ইউরোপের দেশ সুইডেনের বিভিন্ন শহরে বিশেষ করে নরকপিং, লিংকোপিং, রিঙ্কেবি, মালর্মো, ওরেব্রো ও রাজধানী স্টকহোমে সপ্তাহান্তে সংঘর্ষ ও সহিংসতা শুরু হয়। রাসমুস পালুদান একজন ডেনিস-সুইডিশ চরমপন্থী যার নেতৃত্বে সুইডেনের অতি-ডান, অভিবাসী-বিরোধী, ইসলামবিরোধী গ্রুপ স্ট্রাম কুরস বা হার্ডলাইন সংগঠনের পরিকল্পনা অনুযায়ী রমজান মাসে পবিত্র কুরআনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। আগামীতে কুরআন পোড়ানোর ঘটনা আরো ঘটানোর ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি। এটি সুইডেনের মতো সার্বভৌম দেশের নাগরিক আইন এবং রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধের পরিপন্থী। সে সম্পর্কে অকপট বিশ্লেষণ করেছেন খালিদ হোসেন। আজ শেষ কিস্তি।
২০১১ সালে লুই থেরাক্স ডকুমেন্টারি আমেরিকাস মোস্ট হেটেড ফ্যামিলি ইন ক্রাইসিসে, ওয়েস্টবোরো ব্যাপটিস্ট চার্চের মেগান ফেলপস এক সাক্ষাৎকারে ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এবং প্রকাশ্যে কুরআনের একটি কপি পুড়িয়েছে। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন সামরিক বাগরাম বিমান ঘাঁটিতে কুরআন অবমাননার জন্য আফগানিস্তানের বিভিন্ন অংশে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভকারীরা ‘আমেরিকার মৃত্যু হোক’ স্লোগান দেয় এবং মার্কিন পতাকা পুড়িয়ে দেয়। এতে অন্তত ৩০ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়। এতে ছয়জন মার্কিন সেনা প্রাণ হারায়। ২০১৬ সালের ৩১ জুলাই নরম্যান্ডি চার্চে হামলার কয়েক দিন পর, মাল্টার মেটার দেই হাসপাতালের প্রার্থনা কক্ষে কুরআনের বেশ কয়েকটি কপি অপবিত্র করা হয়েছিল। পবিত্র ধর্মগ্রন্থের ভেতরে শূকরের মাংসের টুকরা রাখা হয়েছিল। হামলাকারীরা ক্যাথলিক ধর্মযাজক জ্যাক হ্যামেলের একটি ছবিও রেখে যায়, যার ক্যাপশন ছিল ‘ভিকটিম অব ইসলাম’। এ ছাড়া বিভিন্ন মুসলিম দেশে কে বা কারা রাতের অন্ধকারে নালা নর্দমা ও ডোবায় পবিত্র কুরআন নিক্ষেপ করে। সৌদি আরবের তায়েফেও এমন বহু ঘটনা সংঘটিত হয়।
২০১৭ সালের পিউ রিসার্চের একটি প্রতিবেদনে সুইডেনের ১০ মিলিয়ন মোট জনসংখ্যার ৮.১ শতাংশ (প্রায় আট লাখ ১০ হাজার) মুসলিম বলে প্রকাশ করা হয়েছে। আধুনিক সুইডেনে প্রথম নিবন্ধিত মুসলিম গোষ্ঠী ছিল ফিনিশ তাতার যারা চল্লিশের দশকে ফিনল্যান্ড ও এস্তোনিয়া থেকে অভিবাসিত হয়েছিল। ষাটের দশকে অভিবাসন সুইডেনে ইসলাম ছড়িয়ে দেয়ার প্রধান চালিকাশক্তি। সত্তরের দশকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে অভিবাসনের সাথে সুইডেনে ইসলামের লক্ষণীয় উপস্থিতি শুরু হয়। সাবেক যুগোশ্লাভ প্রজাতন্ত্র এবং সম্প্রতি সোমালিয়া থেকে অভিবাসীদের আরো ঢেউ সুইডেনে এসেছিল। ইরাক, সোমালিয়া ও আফগানিস্তান থেকে আসা অভিবাসীরাই সুইডেনে বসতি স্থাপন করে। সুইডেনে বেশ কয়েকটি মসজিদ রয়েছে। ১৯৮৪ সালে মালমে মসজিদ এবং পরে ১৯৯৫ সালে উপসালা মসজিদ নির্মিত হয়। ’২০-এর দশকে আরো মসজিদ নির্মিত হয়, যার মধ্যে রয়েছে স্টকহোম মসজিদ (২০০০), উমিয়া মসজিদ (২০০৬) ও ফিট্টজা মসজিদ (২০০৭), স্টকহোমে বাংলাদেশ জামে মসজিদ, হ্যানিং (দক্ষিণ স্টকহোম) ব্র্যান্ডবার্গেন মসজিদ, স্কোগাস মসজিদ, গোথেনবার্গ (হিসিঙ্গেনে) তুর্কি মসজিদ ও গুরাবা মসজিদ প্রভৃতি। সৌদি আরব ও লিবিয়া সরকার সুইডেনের কয়েকটি বৃহত্তম মসজিদ নির্মাণে আর্থিকভাবে সহায়তা করেছে। ২০১৬ সালে গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ এসওএম জরিপে, ৫৩ শতাংশ সুইডিশের মধ্যে ইসলামের ধারণা নেতিবাচক যেখানে ৭ শতাংশ ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে, ৪০ শতাংশ অমীমাংসিত। সুইডেনের বিভিন্ন স্থানে ইসলামিক কালচারাল সেন্টার, মুসলিম সোসাইটি, মহিলা সমিতি, দাওয়াহ কমিটি ধর্মপ্রচার, কুরআন শিক্ষা, কমিউনিটি উন্নয়নের কাজ করে যাচ্ছে। সুইডেনে বসবাসকারী মুসলমানরা রাষ্ট্রীয় আইন ও বিধিবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও নিয়মরীতি মেনে চলতে অভ্যস্ত। যেকোনো মূল্যে তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। চরম উসকানির মুখেও তারা সহনশীলতা ও ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। (সমাপ্ত...)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct