জান্নাতুল নাঈম: আধুনিক প্রজন্মের কাছে স্মার্ট ফোন মহার্ঘ্য। বিজ্ঞানের যুগে স্মার্ট ফোন এখন দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। সাশ্রয়ী মূল্য, আকর্ষণীয় সুবিধাদি ও সহজলভ্য হওয়ায় স্মার্ট ফোনের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের উচ্চবিত্ত থেকে মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে।
পূর্বে ফোন বলতে শুধু ভয়েস কল ও খুদে বার্তা পাঠানোর সুবিধাকে বোঝানো হতো। কিন্তু বর্তমানে এই সুবিধার পাশাপাশি দুই প্রান্তের ব্যবহারকারীকেও সামনাসামনি দেখা যায়। টেলিফোনের আবিষ্কারক আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল সে সময় বলেছিলেন, ‘এমন এক সময় আসবে যখন মানুষ টেলিফোনে শুধু কথাই বলবে না, তারা দুজন পরস্পরকে দেখতেও পারবে।’ বর্তমানে গ্রাহাম বেলের এ ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তার উল্লিখিত সেই টেলিফোন রূপান্তরিত হয়ে বর্তমানে স্মার্ট ফোন নামে পরিচিত।
স্মার্ট ফোনে ওয়াইফাই বা ডাটা সংযোগের মাধ্যমে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিনা মূল্যে হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, জুম, গুগল মিট, স্কাইপের মতো অ্যাপ্লিকেশনে কথা ও মিটিং সম্পন্ন করা যায়। জিপিএস-এর কার্যকরী অ্যাপ গুগল ম্যাপ ব্যবহার করে অপরিচিত জায়গা খুঁজে বের করা যায়। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, ছবি, ভিডিও, লিংক, পিডিএফ, ডকুমেন্ট সংরক্ষণ, আদান-প্রদান ও প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়। নোটিফিকেশনের মাধ্যমে ফোনে নতুন কোনো তথ্য ও ক্যালেন্ডারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট মনে করিয়ে দেয়, এছাড়া ঘড়ি, অ্যালার্ম, নোটবুক, ক্যামেরা, অনুবাদক ইত্যাদি হিসেবে স্মার্ট ফোন ব্যবহার করা যায়।
শিশুদের কান্না থামাতে ও খাবার খাওয়ানোর সময় অনেক অভিভাবক স্বেচ্ছায় কম বয়সের সন্তানের হাতে স্মার্ট ফোন তুলে দিয়ে থাকে। এটিকে প্রথম অবস্থায় তেমন ক্ষতিকর মনে না হলেও পরবর্তীতে এটি শিশুর পূর্ণ মানসিক বিকাশে, পারস্পরিক যোগাযোগের দক্ষতায় ও লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অতিরিক্ত স্মার্ট ফোন ব্যবহারে চোখের সমস্যা হতে পারে। কম বয়স থেকে অবাধে স্মার্ট ফোন ব্যবহার করার ফলে স্মার্ট ফোনের প্রতি আসক্তি ও সাইবার অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও থেকে যায়।
স্মার্ট ফোন আছে অথচ সেলফি তোলেন না এমন লোকের সংখ্যা খুবই নগণ্য। তবে অতিরিক্ত সেলফি তোলার সঙ্গে মানসিক রোগের সম্পর্ক রয়েছে। অতিরিক্ত সেলফি উঠিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করার মানসিক সমস্যাকে ‘সেলফিটিস’ বলে। আমেরিকান সাইক্রেটিক অ্যাসোসিয়েশন (এপিএ) সেলফিটিসকে মানসিক রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মার্ক ডি গ্রিফিথস এবং জনার্থনান বালাকৃষ্ণান ‘যৌবনে অতিরিক্ত সেলফি তোলার মানসিক প্রভাব’ শিরোনামে প্রকাশিত গবেষণায় সেলফিটিসকে তিন স্তরে ভাগ করেন। প্রথমে স্তর ‘বর্ডার লাইন সেলফিটিস’ অর্থাৎ মানসিক সমস্যায় এই স্তরে দিনে তিনবার ছবি তোলা কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট না করা। দ্বিতীয় স্তর ‘একিউট সেলফিটিস’ এ স্তরে প্রতিদিন অন্তত তিনটি সেলফি উঠানো এবং সবগুলো সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট দেওয়ায় হয়। সর্বশেষ স্তর ‘ক্রনিক সেলফিটিস’ এ স্তরে, দিনে অন্তত ছয় বার সেলফি উঠিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করা হয়।
আমরা সাধারণত একটা জিনিস খেয়াল করি যে, রাতে স্মার্ট ফোন ব্যবহার করা ছাড়া অন্য কাজ করার সময় ঘুম ঘুম ভাব তুলনামূলক বেশি হয়। অতিরিক্ত রাত জেগে স্মার্ট ফোন ব্যবহারের ফলে ফোনের স্কিনের উজ্জ্বল আলো মস্তিষ্কের মেলাটোনিন হরমোনকে নিঃসৃত হতে বাধা দিয়ে মস্তিষ্ককে দিন ভাবতে প্ররোচিত করে। ফলে ফোনে নিবদ্ধিত মস্তিষ্ক জাগ্রত ও সজাগ থাকে। অতিরিক্ত রাত জাগার ফলে কর্মোদ্যমতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, মানসিক সমস্যা ও ত্বকের সৌন্দর্য কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বর্তমানে স্মার্ট ফোন আমাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু কিন্তু সেই বন্ধুই আমাদের জীবনকে ঠেলে দিচ্ছে ধ্বংসের দিকে। এক গবেষণা থেকে জানা যায় যে, এক জন স্মার্ট ফোন ব্যবহারকারী গড়ে ২ হাজার ৬১৭ বার এবং সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৪২৭ বার ট্যাপ, সোয়াইপ ও ক্লিক করে থাকে। অতিরিক্ত স্মার্ট ফোন ব্যবহারের কারণে মানুষের মধ্যে এমন আসক্তি তৈরি হয়েছে যা মাদক জুয়ার মতো ভয়াবহ। স্মার্ট ফোনের প্রতি এই আসক্তিকে ‘নোমোফোবিয়া’ বলে। নোমোফোবিয়ার পূর্ণরূপ ‘নো মোবাইল ফোন ফোবিয়া’। নোমোফোবিয়া হচ্ছে মোবাইল ফোনের সঙ্গে যোগাযোগ হারানোর ভয় ও ফোনে নোটিফিকেশন না আসা সত্ত্বেও বারবার ফোন চেক করা। স্মার্ট ফোনের ভালো খারাপ উভয় দিকই রয়েছে। আমাদের উচিত হবে যথাসম্ভব খারাপ দিকগুলো বর্জন করে চলা। আমাদের স্মার্ট ফোনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে স্মার্ট ফোনকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct