ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনেস্কির আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরেছে। ওয়াশিংটনে গিয়েও রাশিয়ার সঙ্গে চলমান যুদ্ধে মার্কিন সামরিক সহায়তার কোনো প্রতিশ্রুতি তিনি আদায় করতে পারেননি। প্রেসিডেন্ট বাইডেন অবশ্য এখনো ইউক্রেনের প্রতি তাঁর সমর্থন অব্যাহত রেখেছেন। একইভাবে ইউক্রেনের জন্য ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়ের প্রস্তাবে রিপাবলিকানরাও তাঁদের জোর অসম্মতি জারি রেখেছেন। রিপাবলিকানরা এই অর্থছাড়ের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে কঠোর নীতি প্রণয়নের একটা শর্ত জুড়ে রেখেছেন। লিখেছেন জুলিয়ান জেলিজার।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনেস্কির আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরেছে। ওয়াশিংটনে গিয়েও রাশিয়ার সঙ্গে চলমান যুদ্ধে মার্কিন সামরিক সহায়তার কোনো প্রতিশ্রুতি তিনি আদায় করতে পারেননি।প্রেসিডেন্ট বাইডেন অবশ্য এখনো ইউক্রেনের প্রতি তাঁর সমর্থন অব্যাহত রেখেছেন। একইভাবে ইউক্রেনের জন্য ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়ের প্রস্তাবে রিপাবলিকানরাও তাঁদের জোর অসম্মতি জারি রেখেছেন। রিপাবলিকানরা এই অর্থছাড়ের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে কঠোর নীতি প্রণয়নের একটা শর্ত জুড়ে রেখেছেন। এই শর্ত ডেমোক্র্যাটরা দ্রুত পূরণ করবেন, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। ফলে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ এক রকম অন্ধকার। যদি এই দুই দল শেষ পর্যন্ত ঐকমত্যেও পৌঁছায়ও, তাহলে ধরে নিতে হবে, প্রতি দফা সহায়তা প্রস্তাব পাসে বাইডেনকে কঠোর থেকে কঠোরতর প্রতিরোধ ও পথ রোধের মোকাবিলা করতে হবে।রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মার্কিন রাজনীতির হাওয়া কোন দিকে, তা খুব ভালোই বুঝতে পারেন। গত সপ্তাহের সংবাদ সম্মেলনে তাঁকে বেশ আত্মবিশ্বাসী মনে হয়েছে। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেছেন, ইউক্রেনের ব্যাপারে তাঁর পরিকল্পনার আশু পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। পুতিন বলেন, ‘ইউক্রেনে যখন আমরা লক্ষ্য অর্জন করব, তখনই কেবল শান্তি আসবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন’ এলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামত করা সম্ভব হবে।পুতিন দীর্ঘদিন ধরে ওয়াশিংটন ও ন্যাটো মিত্রদের মধ্যে ঐক্যে ফাটল ধরার অপেক্ষায় আছেন। যদিও পুতিন কিছুটা দুর্বোধ্য, তবু কয়েকটি বিষয় মাথায় রেখেই সম্ভবত তিনি বাজি ফেলেছেন। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের কার্যকারিতা নিয়ে ক্রমবর্ধমান সংশয়, ক্যাপটল হিলে দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতানৈক্য এবং মার্কিনিদের নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে মনোযোগ ধরে রাখার অক্ষমতা।ভিয়েতনাম ও ইরাকের বিপর্যয়কর যুদ্ধের পর বৈদেশিক যেকোনো ইস্যুতে মার্কিন হস্তক্ষেপের প্রভাব দুর্বল বলে ধরে নেওয়া হয়। এই দুই যুদ্ধের পরম্পরায় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা মনে করেন, নীতি বিশেষজ্ঞরা বরাবর মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের ওপর পরিচালিত যুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেয়। একটি সামরিক যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রাণহানি ঘটতে পারে, এই ভাবনা গভীরভাবে সাবেক যোদ্ধাদের মানসিক ও শারীরিকভাবে পীড়া দেয়। তা ছাড়া অভ্যন্তরীণ নানা প্রকল্পকে পাশ কাটিয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার এসব যুদ্ধে ব্যয় হচ্ছে, এ কথাও মনে করে থাকেন অনেকে।ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে কেবল এই দ্বিধাদ্বন্দ্বই কাজ করছে, এমনটা বলা যাচ্ছে না। কারণ, ইউক্রেনের সঙ্গে ন্যাটোর নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা শক্তভাবে জড়িত। পুতিনের অভিযান ইউক্রেনেই থামবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। তবে ইউক্রেনকে সহায়তার পেছনে বৈধতার প্রশ্নে যত অজুহাতই খোঁজা হোক না কেন, মার্কিন প্রেসিডেন্টকে একটা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। দেশের গণ্ডির বাইরে কোথাও হস্তক্ষেপ বা সামরিক সহায়তা দিতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের জোরালো জনসমর্থন লাগে। একটা পর্যায়ে এই সমর্থন কমে আসতে পারে এবং আমার ধারণা, ইউক্রেনকে নিয়ে আমাদের আগ্রহ খুব দ্রুতই কমছে।দ্বিতীয় যে বিষয়টি পুতিন বুঝতে পেরেছেন তা হলো, তীব্র রাজনৈতিক মতভিন্নতাকালে কোনো বিষয়ে দুই দলের ঐকমত্যে পৌঁছানোর আশা ক্ষীণ। যদিও সময়-সময় দল দুটি একবিন্দুতে পৌঁছাতে পেরেছে। কিন্তু ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া যখন ইউক্রেনে সামরিক হামলা চালাল, তার অল্প কিছুদিন পরই দুই দলের মধ্যে বিরোধ প্রকাশ্যে চলে আসে।
যুক্তরাষ্ট্র দেশের বাইরে যে কার্যক্রম চালায়, তাকে ক্যাপিটল হিলের অভ্যন্তরে চলা মতানৈক্যের ফল হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। ইউক্রেন ইস্যুতে রিপাবলিকানদের মধ্যে যাঁরা চরমপন্থী, তাঁরা অপেক্ষাকৃত সহনশীলদের আওয়াজ কানে তুলছেন না।অন্যদিকে ডেমোক্র্যাটরা—যাঁদের বড় অংশ ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা পাঠানোর পক্ষে, তাঁরাও অনমনীয়। পিউ রিসার্চ সেন্টারের একটি জরিপে দেখা যাচ্ছে, রিপাবলিকান ও রিপাবলিকানপন্থী বৃদ্ধিবৃত্তিক সংগঠনগুলোর ৪৮ শতাংশ মনে করছে, তারা ইউক্রেনকে অতিরিক্ত সমর্থন দিচ্ছে।প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার পুতিনকে নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তা আগুনে ঘি ঢালার মতো। তার ওপর তিনি এ-ও বলেছেন যে ইউক্রেনের যুদ্ধ থামাতে সর্বোচ্চ ২৪ ঘণ্টা লাগতে পারে। তাঁর এসব উক্তি পুতিনের আত্মবিশ্বাসকে আরও জোরালো করেছে। তিনি ধরেই নিয়েছেন, ইউক্রেনের দুর্বল প্রতিরোধযুদ্ধের মুখে ট্রাম্পের ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকাই তাঁর জন্য যথেষ্ট। কিংবা কংগ্রেসের এই বিরোধ জিইয়ে রাখা গেলে ইউক্রেনের যুদ্ধপ্রচেষ্টা আরও নাজুক হয়ে যাবে।বিদেশনীতির ক্ষেত্রে মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য দেশের বাইরে অভিযানের পক্ষে জনসমর্থন ধরে রাখা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। আগের নীতিনির্ধারকেরা সমাজতন্ত্রের শাপশাপান্ত করে বুঝিয়ে দিতেন যে কেন তাঁদের গৃহীত নীতি গুরুত্বপূর্ণ। এখনো এমন কিছু উপায় কার্যকর হতে পারে।সর্বশেষ যুক্তি হলো, পুতিন নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে মার্কিনিরা কোনো বিষয়ে খুব বেশি সময় মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন না। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সব সময় হুড়মুড়িয়ে নানা ধরনের ঘটনার খবর আসতে থাকে। জটিল কোনো বিষয় চোখে পড়লে আমরা চোখ নামিয়ে নিই। অপেক্ষা করি নতুন একটি ভাইরাল ভিডিও আসার। মার্কিন রাজনীতিকদের মধ্যে যাঁরা তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত, তাঁরা বিষয়টা বুঝে গেছেন। তাঁরা আলোচনায় থাকতে চান এবং চেষ্টা করেন মানুষের আকর্ষণ ধরে রাখতে।বিদেশনীতির ক্ষেত্রে মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য দেশের বাইরে অভিযানের পক্ষে জনসমর্থন ধরে রাখা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। আগের নীতিনির্ধারকেরা সমাজতন্ত্রের শাপশাপান্ত করে বুঝিয়ে দিতেন যে কেন তাঁদের গৃহীত নীতি গুরুত্বপূর্ণ। এখনো এমন কিছু উপায় কার্যকর হতে পারে। হয়তো এতটা কার্যকর হোয়াইট হাউসও নয়। কারণ হলো তথ্যের প্রাচুর্য, হোক তা অসংগতিপূর্ণ বা খণ্ডিত। দলীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলার চেষ্টা করে থাকে দর্শক যা দেখছেন, তার সবটাই কোনো না কোনো রাজনৈতিক ভাবাদর্শ থেকে উৎসারিত।কিউবান মিসাইল ক্রাইসিসের সময় প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির সেই বক্তৃতার কথা মনে করুন, কিংবা প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান শীতল যুদ্ধের সময় তাঁর ভাষণে কী কী বলেছেন ভাবুন। তাঁদের এসব বক্তব্য কতটা তাড়িত করেছিল গোটা জাতিকে! এখন অনলাইনে হাজার হাজার খবরের ভিড়ে এমন ধারার বক্তব্যও হারিয়ে যায়। তারপরও যদি দৈবাৎ কারও চোখে পড়ে, কিছুক্ষণ বাদেই তিনি ওই বিষয়কে পেছনে ফেলে স্ক্রল করে পরের খবরে চলে যান।ইউক্রেনের পক্ষে সামরিক সহযোগিতার অনুমোদন নিশ্চিতে এই সব বিষয়ই তাৎপর্যপূর্ণ। ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানরা পুতিনকে ভুল প্রমাণ করতে পারেন। পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নে দীর্ঘ মেয়াদে প্রতিশ্রুতি ধরে রাখতে মার্কিনিরা সক্ষম, এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন। শুধু যে পুতিনই পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছেন তা নয়, যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু-মিত্রদের আরও অনেকেরই নজর আছে এদিকে। তাঁরাও দেখতে চান যুক্তরাষ্ট্র যখন বলে তারা কোনো দেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, তার অর্থ কী।
সিএনএন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত
জুলিয়ান জেলিজার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct