ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক সামরিক হামলার প্রায় এক বছর পূর্ণ হয়েছে। গোটা দেশে প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞ এখনো চলছে। ইতিমধ্যে ইউক্রেনের হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষের প্রণহানি হয়েছে। উভয় পক্ষের লক্ষাধিক সেনা নিহত হয়েছেন। লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে উদ্বাস্তু ও শরণার্থীর জীবন কাটাচ্ছে। ইউক্রেনের অনেক শহর ও গ্রাম রকেট ও গোলার আঘাতে মাটিতে মিশে গেছে। এই যুদ্ধ যখন দ্বিতীয় বছরে পা দিচ্ছে, উভয় শিবিরে হাজার হাজার নতুন সেনা নিয়োগ করা হচ্ছে। এ নিয়ে লিখেছেন লিওনিদ রাগোজিন। আজ শেষ কিস্তি।
জয়–পরাজয়ের এই মিশ্র পরিস্থিতিতে ইউক্রেনে তাদের ‘বিজয়’–এর সংজ্ঞাকে ইচ্ছা করেই একটি ধোঁয়াশাপূর্ণ জায়গায় রেখে দিয়েছে। অন্যদিকে ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়া পশ্চিমা দেশগুলোও যুদ্ধ কোন উপায়ে শেষ হবে, সে বিষয়ে দ্যর্থক অবস্থানে রয়েছে। ওয়াশিংটনের আনুষ্ঠানিক ভাষ্যমতে, রাশিয়ায় ইউক্রেনের পূর্ণ বিজয় না হওয়া পর্যন্ত তারা ইউক্রনের সরকারকে ‘যত দিন সময় লাগবে, তত দিন’ সমর্থন দিয়ে যাবে। তবে ইউরোপের কেউ কেউ এখন সাবধানতার সঙ্গে মন্তব্য করছেন। যেমন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বলেছেন, রাশিয়াকে পরাজিত করা উচিত হবে, ভাঙা উচিত হবে না। ইউক্রেন এ পর্যন্ত পশ্চিমের কাছ থেকে প্রায় চার হাজার কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা পেয়েছে, যার মধ্যে তিন হাজার কোটি ডলার একাই দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। জানুয়ারি মাসে জার্মান এবং মার্কিন ট্যাংক ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে সরবরাহের মাধ্যমে ন্যাটো দেশগুলো তাদের স্বঘোষিত ‘লাল ফিতা’ টানা সীমানা অতিক্রম করেছে। সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টের একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, ইউক্রেন সরকারের জন্য এটি হুঁশিয়ারির বিষয় যে পশ্চিমা সহায়তায় সজ্জিত ইউক্রেনের সামনে এখন কোনো ধরনের শান্তি আলোচনায় বসার আগেই সমরদৃশ্যপট বদলে ফেলার শেষ সুযোগ। এই সুযোগ যদি তারা কাজে না লাগাতে পারে, তাহলে যুদ্ধ আরও দীর্ঘ হবে। ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স সম্প্রতি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নীতিনির্ধারকদের ওপর সম্প্রতি একটি জরিপ চালিয়ে বলেছে, ইউরোপের নেতাদের মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধের সম্ভাব্য পরিণতির বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। জরিপে দেখা গেছে, গুটিকয় নেতা মনে করেন, এই যুদ্ধের ফল হিসেবে কিয়েভ ‘পূর্ণ মুক্তি’ পাবে। তবে বেশির ভাগের মত হলো, যুদ্ধ শেষ হলেও ইউক্রেনের একটা অংশ রাশিয়ার হাতে থেকেই যাবে। ইউক্রেন এই যুদ্ধে জিতে গেলে কিয়েভ অবরুদ্ধা অবস্থা থেকে মুক্তি পাবে এবং ন্যায়বিচারের জয় হবে ঠিকই; কিন্তু এর অর্থ দাঁড়াবে, পুতিনের পরাজয় ও চূড়ান্ত অপমান। বিশেষ করে ক্রিমিয়া রাশিয়ার হাতছাড়া হয়ে গেলে পুতিন প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হতে পারেন এবং সেটি তাঁকে পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগ করতে প্ররোচিত করতে পারে। তখন মানবতার ভাগ্য এমন এক বিকারগ্রস্ত লোকের হাতে পড়ে যেতে পারে, যিনি ইতিমধ্যেই অচিন্তনীয় খামখেয়ালিপূর্ণ যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে গোটা ইউরোপকে অস্থির করে তুলেছেন। অন্যদিকে রাশিয়া যদি জয়লাভ করে, তাহলে সেটি হবে পশ্চিমের পরাজয়। তবে রাশিয়ার সে ধরনের জয় পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
রাশিয়া ইউক্রেনের কিছু অঞ্চল দখলে নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, তবে তারা কতটুকু নিতে পারবে বা দখল করা জায়গায় কতক্ষণ টিকে থাকতে পারবে, তা শুধু সময়ই বলতে পারে। এই যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সামাজিক স্তরের প্রত্যাশার মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে এবং সেই সামাজিক প্রত্যাশার ব্যবধানটি বেশ গুরুত্ব বহন করে। রাশিয়ার সমাজ পুতিনের সামরিক অভিযান ও সীমানা বিস্তারের চেষ্টাকে বেশ উষ্ণভাবেই গ্রহণ করেছে। তবে অধিকসংখ্যক লোকক্ষয় ও অর্থক্ষয় এড়িয়ে রাশিয়া সমঝোতায় গেলও তারা সেটিকে ইতিবাচকভাবে দেখবে। অন্যদিকে, ইউক্রেনীয়দের প্রত্যাশা এখন অতি স্ফীত অবস্থায় আছে। অপমানজনক সমঝোতা চুক্তির প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে এবং পুতিনের আল্টিমেটামের তোয়াক্কা না করে জীবন বাজি রেখে লড়াই করার পর প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি কোনো ধরনের আপস করতে গেলে তাঁর সরকার হুমকিতে পড়ে যাবে। এই মুহূর্তে যেকোনো ধরনের আয়োজিত আপস–মীমাংসায় বসতে যাওয়া ইউক্রেনের জন্য মিনস্ক চুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখান করার চেয়ে খারাপ হবে এবং এটি এই প্রশ্ন তুলবে যে তাহলে এত ত্যাগ–তিতিক্ষার অর্থ কী দাঁড়াল? ঠিক এই কারণেই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য জেলেনস্কিকে জোরালো আনুষঙ্গিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে চলতি বছরের সামনের সময়টা ইউক্রেনের জন্য বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন। (সমাপ্ত..)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct