রকাশিত আবদুল বারি মাসুদের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হল 'আপনজন' পাঠকদের জন্য।
ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট প্রকাশের পর ভিডিও কনফারেন্সে এনএফআইডব্লিউ সভাপতি অরুণা রায় ওই রিপোর্ট সম্পর্কে বিস্তারিত জানান সাংবাদিকদের। তিনি বলেন, সরকারকে অবশ্যই পুলিশের সংঘটিত এই জঘন্য অপরাধের তদন্ত করতে বিশেষ বিচারিক তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে এবং অবশ্যই ভুক্তভুগীদের এই পুলিশি বর্বরতার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
প্রখ্যাত এই মহিলা সমাজকর্মী বলেন, নারীদের উপর যৌন নির্যাতন ও বিক্ষোভকারীদের উপর যে পরিমাণ সহিংসতা চালানো হয়েছে তা নজিরবিহীন। তিনি বলেন, সিএএ, এনআরসি এবং এনপিআর’র বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে জামিয়া শিক্ষার্থী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের উপর পুলিশ নির্মমভাবে হামলা চালিয়েছিল। ওই বিক্ষোভে জেএনইউ এবং জামিয়ায় ক্যাম্পাস হামলায় নেম প্লেট ও ব্যাজবিহীন এমন অনেক পুলিশ কর্মীকে দেখা গেছে। এছাড়াও, শিক্ষার্থীদের উপর আক্রমণকারীদের কয়েকজন সাধারণ পোশাক পরিহিত ও পুলিশের হেলমেট ছাড়া অন্য হেলমেট পরিহিত ছিল। আর তাদের আক্রমণের ধরণও ছিল নৃশংস।
ওই মহিলা সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অ্যানি রাজা বলেন, ১০ ফেব্রুয়ারি জামিয়ার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে যে বর্বরতা চালানো হয়েছে গণতান্ত্রিক কোন দেশে তা হয় না। অমানবিক আচরণ এবং হামলার বর্বরতাই স্পষ্ট করে সরকারের কাছে সিএএ বিরোধী প্রতিবাদকারীরা রাষ্ট্রের শত্রু।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জামিয়া শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা নির্যাতনের দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, ১) মহিলাদের লক্ষ্য করে চালানো সহিংসতা এবং ২) শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের উপর রাসায়নিক গ্যাসের ব্যবহার।
২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জামিয়ায় সহিংসতার ঘটনা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রায় ১৫ জন নারী ও ৩০ জন পুরুষকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত করা হয়েছিল।
যৌন নির্যাতন
পুরুষ পুলিশ কর্মীরা মহিলাদের গোপন অঙ্গ স্পর্শ থেকে শুরু করে তাদের জামাকাপড় ছিঁড়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। এমনকি পুলিশ কিছু প্রতিবাদকারী শিক্ষার্থীর স্তনে আঘাত করা, বুট দিয়ে তাদের চাপা দেয়া, পাশাপাশি তাদের গোপনাঙ্গে লাঠি ঢোকানোর মতো জঘন্য চেষ্টাও করেছে।
কমপক্ষে ১৫ জন নারীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাদের গোপনাঙ্গে লাঠি ঢোকানোর চেষ্টার কারণে তাদের গোপনাঙ্গ ছিঁড়ে গেছে। হামলার কয়েক সপ্তাহ পরেও আহত নারীদের শরীরে ব্যাথা, পুঁজ ও রক্তক্ষরণ সহ্য করতে হয়েছে। ওই প্রতিবাদে কম বয়সী ১৬ বছর থেকে বয়স্ক ৬৫ বছর বয়সের নারীদের উপর যৌন নির্যাতন করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই এখন গুরুতর স্ত্রীরোগ সংক্রান্ত জটিলতায় ভুগছেন।
সিজারিয়ান হওয়া এক মহিলা শারীরিক নির্যাতন বন্ধ করার কাকুতি মিনতিতেও পুলিশ তার হামলা চালিয়ে যায়।
পুরুষদের উপর যৌন নিপীড়ন সমানভাবে নৃশংস ছিল। তাদের কুঁচকিতে ও মলদ্বারে আঘাত করা হয়েছে যার ফলে অনেকেই গুরুতর আহত হন। বিক্ষোভকারীদের উপর এই জঘন্য হামলা ছিল পুলিশের সীমাহীন শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টার প্রমাণ।
বাসে হামলা
প্রতিবাদকারীদের উপর পুলিশি হামলা শুধু ব্যারিকেডে আবদ্ধ ছিল না। প্রায় ৩০ জন ছেলেকে (ছাত্র এবং প্রতিবাদকারী ) থানায় নেয়া হয়েছিল। পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার পথে প্রায় ৪০ মিনিট ধরে বাসের মধ্যে তাদের মারধর করা হয়। এসময় পুলিশ বুট দিয়ে তাদের কুঁচকিতে লাথি মারে।
রাসায়নিক আক্রমণ
ওই বিক্ষোভে পুলিশ যে রাসায়নিক গ্যাস ব্যবহার করেছে তা সাধারণ কাঁদুনে গ্যাস ছিল না বলে অভিযোগ উঠেছে। কেননা ওই রাসায়নিক গ্যাসে কারো চোখ জ্বালা বা পানি না পরে তাৎক্ষণিক তন্দ্রা ভাব ও তীব্র মাথাব্যথার লক্ষণ দেখা যায়। তাদের দমবন্ধ হয়ে যাওয়া ও পেশীতে ব্যাথাও অনুভূত হয়। বেশিরভাগই ওই স্প্রে করার পর ঘন্টাখানেক দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। কয়েকজন শিক্ষার্থী স্প্রের কারণে বমি বমি ভাব, মাথা ব্যথা ও পেশী ব্যথার অভিযোগ করেছে।
এটা স্পষ্ট যে স্প্রেতে স্বাস্থ্যের পক্ষে গুরুতর ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ছিল। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ওই গ্যাস সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশ সুস্পষ্ট জবাব দিতে অস্বীকৃতি জানায়। পুলিশের দাবি, এটি মশার ফিউমিগেশন স্প্রে ছিল যা ব্যারিকেড এলাকা থেকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। যদিও পুলিশের এই দাবিটি সম্পূর্ণ মিথ্যা, কারণ হাসপাতালটি ব্যারিকেড থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ছিল।
তিন সদস্যের এনএফআইডব্লিউ টিম আরো বলেন, কোনো চিকিৎসকের সাথে রোগীদের রক্ত বা মূত্র পরীক্ষা করানোর বিষয়ে আলোচনা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা একটি বিষয়ে একমত পোষণ করেন যে সাদা পোশাকে ও ভুয়া ইউনিফর্ম পরে তাদের উপর হামলা চালানো হয়েছিল। বিবরণীতে সাক্ষীরা বলেছে, পুলিশের পাশাপাশি সন্দেহভাজন আরএসএসের গুন্ডারা ভুয়া পুলিশ ইউনিফর্ম পরে বিক্ষোভকারীদের উপর হামলা চালায়। এর আগে জেএনইউ ও জামিয়ায় ক্যাম্পাসের আক্রমণে যেমন দেখা গিয়েছিল, সেখানে নামফলক ও ব্যাজবিহীন পুলিশ সদস্য ছিল। এছাড়াও, হামলাকারীদের মধ্যে কয়েকজন সাধারণ পোশাক ও পুলিশের হেলমেট ছাড়াই ছিল।
১০ ফেব্রুয়ারী বিক্ষোভকারীদের উপর করা ভয়াবহ হামলার পরিপ্রেক্ষিতে এনএফআইডাব্লিউ নিম্নলিখিত দাবিগুলো করেছে:
ক) স্বরাষ্ট্র দফতর আন্দোলনে বাধা দেয়া থেকে শুরু করে থানায় শিক্ষার্থীদের আটকে রাখা সহ যাবতীয় ঘটনার একটি সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দিতে হবে।
খ) ইউনিফর্ম পরিহিত সকলের দ্বারা সংঘটিত অপরাধ ও জঘন্য আচরণের জন্য সরকারকে একটি বিশেষ বিচারিক তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।
গ) বিক্ষোভকারীদের উপর ব্যবহৃত রাসায়নিকের গ্যাস ও আহত ব্যক্তিদের অবস্থা সম্পর্কে চিকিৎসকদের তদন্তের মাধ্যমে সরকারি প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।
ঘ) নিরস্ত্র প্রতিবাদকারীদের আহত ও জখম করা সম্পর্কিত কোনো এফআইআর ফাইল এখন অবধি দাখিল করা হয়নি। এফআইআর দাখিল করতে হবে। নির্যাতিতদের উপর হয়রানি ও হুমকি থামাতে হবে।
ঙ) যেহেতু ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশের অপরাধ ও বাড়াবাড়ি দিন দিন বাড়ছে। এজন্য শুধু পুলিশ নীতি সংস্কারের জন্য নয়, বরং বিচারপতি ভার্মা কমিশনের প্রতিবেদনের সম্পর্কিত ধারাগুলোও কার্যকরের অনুরোধ করছি, যেগুলো সরকার নিজেদের লাভের জন্য বাস্তবায়ন করেনি।
চ) কেবল পুলিশের বর্বরতাই নয়, পুলিশ বাহিনীকে জোরালো ভিত্তিতে ইসলামোফোবিক মতাদর্শকে উদ্বুদ্ধ করা বন্ধ করতে হবে।
ছ) শেষ পর্যন্ত, তারা আঘাতে আহতদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের দাবি করেছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct