ইউসুফ সালাদিন আয়ুবী ক্রুসেডের মহানায়ক
ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ একটি বহু আলোচিত ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহ, বেশির ভাগ আলোচনা বা বর্ণনা পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকদের কলমে এবং তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিতেই লেখা। ইউসুফ সালাদিন আয়ুবীকে ক্রুসেডের মহানায়ক হিসেবে তুলে ধরেছেন আরবীয় লেখক আমিন মালাউফ। তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বাংলা তরজমা করেছেন পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের প্রাক্তন সচিব আব্দুস শুকুর।
ব্যক্তিত্বের সামান্য প্রভেদ ছাড়া তিনি নুর আল দীনের আরোপিত গুনের দ্বারা ভীষন ভবে প্রভাবিত হয়েছিলেন, বিশেষ করে জীবনের প্রথম ভাগে। তিনি চেষ্টা করতেন নুর আল দীনের যোগ্য উত্তর সুরী হওয়ার। অনলস ভাবে দুজনের একই উদ্দেশ্য- সমগ্র আরব জগৎকে একত্রিত করতে হবে,এবং মুসলামদেরকে এক হয়ে এগিয়ে আসতে দুজনের ছিল সাধারন লক্ষ্য, যাতে খ্রীষ্টান দের কাছে হারানো জমি বিশেষ করে জেরুযালেম পুনরাদ্ধার করতে পারা যায়। সেই সময় আ সালাহ কে সমর্থন দিতে সালাদিনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে ফরাসীদের সাথে ষড়যন্ত্র করল, কায়রোর শাসকের চিঠি পেয়ে তিনি নুর আল দিনের পক্ষের ঐতিহ্য রক্ষা করলেন, এবং নিজের দৃষ্টিভঙ্গি জানিয়ে পরিষ্কার লিখলেন, ‘’ আমাদের বিগত বাদশা(নুর আল দিন) আমার মধ্যে বিশ্বাস আরোপ করে মিশরের দায়িত্ব না দিতেন তবে আমি মিশরের কাজে হাত দিতাম না, আমি যাহা করেছি তাঁর উপদেশ মোতাবেক ও তাঁর শিশু উত্তরাধিকারীদের কথা ও মুসলমানদের সামগ্রিক মঙ্গলের কথা ভেবেই করেছি আমার উপর অর্পিত কাজ করতে পেরেছি, আল্লাহতে ভরসা রাখি। এখানে আগের এমন সব ব্যাপারে অনাগ্রহী মানুষটিকে চেনা মুস্কিল। বোধহয় তার প্রভুর মৃত্যুই তার আরুদ্ধ ক্রোধকে এত চাগিয়ে দিয়েছিল। সত্যি যে বিশেষ অবস্থা তৈরী হয়েছিল,এই বার্তা বিশেষ উদ্দেশেই পাঠানো হয়েছিল, মুসলিম সিরিয়া বিজয়ের প্রাথমিক যুদ্ধ শুরুর ইহা সঙ্কেত ছিল,১১৭৪ সনের অক্টোবর মাসের এই বার্তা পাওয়ার আগেই কায়রোর আমির ৭০০ ঘোড়সওয়ার নিয়ে দামানস্কাসের দিকে যাত্রা শুরু করে দিয়েছিলেন। সিরিয়া অব্রোধের জন্য ইহা খুবই ছোট উদ্যোগ ছিল, অবশ্য সালাদিন খুব হিসেব করেই এগোচ্ছিলেন। সালাদিনের অগ্রগতির কঠোরতা উপলব্ধি করে আল সালা ও তার সহযোগীরা এ্যলেপ্পোতে পিছিয়ে যাওয়া স্থির করলেন। ফরাসী এলাকা সহজেই পেরিয়ে অক্টোবর মাসেই সালাদিন দামাস্কাস পৌঁছলেন,তার পরিবারের লোকজন দরজা খুলে সুলতানকে বরন করলো। তরোয়ালের একটিও আঘাত ছাড়া এই জয় সালাদিনকে এগিয়ে যাবার উৎসাহ দিল, এক ভাইয়ের হাতে দামাস্কাসের ভার দিয়ে তিনি মধ্য সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হলেন, হোমস ও হামা অবরোধ করলেন। ঝোড়ো অভিযানে,ইবনে আল আথির বলেছেন সালাদিন সালির রাজা, নুর আল দিনের ছেলের নামেই যুদ্ধ করেছিলেন, তিনি বলতেন ফরাসীদের থেকে দেশ বাঁচাতেই তার হাত সক্রিয় আছে,তিনি জাঙ্গি বংশের প্রতি অনুগত।
সন্দহেই অবশ্য, মসুলের ইতিহাসকার সালাদিনকে সন্দেহই করতেন, ও ভন্ডামির অভিযোগ করতেন, তিনি পুরোপুরি ভুল ছিলেন না, পাছে কেও তাকে জবর দখলকারী বলে তাই তিনি আল সালির রক্ষাকর্তা হিসেবে নিজেকে দেখাতে চাইতেন। ‘যে ভাবেই হোক,’ সালাদিন বলতেন এই উদ্ধত যুবক কারও সাহায্য ছাড়া একা কিছু করতে পারবেনা, সহায়ক বা প্রদর্শক যাই হোক সালিহর দরকার ,এবং ‘ সে কাজ আমার থেকে ভাল কেও পারবেনা’ তিনি সালিহ’র কাছে বারবার চিঠি দিয়ে আনুগত্য দেখাতেন কায়রো ও দামাস্কাসের মসজিদে তার নামে প্রর্থনা বসাতেন, মুদ্রাও ছাপাতেন। নুর আল দিনের তরূন পুত্র বা তরুন রাজা কিন্ত সালাদিনের এসব কাজে যে খুব চমৎকৃত ধয়েছেন তা কিন্তু নয়। বরং একদমই প্রভাবিত হননি, ১১৭৪ সনের ডিসেম্বরে যখন সালাদিন আলেপ্পো অবরোধ করলেন, অজুহাত দিলেন আল সালিকে তার খারাপ উপদেষ্টাদের হাত থেকে বাঁচানো দরকার,তখন উলটে নুর আলদিনের পুত্র শহরের লোকদের জড় করে করুন বক্তৃতা দিলেন সালাদিনকে নিমকহারাম ,বিশ্বাসঘাতক,জবরদখললকারী এসব বলে, শহরবাসীরা তার কথায় বিগলিত হয়ে সালাদিনের বিপক্ষে দাঁড়ালেন, সালাদিন সরাসরি বিরোধিতা না করে অবরোধ তুলে নিলেন, কিন্তু নিজেকে মিশর ও সিরিয়ার ‘সুলতান’ঘোষনা করলেন। এবং এভাবে দখল করার অপবাদ এড়ালেন, ইতিহাস কাররা যদিও সুলতান বলেছেন,তিনি নিজে এই খেতাব নিয়েছেন এমন প্রমান নাই। সালাদিন ঘুরে ফিরে আরো কয়েকবার এ্যলেপ্পোর প্রাকারে ঘা দিয়েছেন,কিন্তু নুর আলদিনের ছেলের বিরুদ্ধে সরাসরি কখনও অস্ত্র ধরেন নাই। শেষে আল সালিহ এর উপদেষ্টারা সালাদিনের মত স্থায়ী এবং শক্তিশালী শত্রুর হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য .এ্যসেসেন’ নামক গুপ্ত ঘাতক দলের সাহায্য নেওয়া মনস্থ করে। এই দলের সদস্য রাশিদ আল দিন সিনানের সাথে তারা যোগাযোগ করেন।রশিদ, সালাদিন থেকে রেহাই পাবার ব্যবস্থা করবেন,এই কথা দেয়। .পাহাড়ের এই বৃদ্ধ’ ফাতামিহ সাম্রাজ্যের কবর খুঁড়েয়েদের সাথে তাদের পুরোনো বিবাদের জড় মেটানোর চেয়ে বড় কাজ আর কি। ১১৭৫ সনের প্রারম্ভেই প্রথম আঘাত এল। কিছু ঘাতক একেবারে সালাদিনের তাবুর ভিতর পর্যন্ত, ঢুকে পড়েছিল, একজন আমির চিনতে পেরেছিলেন ও আটকে দিয়েছিলেন। আমির নিজে ভীষণ ভাবে আহত হয়েছিলেন। ঘন্টা বেজে যাওয়ায় গার্ডরা চলে আসায়,বড় যুদ্ধের পর সব ঘাতকদের নিকেশ করা হয়েছিল। ১১৭৬ সনের ২২শে মে যখন সালাদিন এলেপ্পোতে নুতন অভিযান শুরু করেন, একজন ঘাতক তাবুর ভিতর প্রপপড়েবেশ করে ফেলেন, সুলতানের মাথায় ছুরিরআঘাত করতে পারেন, সৌভাগ্য বশতঃ আগের আঘাতে শিক্ষা নিয়ে ফেজ টুপির নীচে শিরস্ত্রান দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। ঘাতক তখন সুলতানের ঘাড়ে ছুরি দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করে,তখন লম্বা ভারী মোটা বস্ত্রের জন্য আটকে যায়,ইতিমধ্যে একজন আমির একহাতে ছুরি ধরে ফেলেন অন্য হাত দিয়ে ঘাতককে জোরে ধাক্কা মেরে ফেলে দেন কিন্তু সুলতান সামলে ওঠার আগেই আর একজন আততায়ী ঝাপিয়ে পড়ে, তারপর আর একজন,এর মধ্যে অনেক গার্ড চলে আসে ও আততায়ীদের মেরে ফেলে বিধ্বস্ত সালদিন উঠে বসেন। অবাক দেখেন তার কোন আঘাত লাগেনি, আল্লাহের শোকরিয়া আদায় করেন।
এই ঘটনা বাদে ধাতস্ত হওয়ার পর তিনি মধ্য সিরিয়ায়,’এ্যাসেসেন’ দের উপর তীব্র আক্রমন শুরু করেন, রাশিদ আল দিন সিনান এসব এলাকার দশ বা ততোধিক দূর্গ অধীনে রেখেছিলেন। এই এলাকার সব থেকে প্রভাবশালী দূর্গ গুলিকে অবরোধ করেন, পর্বত শীর্ষে রোদ্রস্নাত মায়রাফ এ্যাসেসেন দের ঘাটি ছিল, এ এলাকার ১১৭৬৬ সনে কি হয়েছিল তাহা এখনও রহস্য, একটি মত, ইবন আল আতাহার বলেছিলেন, সিমান সুলতানের এক মামাকে চিঠি লিখে ভয় দেখিয়েছিলেন যে পরিবারের সকলকেই হত্যা করা হবে, ঘাতকদলের কাছ থেকে এই চিঠিকে বিশেষ করে সুলতানের উপর দুবার আক্রমন হওয়ার পর, হাল্কাভাবে নেওয়া হয়নি, এখানকার অবরোধ তুলে নেওয়া হয়েছিল। ২য় মত ঘাতকদের নিজেদের দেওয়া, তাদের লেখা পত্রের পাওয়া বর্ননা থেকে আবু ফারাস নামের ঘাতকের লেখা পড়ে পাওয়া হিসেব এরকম—যখন মায়রাফ দূর্গ অবরোধ করা হয়েছিল সিমোন তখন ওখানে ছিলেন না, কাছের কোন পাহাড় থেকে সিমান আর দুই সঙ্গী মায়ররাফের ঘটনা লক্ষ রাখছিলেন, সালাদিন তাকে ধরতে অনেক সৈন্য পাঠালেন, অবাক কান্ড সৈন্যদের পা অবশ হয়ে গেল, সিমান এগিয়ে এসে বলল, সে একা একান্তে সুলতানের সাথে কথা বলতে চায়। ভীত সন্ত্রস্ত কিছু সৈন্য সুলতানকে সব কথা বলল,সুলতান বুঝলেন এরা কিছু বোঝাতে ভুল করছে, তাঁর তাবুর চারিপাশে ছাই ও চুন ছিটিয়ে দিতে বললেন যাতে আসা যাওয়া করলে পায়ের ছাপ ধরা পড়ে, এবং তাবুর চারিদিকে টর্চ সমেত গার্ডের সংখা তাবুর চারিদিকে বাড়িয়ে দিলেন, মাঝরাতে সুলতানের ঘুম ভেঙ্গে গেল, দেখলেন তার তাবুর বাইরে এক রহস্যজনক ব্যক্তি হামাগুড়ি দিয়ে আসছে,সুলতানের মনে হল, ইহা সিমান নিজেই,ঐ ব্যক্তি বিছানায় একটি বিষাক্ত কেক ও একটি চিঠি রেখে গেছেন তাতে লেখা আপনি আমাদের ক্ষমতার বৃত্তের মধ্যে আছেন, সালাদিন চীৎকার করে উঠেছিলেন, গার্ডরা ছুটে এলেন,তারা বলল, তারা কিছু দেখেনি,পরের দিন তিনি অবরোধ তুলে নিলেন,ও দামাস্কাসে ফিরে গেলেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct