পৃথিবীর অন্যতম জীব বৈচিত্রের আধার বা আঁতুর ঘড় হলো সুন্দরবন। সুন্দরবন যেমন পরিবেশগত দুর্যোগের হাত থেকে সংশ্লিষ্ট বিস্তীর্ণ এলাকা কে রক্ষা করে চলেছে,তেমনি জলবায়ুগত ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রেও এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ৫৬ টি ব দ্বীপ রয়েছে এই অসাধারণ বনাঞ্চলে। ৪২৬৪বর্গ কিমি জুড়ে এর বিস্তার। লিখেছেন সজল মজুমদার।
পৃথিবীর অন্যতম জীব বৈচিত্রের আধার বা আঁতুর ঘড় হলো সুন্দরবন। সুন্দরবন যেমন পরিবেশগত দুর্যোগের হাত থেকে সংশ্লিষ্ট বিস্তীর্ণ এলাকা কে রক্ষা করে চলেছে,তেমনি জলবায়ুগত ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রেও এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ৫৬ টি ব দ্বীপ রয়েছে এই অসাধারণ বনাঞ্চলে। ৪২৬৪বর্গ কিমি জুড়ে এর বিস্তার। এর মধ্যে ২৫৮৫ বর্গ কিমি সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ। প্রসঙ্গত,২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আয়লার পরবর্তী কাল থেকে পথচলা শুরু পূর্বাশা ইকো হেল্পলাইন সোসাইটি নামক একটি পরিবেশপ্রেমী তথা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের। সেই সময় থেকেই ম্যানগ্রোভ প্লান্টেশন ও কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট এর কাজ চলতে শুরু করে এই দীর্ঘ ২০০৯ মে মাস থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত একটি লম্বা সময়ের মধ্যে গোসাবা ব্লকের চরঘেরি লাহিড়ীপুর ,সোনাগা, কাকমারি, কুমীরমারি বিভিন্ন এলাকার নদীচর অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে ম্যানগ্রোভ প্লান্টেশন এর রোপনের পাশাপাশি কমিটেড ডেভেলপমেন্টের কাজ করে চলেছে এই সংগঠন। ইতিমধ্যেই এই দীর্ঘ অঞ্চলের প্রায় পাঁচশো মহিলারা পূর্বাশা নামক ওই সংগঠনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত আছেন। গবেষণার ভাষায় বলতে গেলে ফিল্ড ওরিয়েন্টেড কাজে একদম প্রথম সারিতেই এই মহিলারাই কাজ করেন। সুন্দরবনের নদীগুলিতে দিনে দুবার জোয়ার এবং দুবার ভাটা হয় এবং মাসে দুবার ভরা কোটাল ও দুবার মরা কোটাল হয়। জোয়ার ভাটা জলের বাড়ে ও কমে করে। তিথি অনুযায়ী সেটা কিন্তু বেশ লক্ষণীয়। এবং গুরত্বপূর্ন বিষয়। সুন্দরবনের জোয়ার ভাটা কেন্দ্র করে সব কিছু কাজের সময় নির্ধারন করা হয়।সুন্দরবনের অধিকাংশ ম্যানগ্রোভের গাছগুলিতে ফুল আসে এপ্রিল মে মাস থেকে পাওয়া শুরু হয় এই ফলের পরিপক্ষতা পায়। জুলাই মাসের শেষের দিকে আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর মাসে জোয়ারের জলে ভেসে আসে। গর্জন,গেওয়া. বাইন ,কেওড়া গরান, কাঁকড়া বিভিন্ন ম্যানগ্রোভের বীজ। সেই বীজ ছড়িয়ে পড়ে নদীর দুই কুল বরাবর দক্ষিণ থেকে উত্তরে আবার ভাটার সময় উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে বয়ে যায়। আবার পূরব পশ্চিমের ছোট ছোট সূতি খালের মধ্যে প্রবেশ করে। এটাই হলো সুন্দরবনের একটি স্বাভাবিক নিয়ম। এখানকার নদীগুলো যেহেতু বিনুনি আকৃতি জলনির্গম প্রণালী লক্ষ্য করা যায়। ফলে জোয়ার ভাটা নদীর স্রোত সাথে নির্ভর করে ম্যানগ্রোভের বীজেরা ছড়িয়ে পড়ে জঙ্গলে সর্বত্র।
এই ম্যানগ্রোভের বীজগুলোকে নদী থেকে মহিলারা সংগ্রহ করে। সেগুলিকে পরিষ্কার করে একটি জায়গায় রাখা হয়। কিছু বীজ সরাসরি নার্সারিতে বড় করা হয় আর কিছু বীজ আমরা সরাসরি নরম নোনা পলি মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়। এবার এই বীজ ধরে নিয়ে আসা তাকে যত্ন করে পরিষ্কার করা এবং সংরক্ষিতভাবে সেটি কে নার্সারিতে চারাতে পরিণত করা বেশ একটি কঠিন কাজ। এই কাজগুলি মহিলারা খুব সহজে সুন্দর ও সুচারু ভাবে করে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে এই কাজ করতে করতে তাদের মধ্যে নানান অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে। এবং অভিজ্ঞতাগুলি আমরা বিভিন্ন কাজ করার সময় হাতেনাতে সেটা বুঝতে পারি। মহিলারাই সহজে বলতে পারে। কোন মাটিতে কোন গাছ লাগালে ভালো হবে। আসলে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা সব সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এই যারা ম্যানগ্রোভ বীজ ধরে নিয়ে নার্সারিতে লালন পালন করে বড় করছে। তাদের কাজ এখানেই শেষ। তবে কখনো কখনো প্রয়োজন হলে এদেরকে অন্য কাজেও ব্যবহার করা হয়। মূলতঃ দুটি কাজ হল প্রধান কাজ। একটি হলো বীজ ধরে এনে নার্সারিতে বড় করা আরেকটি হল নার্সারিতে বড় হওয়া চারা গাছগুলিকে নদীর চরে লাগিয়ে দেওয়া। এরপর এবং এই লাগিয়ে দেওয়া কাজগুলিকে প্রোটেকশন দেওয়ার জন্য এই মহিলারা অনেক বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে। এবং এরাই বুঝতে পারে হাটু সমান কাঁদাতে নেমে এই প্লানন্টেশন করতে বেশ কষ্ট করতে হয়। তবে এক সঙ্গে ৩০-৪০ জন কাজ করলে সেটা আবার মজার হয়ে থাকে। এই মজা করতে করতে চরঘেরি চরে, সোনাগাঁ, কাকমারী চর, কুমিরমারি এলাকায় পূর্বাশা ২০০৯ সালের আগষ্ট মাস থেকে ২০২৪ সালের রেকর্ড অনুযায়ী বর্তমান ম্যানগোভ প্লান্টেশন এর সংখ্যা সাত লক্ষ আশি হাজার। পূর্বাশা ইকো হেল্পলাইন সোসাইটির মূল উদ্দেশ্য ২০২৫ সালের মধ্যে এই সংখ্যাটি ১০ লক্ষর কাছে নিয়ে যাওয়া। তবে ভীষণ কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজে প্রথম সারিতে যারা নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। তারাই হল নদী অধ্যুষিত জঙ্গল লাগোয়া অঞ্চলের গ্রামের মহিলারা। এই মহিলারাই একমাত্র পারে সুন্দরবনের সোশ্যাল ফরেস্ট্রি এলাকা গুলিতে ম্যানগ্রোভের বৃদ্ধি করতে। কারণ এরাই ভালো বুঝতে পারে কোনটা করা উচিত আর কোনটা করা উচিত নয়। মহিলাদের এই কার্যক্রমের উপরে নির্ভর করে এদের একটি পোশাকি নামকরণ করা হয়েছে এবং এটি মূলত প্লান্টেশন, প্রোটেকশন এবং কনজারভেশন এর মত কাজকে হাসিমুখে সাবলীল ভাবে করে থাকে। ২৬ শে জুলাই ২০২৩ , পূর্বাশার পক্ষ থেকে এই উপকূলীয় অঞ্চলে মহিলাদের নামকরণ করা হয়েছে,”ম্যানগ্রোভ আর্মি। ”এই নামকরনের ফলে তারা বেশ খুশি এবং সাম্প্রতিক চরঘেরি এলাকার ম্যানগ্রোভ আর্মিদের ও আন্তর্জাতিক ম্যানগ্রোভ দিবসে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে। এবং তাদের কার্যক্রমে পূর্বাশার কর্মকর্তারাও সত্যি খুব আপ্লুত। এটা জেনে ভালো লাগবে সকাল, দুপুর, বিকাল যে কোনো সময়ই যখনই কোন নোটিশ করা হয়, সাথে সাথেই বাড়ির কাজ ফেলে এই মা-বোনেরা ম্যানগোভ প্লান্টেশনে অংশগ্রহণ করে। কারণ পুরো কাজ করতে হয় ভাটায়। তিথি অনুয়ায়ি ভাটার সময় কমবেশি হয়ে থাকে। খুব ছোট ছোট চাওয়া পাওয়া থাকে পূর্বাশার কাছে ,আর পূর্বাশা হাত বাড়িয়ে থাকে, দেশ-বিদেশ ছড়িয়ে থাকা সমমনস্ক মানুষদের কাছে। তারাই একমাত্র আমাদেরকে স্বপ্ন দেখায়। আপনি এগিয়ে যান। আমরা আছি আপনার সাথে। এই ছোট ছোট স্বপ্নগুলোই আজ ভারতীয় সুন্দরবনের শেষতম গ্রাম থেকে পৃথিবীর পশ্চিমের অনেক দেশেই পৌঁছে গেছে পূর্বাশার কাজকর্মের খবর। সাথে সাথে বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা ও আসছে। কোন কোন সহযোগিতা সরাসরি ম্যানগ্রোভ আর্মিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। যেটি সু-স্থায়ী উন্নয়নের কাজে লাগানো হয়। ম্যানগ্রোভ আর্মিদেরকে সাহায্য করলে শুধু হবে না। তাদের পরিবার আছে। তাদের সন্তান আছে। তাদের বয়স্ক শাশুড়ি আছে। তাদের কথাও পূর্বাশা একটু হলেও ভাবে। সেই বলতে গেলে আমরা যে কাজটি করতে থাকি। এই কাজটি হল সোসিও -ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স। গাছ লাগিয়ে বড় করা ও যারা রোপন করে। তাদের প্রতি আমাদের যত্নশীল হওয়া। এটাই বুঝি একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। এই প্রসঙ্গে পূর্বাশা ইকো হেল্পলাইন সোসাইটির সম্পাদক, পরিবেশ প্রেমী, বাস্তু তন্ত্রবিদ, ম্যানগ্রোভ ম্যান বলে পরিচিত উমা শংকর মন্ডল জানান, “ উপকূলীয় অঞ্চলের বাদা বনের অতীত সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি ম্যানগ্রোভের চারা রোপন,ম্যানগ্রোভ সংরক্ষণ ইত্যাদি ম্যানগ্রোভ আর্মির কাছে একটি মানসিক স্বস্তির জায়গা তৈরি করেছে। ” অন্যদিকে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ এবং ম্যানগ্রোভ আর্মি সম্পর্কে ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইউনিভার্সিটি অনুমোদিত পান্নালাল দাস কলেজের সহকারী অধ্যাপিকা ড: দেবারতি দাস বলেন, “ গত জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক ম্যানগ্রোভ দিবসে প্রায় পাঁচ হাজারের উপর ম্যানগ্রোভের চারা রোপন করা হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে বলি, সুন্দরবনে পূর্বাশা ইকো হেল্পলাইন সোসাইটির উদ্যোগে ম্যানগ্রোভ আর্মি গড়ে তোলা হয়েছে। যেখানে মূলত মহিলারাই সেখানকার কিছু নির্দিষ্ট স্থানে ম্যানগ্রোভ এর চারা রোপন করে চলেছে। আমরা জানি,ম্যানগ্রোভ যে কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের থেকে সুন্দরবন এবং সংলগ্ন গ্রামাঞ্চলকে রক্ষা করে চলেছে। এখানে মহিলারাই তাদের বসতিকে রক্ষার তাগিদে কমিউনিটি পার্টিসিপেশনের মাধ্যমে পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যোগদান রেখে চলেছে। এভাবে সেখানকার মহিলারা সংশ্লিষ্ট পরিবেশ প্রকৃতিকে রক্ষার পাশাপাশি তাদের স্বতন্ত্র পরিচয় ও নিজস্বতা তৈরী করতে পেরেছে। সেইখান থেকেই গঠিত হয়েছে সুন্দরবনের এই ম্যানগ্রোভ আর্মি।”
লেখক: শিক্ষক এবং প্রাবন্ধিক
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct