সাদ্দাম হোসেন, জলপাইগুড়ি, আপনজন: লক্ষ্মীপুজো তাই সেজে উঠছে গোটা গ্রাম। দুর্গা অথবা কালীর আরাধনা হয়না গ্রামে। শুধুমাত্র লক্ষ্মীর আরাধনায় মাতেন গোটা গ্রাম। তাই লক্ষ্মীর গ্রাম নামেই পরিচিত জলপাইগুড়ি জেলার বানারহাট ব্লকের দুরামারি।প্রায় প্রতিটি বাঙালির ঘরে ঘরে মা লক্ষ্মী পূজিত হন দেবী পক্ষের শেষের কোজাগরী পূর্ণিমাতে। কিন্তু এই ধন ও সৌভাগ্যের দেবী মা লক্ষ্মীর পূজাকে কেন্দ্র করে জঙ্গল ঘেরা ডুয়ার্সের প্রত্যন্ত গ্রাম দুরামারিতে মেতে ওঠে সর্বজনীন লক্ষ্মী পুজোর আকারে।কোজাগরী লক্ষ্মী সাধারণত প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে পূজিত হয়ে থাকে। কিন্তু ব্যতিক্রমী জলপাইগুড়ি জেলার দুরামারি গ্রাম। এখানে লক্ষ্মীদেবী কোজাগরী হিসেবে পূজিত হলেও সর্বজনীন ভাবেও তিনি পূজিত হন গোটা গ্রাম জুড়ে। দুরামারি এলাকায় লক্ষ্মী ছাড়া অন্য কোন দেবদেবীর আরাধনা সেভাবে হয় না। এমন কি দুর্গা বা কালী পুজোর আয়োজন করা হয়না সেই ভাবে।শালবাড়ি এক নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত দুরামারির গ্রামে গ্রামে লক্ষ্মী দেবী ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৪০থেকে ৪৫ টি পুজো আয়োজন করা হয়। গ্রামের মানুষ শুধু লক্ষ্মী আরাধনাই করে থাকেন । দুর্গাপুজো বা কালীপুজোর মতোই আলোকসজ্জায় সাজিয়ে তোলা হয় গোটা গ্রামকে। চলে বহিরাগত শিল্পীদের নিয়ে রাতভর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। লক্ষ্মী পুজোকে কেন্দ্র করে বসে বিরাট মেলা। সুন্দর ঝলমলে আকাশ। সন্ধ্যায় হেমন্তের আকর্ষন। প্রতি বছরের মতো এবারও লক্ষ্মীর আরাধনায় মেতে উঠবে ধূপগুড়ি মহাকুমার ছোট্ট জনপদ দুরামারি গ্রাম। মঙ্গলবার লক্ষ্মীপুজো আর সেদিন থেকেই শুরু হবে লক্ষ্মী দশমীর মেলা। ডুয়ার্সের খুট্টিমারি জঙ্গল থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার পশ্চিমে নাথুয়াহাট রাজ্য সড়কে দুরামারি। চারদিকে তিন ফসলি জমিতে ঘেরা একটি কৃষি বলয়। বাসিন্দারা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন তাদের লক্ষ্মী দেবীর পা কোনদিন পড়বে গ্রামে। দুর্গাদেবী তাঁদের কাছে নিয়ম রক্ষার পুজো। কিন্তু মায়ের চেয়ে মেয়ের কদর বেশি এখানকার বাসিন্দাদের কাছে। মেয়ে লক্ষ্মীই যেন তাঁদের প্রানের দেবী। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা এই দিনগুলির জন্য স্কুলের টিফিন বাঁচিয়ে মাটির ঘটে পয়সা জমায়। দুর্গাপূজাতেও সেই ঘট ভাঙা হয়না। লক্ষ্মী পুজো শুরু হতেই ঘট ভেঙে টাকা পয়সার হিসাব চলে। ফের মেলা থেকে কেনা হয় মাটির ঘট। পরের বছরের লক্ষ্মী পুজোর মেলার জন্য পয়সা জমানোর পালা। বড়দের চিন্তা, দুর্গাপুজোয় নতুন জামা না হলেও লক্ষ্মী পূজায় লাগবেই। এলাকার বাসিন্দাদের কাছে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি প্রতিটি বাড়ি ভরবে আত্মীয় স্বজনে।
এলাকার বাসিন্দা ঝর্না সরকার, লিনা দে-রা বলেন, “ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই এই পুজো ও মেলায় একাকার হয়ে যাই। এলাকার যত ধনী-গরীব যত বাসিন্দা আছে সবার বাড়িতে কুটুম্বে ভর্তি হয়। কারও কারও বাড়িতে হয়ত অসম, শিলিগুড়ি, কোচবিহার বা যার যত দূরেই আত্মীয় থাক লক্ষ্মী পুজোয় দুরামারি আসবেই। চার-পাঁচ দিন সবাই আত্মীয় পরিজনদের নিয়ে পুজো, মেলা দেখে হইহুল্লোর করে কাটাই।” দুরামারি বাজার, হাইস্কুল, একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও চারপাশের এক দেড় কিলোমিটার এলাকার মধ্যে বিভিন্ন পাড়ায় বিভিন্ন ক্লাব রয়েছে। শান্তিপাড়া তরুন সংঙ্ঘ, কাশিয়াবাড়ি ভাই ভাই ক্লাব, বাবুপাড়া, মধ্যপাড়া, নিউ গ্রীন স্পোটিং ক্লাব সহ ৪১ টি সার্বজনীন লক্ষ্মী পুজো হয় ধুমধামের সঙ্গে। শহরের পুজোর মত এখানেও কমিটিগুলোর মধ্যে মন্ডপ ও আলোকসজ্জা নিয়ে রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। গৃহস্থের বাড়ির পূজাও বাদ থাকেনা। দু’তিন দিন মন্ডপে প্রতিমা রাখতে হয় দর্শনার্থীদের ভিড় সামলাতে। দুই দিন মেলার মাঠে চলবে প্রতিমা প্রদর্শনীও। সেই সঙ্গে চলবে মেলা। সার্বজনীন প্রতিমা গুলো বির্সজন হলেও গৃহস্থের ঘরের অনেকে প্রতিমা প্রদর্শনী করে তা বাড়িতে রেখে সারা বছর পুজো করেন।লক্ষ্মী এখানে একা আসেন না। তার সঙ্গে থাকে জয়া-বিজয়া নামে দুই সখি, থাকে ডানা মেলে পরীরাও। এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে লক্ষ্মী পূজায় আনন্দে মেতে উঠে গয়েরকাটা, বানারহাট, নাগরাকাটা, নাথুয়াহাট সহ বিভিন্ন ডুয়ার্সের বিভিন্ন আসা এলাকার বাসিন্দারাও। দল বেঁধে আসে মোগলকাটা, তোতাপাড়া, গয়েরকাটা সহ বিভিন্ন চা বাগানের শ্রমিক ও বনবস্তির মানুষরা। মেলা উদ্বোধন করতে আসার কথা মন্ত্রী ও বিধায়কদের।৪৩তম দুরামারি লক্ষ্মী পূজা ও মেলা কমিটির সম্পাদক দীনেশ্বর রায় বলেন বলেন, “ এখানে দুর্গা পুজোর থেকে বেশি আনন্দ করি লক্ষ্মী পুজোয়। সব জাতি ধর্ম মিলে একাকার হয়ে যায় লক্ষ্মী পুজো ও মেলার ক’দিন। খুব শান্তি প্রিয় পরিবেশে আনন্দে মেতে উঠে সবাই। আমরা কৃষক মানুষ। মা লক্ষ্মীর কৃপায় পেটে অন্ন জোটে। সেই বিশ্বাসেই আমরা মা লক্ষ্মীর আরাধনায় উৎসব করি। সবার ঘরে ঘরে আত্মীয় স্বজনে ভর্তি থাকে।”
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct