আব্দুস সামাদ মন্ডল,কলকাতা,আপনজন: আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রনেতার রহস্যজনক হত্যাকে ঘিরে হাওড়ার গ্রামের সঙ্গে শহর কলকাতার রাজপথ শনিবার গর্জে উঠল প্রতিবাদে। কলকাতার পার্কসার্কাসের সেভেন পয়েন্টে আলিয়া বিশ্বদবিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। দোষীদের শাস্তির দাবিতে পদযাত্রার পর দীর্ঘক্ষণ পথ অবরোধ করে যানচলাচল অবরুদ্ধ করে তোলে। ফলে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। ঘটনার সূত্রপাত আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রনেতাকে পুলিশের ছদ্মবেশে এসে তিনতলার ছাদ থেকে ফেলে রহস্যজনকভাবে হত্যা করার অভিযোগকে কেন্দ্র করে। ঘটনাটি ঘটেছে হাওড়ার আমতা থানার সারদা দক্ষিণ খাঁ পাড়ায়। নিহত আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরের ছাত্র আনিস খান (২৮)-এর বাবা সালাম খানের অভিযোগ, শুক্রবার জলসা শুনে রাত ১টা নাগাদ বাড়িতে ফেরেন আনিস। এরপর রাতে পুলিশ পরিচয়ে এসে চারজন আনিসের খোঁজ করেন। তিনি দরজা খুললে একজন তাঁর সঙ্গে থাকেন আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে। বাকি তিনজন আনিসকে নিয়ে উপরে চলে যায়। এরপর তারা ছেলেকে ছাদ থেকে তুলে নিচে ফেলে দেওয়ায় মাথায় আঘাত লেগে আনিসের মৃত্যু হয় বলেও অভিযোগ তার। যারা পুলিশ পরিচয়ে এসেছিলেন এদের মধ্যে একজন পুলিশের পোশাকে ছিলেন। বাকি তিনজন সাধারণ পোশাকে ছিলেন। এত রাতে আনিসকে খোঁজার কারণ হিসেবে তারা জানায়, বাগনান থানার এক মামলায় আনিস অভিযুক্ত। সেই কেসে জামিন হয়নি বলে এসেছে আনিসকে ধরতে। তিনি জানেন না এমন ঘটনা কেন ঘটল। তাঁর বক্তব্য, আনিস কলকাতা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা করে প্রতি সপ্তাহে সে এখানে যাতায়াত করে। এর পাশাপাশি সে ছাত্র রাজনীতিও করে। বিশেষ সূত্রে জানা গেছে, আনিস আমতা কলেজে এসএফআর করতেন। শনিবার মুহাম্মদ সেলিম সহ বাম নেতাদের ফেসবুক পোস্টে তা স্পষ্ট করেন। তবে পরে আইএসএফ দল তৈরি হলে তাতে আনিস শামিল হন বলে তার ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর। স্থানীয় বাসিন্দা আসমিন খান জানান, ১টা নাগাদ পুলিশ বাড়িতে এসে আনিসের খোঁজ করে। এরপর একজন বাইরে থাকে বাকি তিনজন উপরে উঠে যায়। তার মিনিট পাঁচেক পর তারা আনিসকে ফেলে দেয় ছাদ থেকে। এরপর তারা অন্য রাস্তা দিয়ে চম্পট দেয়। এলাকার বাসিন্দাদের বক্তব্য আনিস এলাকায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী মুখ ছিলেন। অসামাজিক কাজ হলে তার প্রতিবাদ করতেন। ভালো ছেলে হিসেবে এলাকায় পরিচিত ছিল। তাই তারা চাইছেন যারা এমন কাজ করেছেন ঘটনার প্রকৃত তদন্ত করে যেন সেই দোষীদের শাস্তি হয়।
এদিকে খবর ছড়িয়ে পড়তেই এলাকাবাসী জমা হয়ে যায়। খবর পেয়ে আসে আমতা থানার পুলিশ। পুলিশকে প্রথমে দেহ তুলতে দেয়নি স্থানীয় বাসিন্দারা। দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের ধরার দাবি জানান তাঁরা। শেষে দশটার পর পুলিশ এসে দেহ উদ্ধার করে নিয়ে যায়। আমতা থানার পুলিশ জানিয়েছে, তাঁদের তরফ থেকে কোনও তল্লাশি চালানো হয়নি। এই গ্রেপ্তারি সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না। বাগনান থানার পুলিশও জানিয়েছে, তাদের তরফ থেকে কেউ তল্লাশি করতে যায়নি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, পুলিশের ছদ্মবেশে দুষ্কৃতীরাই এসেছিল? তার মৃত্যুর আঁচ জেলা ছাড়িয়ে শহর কলকাতাতেও। শনিবার সন্ধেবেলা পার্কসার্কাস সেভেন পয়েন্টের কাছে অবরোধে নামলেন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র ছিলেন আনিস। মানববন্ধন করে তাঁরা অবরোধ করেন। যার জেরে যানবাহন স্তব্ধ হয়ে পড়ে। দীর্ঘক্ষণ ধরে চলা অবরোধ হঠাতে গেলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে প্রতিবাদীদের। পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
আনিস সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের এক পরিচিত মুখ। মন্ত্রী মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলেন, হাওড়ার আমতায় ছাত্রনেতা আনিস খান খুনের ঘটনা কলকাতার ‘ট্রেন্ড’ নয়। এমন ঘটনা উত্তরপ্রদেশের হয়। শনিবার এই ঘটনা নিয়ে এমনই মন্তব্য করলেন কলকাতার মেয়য় ফিরহাদ হাকিম। তিনি আরোও বলেন, নৃশংস ঘটনা। কে করেছে, কী উদ্দেশ্যে করেছে, তা তদন্ত করে দেখতে হবে। পুলিশ তদন্ত করছে। অভিযুক্তরা কী করে পুলিশের পোশাক পেল। এর পিছনে বড় কোনও ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। অন্য রাজ্য থেকে এসে কেউ এই খুন করেছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে। এই ধরনের ঘটনা উত্তরপ্রদেশে হয়। এটা কলকাতার ট্রেন্ড নয়। মেয়র এই ঘটনায় দোষীদের কঠোর শাস্তির দাবি করেন। ঘটনার খবর পেয়ে আনিসের বাড়িতে যান আমতার বিধায়ক সুকান্ত পাল। তিনি বলেন, অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। এই ঘটনার সঙ্গে কে বা কারা জড়িত রয়েছে পুলিশ যথাযথ তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করুক। দুপুরের দিকে সেখানে যান ভাঙড়ের বিধায়ক তথা আইএসএফ নেতা নওশাদ সিদ্দিকী। তিনি আমতা থানায় যান এবং আমতা থানার পুলিশ কর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। থানায় আসা আনিসের বাবা ও দাদার সঙ্গে কথা বলেন। নওশাদ সিদ্দিকি বলেন, অত্যন্ত খারাপ ঘটনা। আমরা পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছি। পুলিশ এরপর তারা জানিয়েছেন তাদের পক্ষ থেকে কেউ ওই এলাকায় তল্লাশি করতে যায়নি। তাই পুলিশ পুরো ঘটনার যথাযথ তদন্ত করুন এবং দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করুক। তিনি প্রশ্ন তোলেন যদি পুলিশ না যায় তাহলে কারা পুলিশের পোশাক পড়ে এই ঘটনা ঘটাল সে ব্যাপারে পুলিশ যথাযথ তদন্ত করুক। ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা মেহেরাব সিদ্দিকী এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, কাল রাতে আমার সঙ্গে জলসায় ছিল আনিস। একটু রাত গভীর হতে সে বাড়ি চলে যায়। সকালে খবর দেখি তার মৃত্যু এই এর তীব্র নিন্দা জানাই এবং সিবিআই তদন্তের জন্য অনুরোধ করছি। অপরদিকে ছাত্র সংগঠন স্টুডেন্টস্ ইসলামিক অর্গানাইজেশন অফ ইন্ডিয়ার পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতি সাবির আহমেদ বলেন, আনিস খান সমাজের একজন প্রতিবাদী কণ্ঠ ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, সিএএ-এনআরসি আন্দোলনের প্রথম সারিতে থাকা আনিশ খানের প্রতিবাদী কণ্ঠ রোধ করতেই তাঁর এই পরিণতি হল কি না খতিয়ে দেখতে হবে। সাবির আহমেদ তাঁর পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে বলেন, আনিস খানের পরিচয় হল তিনি একজন প্রতিবাদী ছাত্র। আমরা ন্যায় বিচারের লড়াইয়ে পরিবারের পাশে আছি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct