ইতিহাসের নজিরবিহীন ট্র্যাজেডি (মুহাররম)
এম ওয়াহেদুর রহমান
“শহীদের সর্দার ওগো
ফাতেমার লাল হুসাইন,
সত্যের জন্য দিয়েছো প্রাণ
তবু দাওনি ঈমান।”
‘ওই যাঁরা দিন রাত্রি ইসলামী নিশান হাতে চলেছেন শহীদের যাত্রী...’ বিশ্বনবী মানবতার অগ্ৰদূত হযরত মুহাম্মদ সা. এর দৌহিত্র তথা হযরত আলী ও মা ফাতেমার পুত্রের ঈমাম হুসাইন রা. তাঁদের মধ্যে অন্যতম। যিনি ৬৮০ খৃস্টাব্দে আরবী মুহাররম মাসের ১০ তারিখ ইরাকের কারবালা মরু প্রান্তরে দাঁড়িয়ে বুকে আকন্ট তৃষ্ণা সত্ত্বেও অন্যায় তথা অশুভ শক্তিকে পদানত করে সর্বোপরি পার্থিব সুখ ভোগ কে ত্যাগ করে নির্মম ভাবে শাহাদাত বরণ করেছিলেন, যা হৃদয়বিদারক ও শোকাবহ ঘটনা ; এ কোন মহাসমারোহে উৎসাহ উদ্দীপনার অনুষ্ঠান নয়। মুহাররম হলো আরবী শব্দ, যার অর্থ পবিত্র , সম্মানিত। মহান আল্লাহর নিকট সম্মানিত চার মাসের মধ্যে একটি মাস মুহাররম। মুহাররমের ১০ তারিখ বিশেষ মর্যাদা সম্পন্ন দিন , যাকে আশুরা বলা হয়ে থাকে। আরবী আশারা কিংবা আশারুন শব্দের শাব্দিক অর্থ ১০ বা দশম। এই দিনটি বিভিন্ন দিক দিয়ে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ করে এই দিনটি মুসলিম বিশ্বে ত্যাগ ও শোকের প্রতীক। খলিফা হযরত আলীর শাহাদাতের পর হযরত মোয়াবিয়ার যুগে হযরত আলীর বড় পুত্র হাসানকে বিষের মাধ্যমে শহীদ করে। ঠিক হয় যে , মোয়াবিয়ার মৃত্যুর পর হাসানের ছোট ভাই হুসাইন রা. কে খলিফা হিসেবে নিযুক্ত করা হবে। কিন্তু মোয়াবিয়া তাঁর মৃত্যুর পূর্বে পূর্ববর্তী সিদ্ধান্তকে অস্বীকার করে তাঁর পুত্র এযিদকে খলিফা মনোনিত করে যান। এরই চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে এযিদের সঙ্গে হুসাইন রা. এর সংঘর্ষ বাধে।
হুসাইন রা. আব্দূল্লাহ বিন জোবায়ের সঙ্গে রাজধানী দামাস্কাস ত্যাগ করে মক্কা চলে যান। কিন্তু কুফার অধিবাসীরা হুসাইন রা. কে তাদের উদ্ধারের জন্য আহ্বান করেন। হযরত হুসাইন রা. সপরিবারে পুনরায় মক্কা থেকে কুফার পথে অগ্রসর হলেন। এযিদের নির্দেশে ওমর বিন সাদের নেতৃত্বে চার হাজার সৈন্যের এক অশ্বারোহী বাহিনী কূফা থেকে পঁচিশ মাইল দূরে কারবালা প্রান্তরে মূহররাম মাসের প্রথম তারিখে হুসাইন রা. এর পথ অবরোধ করল। হুসাইন রা. এর পরিবারের জন্য জল সরবরাহের সকল পথ বন্ধ করে দেওয়া হল। সেই মরু প্রান্তরে জলহীন অবস্থায় হুসাইন রা.এর পরিবারের সাত দিন কেটে গেল। শত অনুনয় সত্ত্বেও এযিদি সৈন্যরা তাঁদের এক ফোঁটা জল দেয় নি। ১০ মুহাররম ভোরে হুসাইন রা. পরিবার সহ জলের সন্ধানে বের হলেন। পথিমধ্যে যুদ্ধে হুসাইন রা. এর ভ্রাতৃস্পুত্র কাসিম আলী রা. শহীদ হলেন। হুসাইন রা. এর শিশু পুত্র বাণ বিদ্ধ হয়ে শাহাদাত বরণ করল। হুসাইন রা. শত্রু নিধন করতে করতে ফোরাতের কূলে উপনীত হলেন অর্থাৎ দীর্ঘ লড়াইয়ের পর শাহাদাত বরণ করেন। এযিদের এক সেনানী সীমার, হুসাইন রা. এর মাথা কেটে বর্শাগ্ৰে গেঁথে দামাস্কাসের দিকে চলে যায়। এই শোক কাহিনী ও আরো অন্যান্য স্মৃতি বিজড়িত ঘটনার স্মরণেই ১০ মহররমের অনুষ্ঠান। আজ ও কারবালা প্রান্তরে শোনা যায় হুসাইন রা. ও তাঁর পরিবারের জলের জন্য কাতরতা। কারবালা প্রান্তরে হযরত হুসাইন রা.ও তাঁর পরিবার আত্মত্যাগ করে সমগ্ৰ বিশ্ববাসী কে শিক্ষা দিয়ে গেছেন আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন বাতিল শক্তির কাছে মাথানত করা যাবেনা। কিন্তু আজকে দিকে দিকে দেখা যাচ্ছে তাজিয়া, বুকে করাঘাত করে আর্তনাদ, কারবালার যুদ্ধের অনুকরণে অভিনীত কৃত্রিম যুদ্ধ , ঢাক - ঢোল পিটিয়ে ‘ হায় হাসান, হায় হুসাইন ‘ শ্লোগান, তাজিয়া বিসর্জন ইত্যাদি , এই গুলো কি হযরত হুসাইন রা. আত্মত্যাগের স্মৃতিমোন্থন ? - এই গুলো কোনটি শরীয়ত সম্মত নয়। আজকে আমরা তাঁর সেই দুর্লভ আত্ম - বিসর্জনের পবিত্র আদর্শকে ভুলে গিয়ে মেতে উঠেছি লাঠি খেলার ময়দানে ! হযরত হুসাইন রা. শুধু একটা নাম নয় বরং একটি ইতিহাস। একটি চেতনার নাম - যা সত্য ও মিথ্যার নিরুপনকারী। কালজয়ী বীর হুসাইন রা. ন্যায় ও ইনসাফের পক্ষে এবং অন্যায় জুলুম ও স্বেচ্ছাচারিতার বিপক্ষে অকুতোভয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহানায়ক।
হযরত হুসাইন রা. আত্মত্যাগ, বীরত্ব ও মর্মস্পর্শিতার নজিরবিহীন ঘটনা প্রবাহ কেবল মুসলিম মানস কে নয় বিশ্বের সব মুক্তিকামী, মুক্তমনা ও অমুসলিম মণীষী বা পন্ডিতদের মনকে ও বিপুলভাবে নাড়া দিয়েছে।তাই বিখ্যাত ঐতিহাসিক গিবন লিখতে বাধ্য হয়েছেন যে, ‘ সূদূর অতীতের সেই বিশেষ পরিবেশে হুসাইনের ট্র্যাজিক মৃত্যুর দশা সবচেয়ে নিরাসক্ত বা কঠিন প্রাণ , পাঠকের হৃদয়ে ও সহানুভূতি জাগিয়ে তোলে।’ মোহন চাঁদ করম চাঁদ গান্ধীর মত ব্যক্তিত্ব ও বলেন, ‘ আমার যদি হুসাইনের ৭২ সঙ্গীর মতো নিবেদিত প্রাণ সঙ্গী থাকত তবে আমি বহু আগেই ভারতকে স্বাধীন করতে পারতাম।’ বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বলেছেন , ‘ ন্যায় বিচার ও সত্য কে বাঁচিয়ে রাখতে অস্ত্র ছাড়াই বিজয় আসতে পারে জীবন উৎসর্গ করার মাধ্যমে ঠিক যেভাবে বিজয়ী হয়েছেন ঈমাম হুসাইন। ঈমাম হুসাইন মানবতার নেতা। ঈমাম হুসাইন শীতলতম হৃদয়কে উষ্ণ করেন। হুসাইনের আত্মত্যাগ আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা কে তুলে ধরে।’ নাইট আ্যঙ্গেল অফ ইন্ডিয়া উপাধিধারী সংগ্ৰামী ভারতীয় বাঙালি নারী কবি সরোজিনী নাইডু লিখেছেন , ‘ Why do thy myriad lovers so lament? Sweet Saint , is not thy matchless martyrhood The living banner and brave covenant did proclaim, Bequeathing for the World’s beautitude Th’ enduring loveliness of Allah’s name.’ এছাড়াও ইংরেজ দার্শনিক ও লেখক টমাস কার্লাইল, ইংরেজ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স, এডওয়ার্ড ব্রাউন, ইতিহাসবিদ পি কে হিট্টি ,নিকলসন প্রমুখ ব্যক্তিত্বরা হুসাইন রা. সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অভিমত পোষণ করেছেন। 10 মহররম কারবালা প্রান্তরে মানব ইতিহাসে যে নির্মম কাহিনী রচিত হয়েছিল তা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্ৰহন করা উচিত। এই দিনটিতে তাঁর জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া, নীরব অশ্রুপাত , রোযা,দান - ধ্যান করাই হলো পবিত্র কর্তব্য। কারণ কারবালার মরু প্রান্তরে সংঘটিত বিয়োগান্তক ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসে এক ট্র্যাজেডি , এ এক শোকাবহ ঘটনা। কারবালা প্রান্তরে ঘৃণিত এযিদ বাহিনীর কাপুরুষোচিত হামলায় হযরত হুসাইন রা. এবং তাঁর 72 জন সঙ্গী - সাথি সহ নির্মমভাবে শাহাদাত বরণের করুন ঘটনা নাড়া দেয় ইতিহাসকে ও। কারবালার পৈশাচিক ঘটনা ভস্মীভূত করে দেয় মনুষ্যত্বকে, মা ইতিহাসের পাতায় বিরল নজির।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct