বইয়ের চেয়ে বড় বন্ধু নেই
সনাতন পাল
লেখক এবং বিশিষ্ট সাহিত্যিক
বিখ্যাত সমাজতত্ত্ববিদ আল বেরুনি জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে একদিন অসুস্থ অবস্থায় শুয়ে আছেন। পাশেই রয়েছেন তাঁর এক বন্ধু। তিনি তাঁকে বললেন,”জ্যামিতির একটা সংজ্ঞা আমার জানা দরকার”। বন্ধুটি বললেন,”তুমি মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে। এসব জেনে এখন কি লাভ হবে?” আল বেরুনি প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, “ মৃত্যুর আগে এটি আমি জেনে যেতে পারলে হয়তো আমার জীবনটা আরও ধন্য হবে”। আর এই জানার জন্যই বইয়ের প্রয়োজন। বাংলা গদ্য সাহিত্যের প্রবর্তক ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর শৈশব থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং জ্ঞান পিপাসু। রাতে বাতি জ্বালিয়ে পড়াশোনা করার মতো তাঁদের সঙ্গতি ছিল না। তাই কিশোর বিদ্যাসাগর সন্ধ্যার পরে পথের পাশে জ্বালানো বাতির নীচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করতেন। পৃথিবীতে যে সকল ব্যক্তিগণ জ্ঞানের আলোতে সমাজকে আলোকিত করেছেন এবং মানব কল্যাণের পথ দেখিয়ে গেছেন তাঁরা সকলেই জীবনে বহু বই পড়েছেন। বই থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগ করে গেছেন। সেই বই এখন ব্রাত্য। অবশ্য তখন স্মার্ট ফোন এবং ইন্টারনেট থাকলে কি হতো সেটা বলা কঠিন। কিন্তু এই কথাটাও ঠিক যে, ইন্টারনেট এবং স্মার্ট ফোন আবিষ্কার করতে যে জ্ঞানের দরকার হয়েছে,সেটাও কিন্তু এই বই পড়েই সঞ্চয় করা হয়েছে। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যত উন্নতিই হোক না কেন! একথা আমাদের সবাইকে মানতেই হবে যে,বই আমাদের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। বইয়ের কোনো বিকল্প হয় না। বইয়ের থেকে বড় আর কি আছে ! বই নিজেকে চিনতে সাহায্য করে এবং অন্যের সামনে নিজের চিন্তা তুলে ধরতে সাহায্য করে। বই কল্পনার দুয়ার খুলে দেয়,সাথে মনোযোগ এবং ধৈর্য বাড়ায়। বই এমন একটা জিনিস,যা মানুষকে তার গুণাবলি দিয়ে বিচার না করে কেবল মানুষ হবার জন্যই ভালোবাসতে শেখায়। বই আমাদের ভেতরে জীবন বোধকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে এবং নতুন নতুন শব্দের সন্ধান দেয়। সেই শব্দ কেমন ভাবে নানা কায়দায় বাক্যে ব্যবহার হয়,সেটাও জানতে সাহায্য করে। বই আমাদের একাকীত্ব ঘুচিয়ে দেয় এবং রক্ত-মাংসে গড়া বন্ধুরা কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করলেও বই সেটা করে না, পড়লে জ্ঞান বাড়বেই। জ্ঞান অর্জনের জন্য বাস্তব অভিজ্ঞতা অন্য ক্ষেত্র। কিন্তু আমাদের সকলের বাস্তব অভিজ্ঞতা এক নয়।কারণ আমরা সকলেই একই রকম বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারি না। ফলে বই পড়লে সেই সকল আজানা অভিজ্ঞতার সন্ধান পাওয়া যায়, যে অভিজ্ঞতা জীবনে চলার পথে কাজে লাগে। আবার অধিক বই পড়ে জ্ঞান লাভ করলে সেই জ্ঞান জীবনে চলার পথে জটিল মুহূর্তে আমাদের পথ নির্দেশ করে। অপর দিকে বই থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা দেয়। এই ধারণা আমাদের কে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে। ফলে ভবিষ্যৎ অজানা হলেও সেই ভবিষ্যতের একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
স্মার্ট ফোন আর ইন্টারনেটের কারণে সেই বই আজকে ব্রাত্য। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং সভ্যতার চাকা একই সুতোয় গাঁথা। প্রতি মুহূর্তে প্রযুক্তির নতুন নতুন উদ্ভাবনে জীবন বদলে যাচ্ছে। তবে কথায় বলে, ‘বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ (গতি), কেড়ে নিয়েছে আবেগ (অনুভূতি)। প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা যেমন থামানো যাবে না, তেমনি সেটি করাও উচিত নয়। তবে এর অপপ্রয়োগ রোধ এবং সদ্ব্যবহার নিশ্চিত অবশ্যই করা দরকার । মানুষ সবকিছু সহজে, হাতের কাছে পেতে চায়। আজকের ইন্টারনেট প্রযুক্তি, স্মার্টফোন মানুষে মানুষে যোগাযোগ অতি সহজ করেছে। এটি যেন জাদুর কাঠি। আঙুল চাপতেই ভাগ্যের বরপুত্রের কাছে আলাদীনের দৈত্য এসে হাজির, ‘হুকুম দিন জাঁহাপনা, কী করতে পারি’। কী নেই মোবাইলে, সব রকম তথ্যই মেলে। ফলে মানুষকে পেয়ে বসেছে এক অদ্ভুত নেশা। যেখানে যায় সেখানেই ছোট-বড় সবার হাতে মোবাইল। সকাল, দুপুর, বিকাল, সন্ধ্যা, রাত- সারাক্ষণ হাতে মোবাইল, ফেসবুকে চোখ। ফেসবুক চর্চায় অনেকেরই বিনিদ্র রাত কাটে। এতে ঘুম ব্যাহত হয়। দিনের কাজে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। শ্রমশক্তির অপচয় হয়। কিশোর- কিশোরী, তরুণ- তরুণী, যুবক-যুবতী সবাই ব্যস্ত। এ কী কাণ্ড! বছরে একশ’ টাকার বই হাতে উঠবে না, কিন্তু দশ, বিশ, পঞ্চাশ হাজার টাকার মোবাইল সেট কিনতে টাকা যেন ভূতে জোগায়! অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারে স্নায়ুচাপ বাড়ছে, বিষণ্ণতা ভর করছে, দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তির ক্ষতি হচ্ছে। আগে শুনতাম, ‘তাস খেলে কত ছেলে পড়া নষ্ট করে, পরীক্ষা এলেই তাই চোখে জল ঝরে।’ এখন কেউ আর পরীক্ষার তোয়াক্কা করে না। কারণ ফেসবুকে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও মেলে! এভাবেই অনেকে জীবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । মনে রাখতে হবে, ‘সব নেশা খারাপ নেশা, বই পড়া ভালো নেশা’। এক্ষেত্রে অবশ্যই কাগজে ছাপানো বইয়ের কথা বলছি। লিপি আবিষ্কারের সময়ে কাগজ ছিল না,ছাপাখানা ছিল না। তখন কাঠ দিয়ে লিপি তৈরী হতো,যা মানুষের কাছে মূর্ত ছিল,পরে কাগজ ও ছাপাখানার হাত ধরে ছাপানো বই এসেছে। এখন ভার্চুয়াল মাধ্যমে বই পাওয়া যায়, যা নাড়া যায় না,ছোঁয়া যায় না,শুধুই মোবাইলের আলোতে চোখে দেখা যায়। এই ভাবে বই পড়া আর হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে পাতা উল্টিয়ে পড়ার মধ্যে তফাৎ কতটা রয়েছে। একথা আমাদের বুঝতে খুব বেশি জ্ঞানের দরকার আছে বলে মনে হয় না। সুতরাং বিষয়টি সবার গুরুত্ব সহকারে ভাবা দরকার। এই ভাবনা অপরের জন্য না ভাবলেও নিজের জন্য, নিজেদের সন্তানদের জন্য ভাবা দরকার। আজকাল অদ্ভুত একটা বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সেটা হলো আমরা একশো টাকা দিয়ে একটা বই কিনতে পারছি না,অথচ হাজার হাজার টাকা দিয়ে দামী স্মার্ট ফোন কিনতে পারছি। আবার এটাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে,কাউকে পয়সা ছাড়া উপহার দিলেও সে পড়ার সময় পাচ্ছে না,অথচ ঘন্টার পর ঘন্টা মোবাইল নিয়ে কখনও ফেসবুক, কখনও হোয়াইটস অ্যাপ খুলে বসে থাকছেন। বাড়ীর বড়দের দেখে দেখে এখন বাচ্চারাও বিষয়টা রপ্ত করে ফেলছে। এই সর্বনাশের হাত থেকে বাঁচাতে পারে একমাত্র বই পড়ার নেশা। একথা অনেকের হয়তো মনে হতে পারে যে- বই কিনলে লেখক বা প্রকাশকের লাভ হবে। কিন্তু বই না পড়লে তার চেয়ে বহুগুণ ক্ষতি হবে আমাদের এবং আমাদের সন্তানদের। তাই আর দেরি না করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বই উপহার দেওয়া থেকে আরম্ভ করে নিজেরাও বই কিনে পড়ার অভ্যাস তৈরি করা ভীষণভাবেই জরুরি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct