এটি সর্বজনবিদিত যে ১৯৯৫ সাল থেকে চিন তার সামরিক ব্যয় ১০ গুণ বাড়িয়েছে; এর সুবাদে তার হাতে এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় নৌবাহিনী ও উপকূলরক্ষী বাহিনী রয়েছে এবং এই শক্তিকে দেশটি প্রায়ই তার যুদ্ধবাদী সম্প্রসারণবাদকে এগিয়ে নিতে ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু এর পাশাপাশি চিনের সম্প্রসারণবাদকে সমর্থন করে এমন অনেক অস্বচ্ছ নীতি, অস্বচ্ছ প্রকল্প ও অসাধু কর্মতৎপরতা আছে, যা সবার নজরে কখনোই ততটা পড়ে না। খুব কম লোকই জানে এসব লুকোছাপা করা চিনা নীতি ও তৎপরতা গোটা বিশ্বকে হুমকিতে ফেলে দিয়েছে। লিখেছেন ব্রহ্ম চেলানি।
এটি সর্বজনবিদিত যে ১৯৯৫ সাল থেকে চিন তার সামরিক ব্যয় ১০ গুণ বাড়িয়েছে; এর সুবাদে তার হাতে এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় নৌবাহিনী ও উপকূলরক্ষী বাহিনী রয়েছে এবং এই শক্তিকে দেশটি প্রায়ই তার যুদ্ধবাদী সম্প্রসারণবাদকে এগিয়ে নিতে ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু এর পাশাপাশি চিনের সম্প্রসারণবাদকে সমর্থন করে এমন অনেক অস্বচ্ছ নীতি, অস্বচ্ছ প্রকল্প ও অসাধু কর্মতৎপরতা আছে, যা সবার নজরে কখনোই ততটা পড়ে না। খুব কম লোকই জানে এসব লুকোছাপা করা চিনা নীতি ও তৎপরতা গোটা বিশ্বকে হুমকিতে ফেলে দিয়েছে। চুপিসারে চালানো তৎপরতার মাধ্যমে নিজের কৌশলগত অবস্থানের সীমা বাড়ানোর এবং নির্লজ্জভাবে সেই তৎপরতার কথা অস্বীকার করার ক্ষেত্রে চিনের রেকর্ড দীঘদিনের। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, হর্ন অব আফ্রিকাভুক্ত ছোট্ট দেশ জিবুতিতে ২০১৭ সালে চিন সামরিক ঘাঁটি গড়েছে। এর মাধ্যমে চিন প্রথমবারের মতো বিদেশে কোনো সামরিক ঘাঁটি গাড়ল। চিনের কাছ থেকে নেওয়া জিবুতির বিশাল অঙ্কের ঋণের দায়ের সঙ্গে এই ঘাঁটি গড়ার যোগসাজশের গুঞ্জন থাকলেও চিন বরাবরই তা অস্বীকার করে আসছে।বর্তমানে চিন কম্বোডিয়ায় একটি নৌঘাঁটি বানাচ্ছে। কম্বোডিয়া তার উপকূলের এক-পঞ্চমাংশ এলাকা ও বেশ কয়েকটি দ্বীপ চিনের কাছে ইজারা দিয়েছে। চিনের অর্থায়নে কম্বোডিয়ার নৌ ঘাঁটির জেটির কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। এই জেটির আকার-আকৃতি ও নকশার সঙ্গে জিবুতিতে চিনের গড়া ঘাঁটির জেটির আকার ও নকশায় অনেক মিল রয়েছে। এই ঘাঁটিতে চিন বিনিয়োগ করার কথা স্বীকার করলেও এর পরিচালন কাজে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা থাকবে না বলে দাবি করেছে। চিন বলেছে, ওই নৌ ঘাঁটিতে কেবল কম্বোডিয়ার নৌ বাহিনীর প্রবেশাধিকার থাকবে; অন্য কারও নয়। উহান প্রদেশ থেকে একটি নতুন করোনাভাইরাস ছড়ানোর তথ্যপ্রমাণ হাজির হওয়ার পর চিন যদি দ্রুত সে বিষয়টিকে আমলে নিত এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিত, তাহলে আগে থেকেই সবাই সতর্ক হতে পারত। আগে থেকে সতর্কতা অবলম্বন করলে যে পরিমাণ প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা হয়তো হতো না। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক, চিন সরকার প্রথম দিকে পুরো বিষয়টি চেপে গেছে এবং এর খেসারত হিসেবে সারা বিশ্বে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে কমপক্ষে ৭০ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটিয়েছে। তবে বাস্তব অবস্থা বলছে, চিনের নৌবাহিনী ওই ঘাঁটিটি ব্যবহার করবে, নিদেনপক্ষে চিন এখানকার সামরিক সরঞ্জামের সুবিধা নেবে। দক্ষিণ চিন সাগরে সাতটি কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়ে সেগুলোকে সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারোপযোগী করে তুলে চিন এমনিতেই সেখানে নিজের অবস্থান শক্ত করেছে; কম্বোডিয়ার ঘাঁটি ব্যবহার করতে পারলে তা তাকে আরও শক্তি জোগাবে। ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যবর্তী করিডরের ওপর চিনের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হবে।
যে তিব্বত মালভূমি থেকে ভাটির দিকের বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক নদীগুলো ছড়িয়ে পড়েছে, সেই তিব্বত মালভূমিকে দখল করে চিন এখন তলেতলে সেখানে বড় বড় বাঁধ প্রকল্প করছে। এর মাধ্যমে চিন অন্য দেশগুলোর দিকে প্রবহমান নদীর গতিপথকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। চিন ও ভারতের ভারী সামরিক সজ্জায় সজ্জিত সীমান্তের খুব কাছেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা চিনের রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্ট ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস ২০২১ সালে অনুমোদন করেছে। তবে ওই প্রকল্পের হালনাগাদ অবস্থা সম্পর্কে চিন জনসমক্ষে কিছুই প্রকাশ করেনি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎকেন্দ্র থ্রি জর্জেস ড্যাম যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে, প্রস্তাবিত এই নতুন বাঁধ থেকে তার তিন গুণ বেশি বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা যাবে। এই প্রকল্প এলাকায় নির্মাণসামগ্রী ও কর্মী পরিবহন করতে চিন সরকার একটি নতুন রেলপথ ও মহাসড়ক তৈরি করেছে। তবে প্রকল্পটি কদ্দুর এগিয়েছে, তা আমরা বলতে পারছি না। বাণিজ্যিকভাবে উপলব্ধ স্যাটেলাইট চিত্র থেকে লুকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না—প্রকল্পটির কাজ কেবল সেই পর্যায়ে পৌঁছানোর পরই আমরা এর নির্মাণকাজ সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য পাব। তবে সেটি হবে নির্মাণকাজের প্রায় শেষ পর্যায়। মেকং নদীতে বিশাল বিশাল ১১টি বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে চিন এই চুপিসারে কাজ সারার নীতি অনুসরণ করেছে। এই বাঁধগুলোর মাধ্যমে শুধু প্রতিবেশীদের তুলনায় বেশি ভূরাজনৈতিক সুবিধা অর্জন করেনি, এগুলো পরিবেশগত বিপর্যয়ও ঘটিয়েছে। বর্তমানে চিন হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বাঁধ দেওয়া দেশ এবং শুধু মেকং নদীতেই তারা আরও আটটি বাঁধ দিচ্ছে। চিনের কারণে অস্বচ্ছতাও ঋণ দেওয়ার একটি সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা চিনকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সার্বভৌম ঋণদাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। গত এক দশকে চিন বিভিন্ন দেশকে যত ঋণ দিয়েছে, তার প্রায় সব কটিতে একটি গোপনীয়তার শর্তবিশিষ্ট অনুচ্ছেদ জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ওই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ঋণ নেওয়া দেশ ঋণ পাওয়ার শর্ত গোপন রাখতে বাধ্য হয়ে থাকে। চিনের এই ঋণের ফাঁদে ইতিমধ্যে আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার বেশ কিছু দেশ পা দিয়েছে। ঋণের কিস্তি শোধ দেওয়া প্রশ্নে এসব দেশ চিনের চাপের মুখে পড়ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে চিনের জন্য আর্থিক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণ করায় সহায়ক চিনা শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, চিন ঋণের চুক্তিতে এমনভাবে শর্ত সন্নিবেশ করে, যার ফলে ঋণগ্রহীতার নীতির সঙ্গে একমত না হলে বেইজিং পাস করা ঋণ বাতিল পর্যন্ত করতে পারে। তবে কোভিড-১৯ মহামারির তথ্য গোপন করে চিন সারা বিশ্বের যে ক্ষতি করেছে, তা দেশটির তথ্য চেপে যাওয়া ও লুকোছাপার নীতি কৌশল অনুসরণের নিকৃষ্টতম উদাহরণ। উহান প্রদেশ থেকে একটি নতুন করোনাভাইরাস ছড়ানোর তথ্যপ্রমাণ হাজির হওয়ার পর চিন যদি দ্রুত সে বিষয়টিকে আমলে নিত এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিত, তাহলে আগে থেকেই সবাই সতর্ক হতে পারত। আগে থেকে সতর্কতা অবলম্বন করলে যে পরিমাণ প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা হয়তো হতো না। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক, চিন সরকার প্রথম দিকে পুরো বিষয়টি চেপে গেছে এবং এর খেসারত হিসেবে সারা বিশ্বে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে কমপক্ষে ৭০ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটিয়েছে। এমনকি শুধু চিনের অসহযোগিতা ও তথ্য দিতে অস্বীকৃতির কারণে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা কোভিড-১৯ এর মূল উৎসস্থল সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেননি। আন্তর্জাতিক আইনকানুন ও বিধি লঙ্ঘনের দিকে চিনের ঝোঁক তার অস্বচ্ছতার সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে। হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসন রক্ষা করা এবং দক্ষিণ চিন সাগরকে সামরিকীকরণ না করার বিষয়ে চিন যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেগুলোসহ বহু প্রতিশ্রুতি চিন ধারাবাহিকভাবে লঙ্ঘন করে এসেছে।ভারতের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ হিমালয় সীমান্তের বিদ্যমান স্থিতাবস্থাকে একতরফাভাবে পাল্টে না দেওয়ার বিষয়ে চিনের যে প্রতিশ্রুতি ছিল, তা বেইজিং নিষ্ঠুরভাবে লঙ্ঘন করেছে এবং শুধু চিনের অনুপ্রবেশের কারণে দুই দেশের মধ্যে তিন বছর ধরে সেখানে সামরিক অচলাবস্থা চলছে। রাশিয়া যেভাবে ইউক্রেনে সর্বাত্মক অভিযান চালিয়েছে, চিন সেভাবে প্রকাশ্য অভিযান চালায় না। চিন ধীরে ধীরে ধূর্ততার সঙ্গে চোরাগোপ্তাভাবে তার নিশানা করা দেশটির দিকে এগোতে থাকে। একদিকে সে চুপিসারে এগোয়, অন্যদিকে প্রচণ্ড অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। এই দুটি কৌশলই তাকে পশ্চিমাদের নিষ্পত্তিমূলক প্রতিক্রিয়া থেকে এখন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছে।
সৌ: প্র: আ:
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
ব্রহ্ম চেলানি নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের অধ্যাপক এবং বার্লিনের রবার্ট বোচ একাডেমির একজন ফেলো
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct