সাঈদুর রহমান লিটন: আবার ও ফজর আলির চোখে পানি চিকচিক করে ওঠে। বুকটা ফেঁটে আসে। বুকের মাঝে ফোঁসফোঁস শব্দ হয়। এভাবে হয় প্রতি বছর। ছোট ছোট করে ঠোঁট কেঁপে যায় ক্ষণকাল। মুখে অস্পষ্ট স্বরে বলে, হায়রে খোদা এবারো কাঁদালে আবার!
প্রতি বছর এ সময়ে ফজর আলি কাঁদে।
একাই কাঁদে। কেউ কাঁদা দেখে না। একাই চোখ মুছে নেয়। সবার সাথে হাসি খুশি চলে। মনে ব্যথা থাকে। মনের ব্যথা কে আর বুঝে, নাকি বুঝতে পারে? ফজর আলির ব্যথা কেউ বুঝে না।
এবার ও সুদে টাকা নিয়ে পিঁয়াজ চাষ করেছে ফজর আলি। পিঁয়াজ চাষে খরচ একটু বেশি। উপরন্ত গত বছর পিঁয়াজের দাম দ্বিগুণ, তিনগুন, চারগুন হওয়ায় গুঁটি পিঁয়াজের দাম অনেক বেশি হয়েছে। তাই বেশি দামে গুঁটি পিঁয়াজ কিনে পিঁয়াজ রোপন করেছে ফজর আলি। পুরো টাকাই মহাজনের নিকট থেকে সুদে নেওয়া। এখন আর সুদ কারবারিদের আর মহাজন বলে না। এখন এদের কে এন জি ও ‘র মালিক বলে। ভুঁইফোড়ের মত এন জি ও গড়ে ওঠেছে। চোখে ধূলো দিয়ে এরা চড়াসুদে ব্যবসা করে চলছে কেউ তার খবর রাখে না। সরকার তা দেখে ও দেখে না। মনে হয় চোখ বুঁজে হাঁটে। কত পরিবার যে এসব নামকে ওয়াস্তে প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে সর্বশান্ত হয়েছে তার হিসাব ও কেউ রাখেনি।
ফজর আলি ও সর্বশান্ত হয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন শুধু বাড়ির কয়েক শতক ভিটে বাড়ি আছে। তাও বন্দক দিয়ে এবার ঋণ করেছেন। পিঁয়াজ চাষে লাভ করবে,সেই লাভের টাকায় দেনার টাকা শোধ করবে সেই লোভে। লাভ করা হয় না, মানে লাভ তো হয়ই না বরং দেনার পরিমান চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে। তবু ও আবার ঋণ নেয়। আবার পিঁয়াজ চাষ করে, আবার ক্ষতির সম্মুখীন হয়। আবার ঋণ নেয় আবার পিঁয়াজ চাষ করে আবার চোখের জলে পিঁয়াজ ক্ষেতের মাটি ভিজে।
মুড়ি পিঁয়াজ যখন ওঠে তখন পিঁয়াজের দাম কমে যায়। এতই কমে যায় যে পিঁয়াজ চাষের খরচের চেয়েও দুই তিন গুন কম দামে পিঁয়াজ বিক্রি করতে হয়। অথচ এই ফজর আলিই যখন পিয়াঁজ রোপন করে, আকাশ ছোঁয়া দামে পিঁয়াজ কিনে খেয়েছে। আর আর আকাশ ছোঁয়া দামের লোভেই ফজর আলি পিঁয়াজ চাষ করে আর লোকসানে পড়ে। ফজর আলির অভাবের তাড়নায় পিঁয়াজ উঠিয়েই বিক্রি করতে হয়। তাছাড়া খাবার জুটবে না। সাপ্তাহিক, মাসিক কিস্তি পরিশোধের ধাক্কা তো আছেই। এছাড়া সাংসরিক অন্যান্য খরচ। পিঁয়াজ উঠিয়ে সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। পিঁয়াজ সস্তায় বিক্রি করতে হয়। গরিবের অভাব, যারা পিঁয়াজ গুদাম জাত করে তাদের ব্যবসা করার একটা টার্নিং পয়েন্ট। তারা জানে ফজর আলিদের টাকার দরকার। পিঁয়াজ তারা বিক্রি করবেই। তাই তারা পিঁয়াজের দাম কমিয়ে দেয়। যতই লোকসান হোক ফজর আলিরা পিঁয়াজ বিক্রি করে দেয়। কেন না তাদের পিঁয়াজ ঘরে রাখার সামর্থ নাই। আবার কয়েকদিন পরে সেই ফজর আলি তার কম দামে বিক্রি করা পিঁয়াজ চড়া দামে ক্রয় করতে বাধ্য হয়। পিঁয়াজ ছাড়া তো খাওয়া চলে না। এগুলো ফজর আলি জানে তবু ও ভাবে যদি এবার শুরুতেই পিঁয়াজের দাম বেশি হয় তবে এক মৌসুমেই ধার দেনা শোধ করতে পারবে। সেই আশায় এবার ও পিঁয়াজ লাগায় ফজর আলি। খুব ভাল হয়েছে। ফজর আলির মনে আনন্দ আর ধরে না। কত স্বপ্ন দেখে ফজর আলি। সব এন জি ও র দেনা শোধ করবে। সপ্তাহ শেষ হলেই কিস্তি আর ভাল লাগে না। মাথায় চিন্তা থাকে।সারাদিন রাত ভ্যান চালাতে হয় কিস্তির টাকা দেয়ার জন্য। এবার পিঁয়াজ বিক্রি করে সব টাকা পরিশোধ করতে পারলে আর সেই কিস্তির চিন্তা থাকবে না। ফজর আলি ভাবে আর খুব খুশি হয়। মেয়েটা বড় হয়ে গেছে। বিয়ে দিতেও কিছু টাকা লাগবে। এবার বুঝি মেয়েটার বিয়ে দিতে পারবে। আরো কতো চিন্তা ফজর আলির। একমাত্র ছেলে কলেজে পড়ে তার একটা ভাল জামা কাপড় ও দিতে পারেনি ফজর আলি। এবার পিঁয়াজ বিক্রি করে দিতে পারবে ভেবে ফজর আলির বুকটা আনন্দে নেচে ওঠে।মানুষ যা ভাবে হয় তার উলটো।
ফজর আলি পিঁয়াজ গাড়িতে করে বাজারে নিয়ে যায়। তখনো বুকে নানা স্বপ্ন গিজগিজ করছে। বিধিবাম। পরক্ষণেই পিঁয়াজের দাম শুনে সব স্বপ্ন, সব আশা নিরাশায় পরিনত হয়। চোখের কোণায় জমা হয় শত কষ্টের অশ্রু কণা। এক বুক হতাসা এখন ফজর আলির বুকে। এখন সে কি ভাবছে কি জানি?
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct