সাঈদুর রহমান লিটন: মাটি দিয়ে অনেক সুন্দর করে পুতুল টি বানিয়ে দিল মা। আমার মা সব পারে। সেদিন দোকানে পুতুল দেখে মাকে বলেছিলাম, দেখ দেখ মা পুতুল টি কত সুন্দর! মা বুঝে ছিল, পুতুলটি আমার পছন্দ হয়েছে। মায়ের কাছে পুতুল কেনার মত টাকা তো ছিল না। তাই অনেক চেষ্টা করে মাটি দিয়ে রোদে শুকিয়ে মা পুতুল টি বানিয়ে দিল।
বললাম, মা খুব সুন্দর হয়েছে। মা জরিয়ে ধরে কেঁদে দিল। আমার আমি খুশি হলে এভাবে কাঁদে।
সেবার আমার জামা ছিঁড়ে গেছে।আমি আর আমার মা জামা কেনার জন্য শহরে গেলাম। প্রায় অর্ধ শত দোকান ঘুরলাম। জামা পছন্দ হয়।কিন্তু টাকায় কুলায় না। মা বলে, রেখে দিন পরে কিনে নিয়ে যাব। এ ভাবে দোকান ঘুরতেই থাকলাম। মায়ের কাছে যে টাকা আছে তাতে জামা কেনা হলো না।মা ফেরার পথে কিছু ছিঁট কাপড় কিনে নিয়ে আসলো। সারারাত না ঘুমিয়ে নিজে কাপড় কেটে নিজে হাতে সেলাই করে অনেক কষ্ট করে একটা জামা বানিয়ে সকাল বেলা আমাকে জামাটি দিল। আমি নতুন জামা দেখে খুব খুশি হলাম। আমার খুশিতে মায়ের চোখ জলে টলমল করতে ছিল।
আমাদের বাড়ির পাশে এক কৃষকের আখের ক্ষেত ছিল।সেই ক্ষেত থেকে আখ কেটে খাওয়ার অপরাধে সেই ক্ষেতের মালিক আমাকে যা না তাই বলে ছিল। আমার মা শুনেছিল।আমার মা সেদিন খুব কেঁদেছিল। আমাদের বাড়ির পাশে একটু খোলা জায়গা আছে। পরের বছর সেখানে মা নিজেই কিছু আখ লাগায়। আখ খাওয়ার উপযুক্ত হলে আমার মা আখ কেটে দেয় আর আমার পাশে বসে। বলে খাও। যত পারো তত খাও।আর অন্যের ভুঁই থেকে আখ খেই ও না।আমি মায়ের মুখের পানে তাকিয়ে থাকি।
আমার মা সেদিন খুব খুশি ছিল। সেই বকুনি দেওয়া সেই আখের জমির মালিক কে দুই খানা আখ কেটে দিয়ে বলেছিল, নিয়ে যান বাবু বাড়ি ছেলেপুলে নিয়ে খাবেন। সে বছর সেই কৃষক আখের চাষ না করে অন্য ফসল চাষ করে ছিলেন। আখ পেয়ে সেই কাকু খুব খুশি মনে চলে গেল।
আমার মা আমার জন্য সব করতে পারে।
একবার আমি খেঁজুর গাছে খেঁজুর পারতে উঠতে গিয়ে গাছের মাঝামাঝি উঠে আর উঠতে পারছি না। নিচে নামতেও পারছি না। আমার মা মেয়ে মানুষ গাছে চড়তে জানে না। আমি কান্নাকাটি করছি গাছে। আমার মা ছুটাছুটি করছে।আশে পাশে কেউ নেই আমাকে নামানোর জন্য।আমি ভয়ে কাঁপছি পড়ে যাবার ভয়ে। মা সাহস জুগাচ্ছে আমি আছি, তুমি ভয় পেয়ো না।আস্তে আস্তে নামার চেষ্টা করো। কিন্তু আমি নামতে পারছি না।
পড়ে যাই যাই ভাব। আমার মা কি দিয়ে কি করবেন কিছু ই বুঝে উঠতে পারছে না। পাগলের মত ছুটাছুটি করছে। আর বার বার সাহস জুগাচ্ছে। ভয় না পাবার সাহস।আমি মরে গেলে ও তোমাকে নামিয়ে আনব। তুমি থাক ওখানে আমি আসছি।আমার মা উপায়ান্তর না পেয়ে। খেঁজুর গাছে উঠার প্রানান্ত চেষ্টা করছে। কিন্তু উঠতে পারছে না।আর গগন বিদারি আহাজারি করছে। সে নিজে চোখে না দেখলে আর না শুনলে বিশ্বাস করা যাবে না।কাপড় পড়া আমার মা বুকে ভর দিয়ে সেই গাছে
কত কষ্টে আমার পর্যন্ত এসে পৌছেছে সে বোধ করি সৃষ্টি কর্তা আল্লাহ ছাড়া কেউ বলতে পারবে না। এত কষ্ট করে মা গাছে উঠে আমাকে ধরেছে কিন্তু আমরা কেউ নামতে পারছি না।পড়ে যাই যাই ভাব। মা বলল, আমরা দুই জন যদি পড়ে যাই তুমি আমার উপরে থাকবে।আমি নিচে থাকলে তুমি ব্যথা পাবে না।
দুই জনেই কান্নাকাটি করছি। মা আমাকে নামাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এখন দেখছি মা পড়ে যায় যায় ভাব। কি এক ভয়ংকর পরিস্থিতি। তার মধ্যে ও মা বলছে ভয় পেও না আমি আছি। পড়ে গেলেও ব্যথা পাবে না।
আমাদের এমন পরিস্থিতি পথ দিয়ে যাওয়া এক কাকু দেখে ফেলেন। তিনি দৌড়ে মানুষ ডেকে আনেন।এবং পাশের বাড়ি থেকে মই এনে আমাদের কে উদ্ধার করেন।
মা নিচে নেমে আমাকে জরিয়ে ধরে হাও মাও করে কাঁদতে থাকে। মায়ের বুকের পুরো কাপড় রক্তে ভেজা। গাছে ওঠার সময় ছিলে গেছে সে তারই রক্ত।
মা আমার বুকে পিঠে হাতরিয়ে দেখছে আমার কোথাও ছিলে গেছে কিনা। কিন্তু নিজের বুকে রক্তের বন্যা।
আজও আমি অবাক হলাম মা এত সুন্দর পুতুল বানালো কিভাবে? মা তো কখনো পুতুল বানায়নি তাহলে কিভাবে সম্ভব হলো?
মা কে বললাম, মা এত সুন্দর পুতুল কিভাবে বানালে?
মা, বলল, তুমি মা হও তুমি ও পারবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct