এম ওয়াহেদুর রহমান, আপনজন: আজ থেকে ৭৫ বছর পূর্বে বহু জীবনের অকাল প্রয়াণের মধ্য দিয়ে তথা আত্মত্যাগের বিনিময়ে ব্রিটিশ রাজ শক্তিকে উৎখাতের পর ভারত স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। ড. বি আর আম্বেদকরের অক্লান্ত চেষ্টায় সুবৃহৎ লিখিত সংবিধান রচিত হয়েছিল। দেশভাগের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র,স্বাতন্ত্র এবং সামাজিক ন্যায়ের প্রতি প্রতিশ্রুতি যুগান্তকারীই ছিল। ভারতের সংবিধান স্পষ্টতই একটি যুগান্তকারী দলিল যা গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার ধারণার পক্ষে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ভারতের সংবিধানের মুখবন্ধ কিংবা প্রস্তাবনায় ভারতকে সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও প্রজাতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ভারতের শাসনব্যবস্থা মূলতঃ সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। আর এই শাসনব্যবস্থার মূল কেন্দ্র হলো ভারতের সংসদ কিংবা পার্লামেন্ট। এই পার্লামেন্টের দুই টি কক্ষ রয়েছে , যথাক্রমে উচ্চকক্ষ হলো রাজ্যসভা ও নিম্নকক্ষ লোকসভা। ১৭ তম লোকসভার মেয়াদ ১৬ জুন ২০২৪ এ শেষ হওয়ার কথা। তাই দেশব্যাপী ১৮ তম লোকসভার ৫৪৩ সদস্য নির্বাচন করার জন্য ১৯ এপ্রিল ২০২৪ থেকে ১ জুন ২০২৪ পর্যন্ত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনটি সাতটি ধাপে অনুষ্ঠিত হবে এবং ৪ জুন ২০২৪ এর ফলাফল ঘোষণা করা হবে। বিশ্বের দরবারে ভারত একটি অন্যতম বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ, বহু পথ অতিক্রম করে সাতটি দশক অতিক্রম করে ফেলেছে ভারতীয় গণতন্ত্র। এই নির্বাচনকে ঘিরে চলে বিপুল কর্মকাণ্ড। অথচ রাজনীতির অঙ্গনে অপরিণত আচরণ যেন ক্রমশঃ দিন দিন বেড়েই চলেছে। ভারতে বহু দলীয় ব্যাবস্থা প্রচলিত থাকলেও বাস্তবে দুই টি প্রধান ( ভারতীয় জনতা পার্টি ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ) দলের জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে আধিপত্য রয়েছে। ভারতের রাজনীতিতে ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের দৌড় ক্রমবর্ধমান দ্বিমুখী হয়ে উঠেছে , যেখানে দুই টি প্রধান জোটের আবির্ভাব ঘটেছে। বর্তমান ‘এনডিএ’ ( ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স ) ও বিরোধী দলের ‘ ভারত ‘ বা ‘ ইন্ডিয়া’ ( ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স )। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের বাসিন্দা হিসেবে আমরা বারংবার গর্বভোদ করলে ও বাস্তবে রুচি আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে মেতে উঠি নিম্নরুচির ব্যাক্তিগত আক্রমণ, অশালীন বক্তব্য কিংবা আপত্তিকর কটাক্ষ করতে। ভারতীয় গণতন্ত্রের সুবৃহৎ ব্যাপ্তি থাকা সত্ত্বেও নিজেরাই যেন গণতন্ত্রের মাথা হেঁট করে দিই।
গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুযায়ী জনগণই চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু বাস্তবে তাই - ই কি হচ্ছে ? দেখা যাচ্ছে সমর্থন সংগ্ৰহের প্রয়োজনে উৎকোচ দান, ভীতি প্রদর্শন,রিগিং,বুথ দখল , ভোটাধিকার অপহরণ প্রভৃতি। বেকারত্বের সমস্যা ভারতীয় অর্থনীতির জন্য একটি সমস্যা ,যা বিশেষ করে যুব সমাজকে প্রভাবিত করছে। বেকারত্ব নির্বাচনী প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বিরোধী দলগুলো ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি নিয়ে প্রায় সরব হয়ে ওঠে। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে একজন নেতা বা নেত্রী যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। আর হয়তো নিজের ইচ্ছাকেই জনগণের মাথায় চাপিয়ে দিচ্ছেন। নির্বাচনের পূর্বে ইস্তাহারে জনগণের নিকট নিজেকে তুলে ধরা হচ্ছে কল্পতরু রুপে। গণতন্ত্রের সাফল্য নির্ভর করে বিরোধী কণ্ঠস্বর বা বিরোধী দলের উপর। এই বিরোধী দল হলো ‘ ছায়া মন্ত্রিসভা ‘ ‘ স্যাডো ক্যাবিনেট’। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে বিরোধী শূন্য গণতন্ত্রের বাস্তবায়ন। তবে এই প্রক্রিয়া আজকের নয় বরং স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকেই এই ট্রাডিশন সমানে চলেছে। ভোটে জেতার জন্য প্রায় দলগুলো বিভিন্ন ভাবে ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করে থাকে। আবার নির্বাচনের আগে বা পরে এক দল থেকে অন্য দলে যোগদানের প্রবনতা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে অর্থাৎ রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘোড়া কেনাবেচার প্রবনতা প্রচলিত হয়েছে। তাছাড়া ভারতীয় রাজনীতিতে ধর্ম ও আঞ্চলিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণতান্ত্রিক সংহতির চাবিকাঠি হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছা। রাজনৈতিক সদিচ্ছার পরিবেশ আমাদের গণতান্ত্রিক চর্চাকে আত্মস্থ করতে সক্ষম করে তুলতে পারে। সকল সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির অবলুপ্তি ঘুচিয়ে জাগিয়ে তোলা দরকার জাতীয় সংহতি। আমাদের বুঝতে হবে গণতন্ত্রই দেশের শক্তি। বিশ্বজুড়ে মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন সংগঠিত করার একটি আদর্শরুপ হিসেবে গণতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান গ্ৰহনযোগ্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে , যা সত্যি প্রশংসার যোগ্য।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct