ইসলাম চর্চিত জ্ঞান-বিজ্ঞান, মর্যাদা, গাম্ভীর্য আর সম্ভ্রম সম্পর্কে ওয়াকিফহাল করে তোলার অভিপ্রায়ে বর্তমান আলোচনাটির উপস্থাপনা। ‘হাফ বেকড’ তথাকথিত পণ্ডিতবর্গ ‘মধ্যযুগের বর্বরতা’ বলে আলটপকা মন্তব্য করে বসেন। ইসলাম ‘মিস আন্ডারস্টুড রিলিজিয়ন’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। ক্রুশেডের কাল থেকে এই বেতমিজ অপপ্রচার চলছে। সদ্যতন সভ্যতার আলোকবর্তিকাটি ইসলাম-ই মধ্যযুগ থেকে জ্বালিয়ে রেখেছিল। চার্চ এবং যাজক সম্প্রদায়ের কুসংস্কার আর অমানবিক কার্যাদির কারণে বহু বৌদ্ধিক ব্যক্ত্বিকে তারা নির্মভাবে হত্যা করেছে। ইসলাম তার ‘আহল-ই-কলম’ (বিদ্বৎসমাজ)-কে কস্মিনকালেও বিড়ম্বিত করেনি। সর্বোত্তম পৃষ্ঠপোষকতায় জ্ঞানের অন্তহীন বিকাশে মদদ করেছে। অত্যুজ্জ্বল এই মহত্তম বিষয়টির উপর আলোকপাত করলেন এই বঙ্গের মেধা আর মননের অন্যতম বিশিষ্ট প্রতিনিধি খাজিম আহমেদ।
সন্ত্রাসবাদী আর মুসলমান--- এই শব্দ দুটিকে সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা প্রায় সমার্থক করে তুলেছে। তাদের বক্তব্য হল— সব মুসলমান সন্ত্রাসবাদী নয়, তবে সব সন্ত্রাসবাদী মুসলমান। কি আজব এবং ভয়ানক এক তত্ত্ব। দুনিয়ায় যত খুন-খারাবি আর সন্ত্রাস মুসলমানরাই নাকি করে থাকে। এ বাবদে তারা বিশেষ পারদর্শী— আর কী! তাহলে কি তারাই ‘সন্ত্রাসবাদ-এর ‘মনোপলি’ করে থাকে! কস্মিনকালেও তা যথার্থ নয়। ব্যক্তি নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যাটি খতিয়ে দেখা যাক। ‘সন্ত্রাসবাদ’ নতুন কোনও বিষয় নয়। ১৮৮১ সালে রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে নৈরাজ্যবাদীরা নির্মমভাবে খুন করে। তাঁর ২১জন সঙ্গীকেও খতম করে দেয়। এই নৈরাজ্যবাদীরাই ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ম্যাকিনলে, আর ইতালির রাজা প্রথম হামবার্টকে হত্যা করে। অস্ট্রিয়ার আর্চ ডিউক ফার্দিনান্দকেও হত্যা করলে ১৯১৪ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তার যে কি নৃশংস পরিণতি—সবাই জানি। এই সন্ত্রাসবাদীরা কেউ মুসলমান ছিল না। রাজনৈতিক কারণে সাধারণ মানুষ আর প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গকে নির্বিচারে খুন করে দেওয়ার বিষয়টিকে সাধারণভাবে ‘সন্ত্রাসবাদ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করেই ব্রিটিশ রাজশক্তি ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ, ক্ষুদিরাম, বিনয়, বাদল, দীনেশকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত করে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের নিরিখে তাঁরা ছিলেন ‘সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদী’ বা ‘বিপ্লববাদী’। এঁরা জন্ম-সূত্রে ‘হিন্দুধর্মী’ ছিলেন, শিখ বা ইসলামধর্মী নন। মাও সে তুং থেকে শুরু করে হো চি মিন আর ফিদেল কাস্ত্রো তাঁদের বৈপ্লবিক চিন্তাধারা ছড়িয়ে দেওয়া বা প্রতিষ্ঠারকালে যেভাবে সাধারণ নাগরিক এবং বিপন্ন মতাদর্শের ব্যক্তিদের খুন করেছেন তা প্রায় তুলনারহিত। এঁরা সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন। তাঁদের রাজনৈতিক সাফল্যের পর স্বদেশে ‘বীরের মর্যাদা’ পেয়েছেন। এঁরা কি কেউ মুসলমান? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ্বের পরে ফিলিস্তিনে স্বাধীন ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যায়নবাদী ‘হাগানাহ’, ‘ইরগুন’, ‘স্টার্ন’ গ্যাং? বহু হোটেল, অজস্র প্রশাসনিক ইমারত, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বোমা মেরে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। এলাপাথাড়ি গুলিবাজির ফলে অগণন নাগরিক মৃত্যুর দরজায় পৌঁছে গেছে। সেই সময় ফিলিস্তিন ব্রিটিশদের কবজায় ছিল। শাসকগোষ্ঠী হত্যাকারী (Killer) গোষ্ঠীগুলিকে ‘যথার্থই সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। মোশে ডায়ান, ওয়াই. রোবিন, মেনাহেমবেগিন, আরিয়াল আর শারণ ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। কি আশ্চর্য এই লোকগুলোই পরবর্তীকালে ‘স্বাধীনতাকামী আরব যোদ্ধা’-দের ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে প্রচার করতে থাকে তুরন্ত তৎপরতায়। চূড়ান্ত কূটকৌশলে। ‘যায়নবাদী’-রা কেউ মুসলমান ছিল না।
১৯৬৮ থেকে ‘৯২ সাল তক জার্মানিতে ‘বাদের মেইন-হফ’ (Baader Meinhoff Gang) অজস্র খুন-খারাবি করেছে। এমনকি ‘Treuhand Group’-এর পরিচালককেও খুন করেছে। আলডো মোরো ছিলেন ইতালির প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। ‘রেড ব্রিগেড’-এর সদস্যরা তাঁকে অপহরণ করে এবং গোপনে নৃশংসভাবে হত্যা করে।এশিয়া মহদেশে জাপান প্রতিষ্ঠা করে ‘রেড আর্মি’— তারাও বিস্তর খুন করেছে। দুনিয়া জানে। জাপানে ‘Aum Shinriko’ (একটি ‘Buddhist cult’) নামীয় গুপ্ত সংস্থা হাজারো আমজনতাকে খুন করেছে। ১৯৯৫ সালে এই গ্রুপটিই ‘নার্ভ গ্যাস’ (Nerve gas) ব্যবহার করে ‘টোকিও মেট্রো সিসটেম’-কে তছনছ করে দেওয়ার চেষ্টা করে। ইউরোপে ‘আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি’ (ক্যাথলিক ক্রিশ্চিয়ান সন্ত্রাসবাদী সংস্থা) প্রায় ১০০ বছর ধরে মহাপরাক্রমে সেই মহাদেশের নানান প্রান্তকে কাঁপিয়ে দেয়, সন্ত্রস্ত করে তোলে। ই. টি. এ নামক একটি টেররিস্ট সংস্থা, স্পেন ও ফ্রান্সের জনজীবনকে কম্পিত করে দিয়েছিল। দীর্ঘকাল ধরে তামাম আফ্রিকা মহাদেশে যে গৃহযুদ্ধ (Civil war) চলছে এবং অভ্যন্তরীণ মারণমুখী সংঘর্ষ চলছে তার কোন অংশ কি পরিবর্তনকামী আর কোন অংশকে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে— তার হদিশ পাওয়া বাস্তবিক অর্থেই দুষ্কর। উগান্ডার একটি ক্রিশ্চিয়ান কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদী সংস্থা ‘লর্ড স্যালভেশন আর্মি’ (Lord’s Salvation Army) শিশুদের হাতেও অন্ত্র তুলে দেয়। শিশুদের খুনেতে রূপান্তরিত করে। বর্তমান পৃথিবীতে শ্রীলঙ্কার ‘তামিল টাইগার্স’রা হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ানক এবং দুর্দমনীয় সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী। তারাই সর্বপ্রথম শিশুদের সন্ত্রাসবাদের প্রশিক্ষণ দেয়। জাতিসত্ত্বার বিচারে তামিল টাইগার্সরা দ্রাবিড় জাতীয় হিন্দু। প্যালেস্টাইন এবং ইরাকে আত্মঘাতী বোমাবাজির ভয়ঙ্কর দুঃসাহসের যারা পরিচয় দিয়েছে তারা ইসলামধর্মী। প্রসঙ্গতঃ মনে রাখা দরকার, এই আত্মঘাতী বোমাবাজির লড়াকু, সামরিক পদ্ধতিটির প্রথম ব্যবহার করেছে আধুনিক পৃথিবীতে শ্রীলঙ্কার ‘তামিল টাইগার্স’রা। এই ধরনের এক আক্রমণের মাধ্যমে তারা ১৯৯১ সালে রাজীব গান্ধিকে দ্বিধাহীন এবং নিঃশঙ্কচিত্তে হত্যা করে। বর্তমান ভারতে কাশ্মীরের কঠোরভাবে একেশ্বরবাদী ইসলামধর্মী মুসলমানরাই কি ‘মিলিট্যান্ট’? পাঞ্জাবে ‘মিলিট্যান্টদের’ নেতা ভিন্দ্রানওয়ালে শিখধর্মী। অসমের হিন্দু ‘ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট’-এর মূল কাজ হচ্ছে অহমীয়া মুসলমানদের বিলুপ্ত করে দেওয়া। ত্রিপুরায় বহু ধরনের মিলিট্যান্ট গ্রুপের উত্থান-পতন লক্ষ্যযোগ্য বিষয়। বোড়ো সন্ত্রাসবাদীরা তো অসমে চূড়ান্ত শক্তিশালী। মিজো ক্রিশ্চিয়ানদের একটি বিরাট অংশ সশস্ত্র অভ্যুত্থানের জন্য প্রাণপাত লড়াই করেই যাচ্ছে। ক্রিশ্চিয়ান নাগারা ভারতের নাগরিক— এই নীতিতেই বিশ্বাস করে না। এই বাবদে ‘India Today’ বিস্তর নিবন্ধ/ আলোচনা ছেপেছে।
সন্ত্রাসবাদকে অনেকে দুটো ভাগে ভাগ করে থাকেন। ১. ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ, ২. ধর্মনিরপেক্ষ সন্ত্রাসবাদ অর্থাৎ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, শ্রেণি সংক্রান্ত উপরন্তু মর্যাদা সংক্রান্ত বিষয়। রাষ্ট্র ভারতের প্রায় ৬০০টি জেলার মধ্যে ১৫০টিতে মাওবাদীরা সক্রিয় রয়েছে। থানা, স্টেশন, রেলওয়ে চলন্ত ট্রেনের ওপর ভয়ানক ও বীভৎস আক্রমণ, বিরুদ্ধবাদীদের পুরো মহল্লাকে বিধ্বস্ত করে দেওয়া, ব্যক্তিভিত্তিক হত্যা, প্রশাসনিক নানান স্তরের বহু অংশকে প্রায় অচল করে দিয়েছে। ত্রাসের সৃষ্টি করেছে। এই ‘Fear Psychosis Factor’-এ শুধুমাত্র নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত নয়, তাবৎ শক্তিশালী সরকারি কর্তাব্যক্তি পর্যন্ত বেসামাল। এর অনুপুঙ্খ নিরীক্ষণ বোধহয় জরুরি নয়। ভারতের মাওবাদীরা ‘Baader Meinhoff Gang’ এবং ‘Red Brigade’-এর মতই ধর্মনিরপেক্ষ। এদের সমর্থক সংখ্যা আর সক্রিয় কর্মী অবিশ্বাস্যভাবে বেড়ে চলেছে। ‘মুসলমান সন্ত্রাসবাদী’দের প্রভাবাধীন অঞ্চল বা সদস্য সংখ্যার তুলনায় নগণ্য। উপরের একটি অত্যন্ত সরল আলোচনা থেকে কি মনে হচ্ছে যে ভারতের মুসলমানরা সবাই সন্ত্রাসবাদী? সন্ত্রাসবাদে তাদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। বস্তুত, ইসলাম, মুসলমান, সমাজ, রাষ্ট্র, হিংসা আর সন্ত্রাসবাদ নিয়ে এতদ্দেশীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী তথা মনুবাদীরা একটি অন্ধ ধারণা পোষণ করে। এমন একটি ‘মিসচেইভাস’ বা ‘মিসিচিভিয়াস’ ধারণা কত যে মুসিবতের সৃষ্টি করে তা ধারণারও অতীত। সম্প্রতি ‘মুসলিম আতঙ্ক’-র বিষয়টি হরতরফে জোরে-শোরে প্রচারিত হচ্ছে, খুব স্বচ্ছ আর প্যাঁচহীন কথাটি হল, সন্ত্রাসবাদ আর হিংসার ধারণাটি ইসলামের ‘ফান্ডামেন্টাল’ আদর্শের ঘোর বিরোধী। খ্রিস্টীয় ইউরোপ আর ‘হিন্দু ভারতবর্ষে’ হত্যা আর সন্ত্রাস শতাব্দীর পর শতাব্দী অজস্রবার ঘটেছে নির্মমভাবে— ইতিহাস তার ‘গাওয়াহ’ রয়েছে, সে কিসসায় যাচ্ছি না। শুধুমাত্র ‘ইয়াদ’ করিয়ে দিলাম। আত্মতুষ্টিতে ভোগে এমন ব্রাহ্মণ্যবাদী পণ্ডিতস্মণ্যদের, অসাধারণ মানবতন্ত্রী নায়ক এম. এন. রায় ইসলামের মর্মবস্তু সম্পর্কে ‘সমঝে’ দিয়েছিলেন তাঁর ‘The Historical Role of Islam’ (১৯৩৬) নামক দিক নির্দেশক গ্রন্থে। জাস্টিস সৈয়দ আমির আলি ‘দ্য স্পিরিট অব ইসলাম’ নামীয় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গ্রন্থেও অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ রয়েছে। এহ বাহ্য আমির আলির বিশ্ববিশ্রুত ‘কেতাব’টি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৯১ সালে, লন্ডনে।
সাম্প্রতিককালে ‘হিন্দু সন্ত্রাসবাদ’ বলে একটি ধারণাও জন্ম নিচ্ছে। ‘ফ্যাসিস্ট’ স্টাইলটি তারা বেশ রপ্ত করেছে। নানান সময়ে নানান দেশে আন্তর্জাতিক আর অভ্যন্তরীণ বহু কারণে সন্ত্রাসবাদের উত্থান লক্ষ্য করা গেছে। স্বভাবতই ক্রিশ্চিয়ান, ইহুদি, হিন্দু, শিখ, এমনকি বৌদ্ধদেরও সন্ত্রাসবাদে আসক্ত হতে দেখা গেছে এবং হাল আমলেও যাচ্ছে। ‘ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ’-এর চেয়ে বহুগুণে শক্তিশালী ‘ধর্মনিরপেক্ষ সন্ত্রাস’বাদীরা; বিশেষত নৈরাজ্যবাদী ও মাওবাদীরা। তাহলে এদেশে শুধুমাত্র মুসলমানদেরকেই সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে কেন? এর কতকগুলো বিশেষ তাত্ত্বিক কারণ আছে বলে বিশ্বাস করা যেতে পারে। সেগুলো কি তা বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। অন্ধ বিশ্বাস একেবারে বিষের মতো। শৈশবকাল থেকে এই বিষকে সাফ-সুতরো করে না রাখলে পরবর্তীতে সঠিক/বেঠিক চিহ্নিত করাই মুশকিল হয়ে পড়ে। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের একটি বিরাট অংশ বিশ্বাস করে থাকেন যে তাঁর ধর্মই শ্রেষ্ঠ। বাকি সব ঝুট। এর ফলে মানুষ প্রায় জ্ঞানান্ধ হয়ে যায়। আজকের দুনিয়ায় ইসলাম হচ্ছে সর্বাপেক্ষ ‘Misunderstood Religion’. ক্রিশ্চিয়ানিটির পর দ্বিতীয় বৃহত্তম অনুসারী ইসলাম ধর্মেরই রয়েছে। অন্য ধর্মের তুলনায় ইসলামেই ধর্মান্তরিত অনুসারীদের সংখ্যা অগণন। ক্রিশ্চিয়ানিটির সঙ্গে ইসলামের এই ‘জং’ বহু শতাব্দীর। সেই ক্রুশেডের কাল থেকে। প্রথম ক্রুশেডের সময়কাল ছিল ১০৯৭ খ্রিস্টাব্দ। সপ্তম ক্রুশেড শেষ হয়েছিল ১২৭০ খ্রিস্টাব্দে। ঐতিহাসিক গিবন ইসলামের বিস্তারকে বৈপ্লবিক বলে চিহ্নিত করেছেন। মহান নবী হজরত মুহাম্মদ সা.-এর মৃত্যুর ৯০ বছরের মধ্যে ইসলাম পৌঁছে গেছে হিমালয় থেকে আড্রিয়ার্টিক স্পেন, আটলান্টিক মহাসাগর, দক্ষিণ ফ্রান্স, মধ্যপ্রাচ্য, মেসোপটেমিয়া, সিরিয়া, মিশর, জেরুসালেম, পারস্য, পশ্চিম তুর্কিস্তান, পাঞ্জাব, বাইজানটাইন এবং বারবারের কাছ থেকে আফ্রিকা, ভিসিগথদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলেন স্পেন। পশ্চিমে তারা আক্রমণ করলেন ফ্রান্সকে আর পূর্ব কনস্ট্যান্টিনোপলকে। আলেকজান্দ্রিয়া, সিরিয়ার বন্দর, গ্রিসের দ্বীপগুলো দখল করল, বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের নৌবহরকে ইসলামের সৈনিকরা জানাল চ্যালেঞ্জ। ভূম্যধসাগরের ওপর রোমের আধিপত্যকে প্রায় ধ্বংস করে দিল। ‘দ্য হিস্টোরিকাল অব ইসলাম’ গ্রন্থে এম. এন. রায় সোজাসুজি বলছেন, ‘ইউরোপের এক প্রান্ত থেকে আর এক পর্যন্ত সমস্ত খ্রীস্টান রাষ্ট্র, প্রাচ্যের এক নবীন বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত সভ্যতার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হল।’ বঙ্গানুবাদ, ‘ইসলাম ধর্মের এতিহাসিক ভূমিকা, পৃ. ১২, ১৩, ১৪। উপরন্তু দেখুন H. A. L Fisher, History of Europe, PP 137-8.
পরবর্তীতে তুরস্কের ‘অটোমান সাম্রাজ্য’ ইউরোপের ব্যাপক অংশ দখল করে নিয়েছিল। রাজনৈতিক কারণেই ইউরোপীয় খ্রিস্টধর্মী শাসকবর্গ ইসলামের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করত। ইসলাম যেমন বিশ্বজনীন ধর্ম, তেমনি খ্রিস্টান ধর্মও। রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বে মুসলমানদের নিষ্প্রভ প্রমাণ করবার জন্য ব্রিটিশ ঐতিহাসিক এবং ধর্মতত্ত্বগণ ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে নানাপ্রকার ভাষ্য রচনা করতে লাগলেন। খেলাফতকে কেন্দ্র করে অনেক ইংরেজ ঐতিহাসিক ইসলাম ধর্মকে আক্রমণ করে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। প্রফেসর মনির উইলিয়াম (Professor Monir Willium) তাঁর ‘Progress of Indian Religious Thought’ নামক গ্রন্থে ইসলামকে চিহ্নিত করেছিলেন, ইহুদিবাদের জারজপুত্র’ হিসেবে এবং রাসূল সা.-এর জীবনীকার স্যার উইলিয়াম ম্যুর লিখেছিলেন যে, ‘বিশ্বসভ্যতা, স্বাধীনচিন্তা, সত্যের কঠোরতম শত্রু হচ্ছে মুহাম্মদের তরবারি আর কুরআন।’ (The sword of Muhammad and the Quran are the most stubborn enemies of Civilization, Liberty and truth which the world yet known)। ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করতে ম্যালকম ম্যাককোল ইসলামকে একটি ‘বর্বর’ ধর্ম বলে আখ্যায়িত করেন। (কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী, ভূমিকা’ সৈয়দ আলী আহসান, লেখক: এম. আর আখতার মুকুল, প্রকাশক: সাগর পাবলিকেশন, ঢাকা। পৃ. ১১-১২।) এশিয়া, আফ্রিকা আর ইউরোপে ইসলামধর্মী শাসকবর্গের গৌরবজনক উপস্থিতিতে খ্রিস্টীয় ইউরোপ হিংসাতুর হয়ে ওঠে। ‘আলেকজান্দ্রিয়া থেকে কার্থেজ পর্যন্ত উত্তর-আফ্রিকা ছিল একমাত্র এলাকা যেখানে ইসলামের প্রসারের সাথে সাথে খ্রিস্ট ধর্ম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছিল।’ (এম. এন. রায়, ‘ইসলাম ধর্মের ঐতিহাসিক ভূমিকা’, পৃ. ৪৫-৪৬)। একটু অগেই ‘ক্রুশেড-এর কথা বলেছি। ‘ক্রিশেনডম’, ইসলামের এই প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা রোধে ব্যর্থ হয়ে যায়। তাদের নিজেদের জায়গাতেই ইসলামকে ধ্বংস করে দিতে পারেনি। এর পরেই শুরু হয়ে যায়, ইসলামকে নিন্দিত একটি ধর্মীয় মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার অপপ্রয়াস। স্পেঞ্জার নামক একজন খ্রীষ্ট ধর্মবেত্তা মহান নবী হজরত মুহাম্মদ সা.-কে হৃদয়হীন, নির্মম এবং অসফল নেতা হিসেবে চিত্রিত করে। ২০০১-এর ১১ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কের ‘World Trade centre’ এবং ওয়াশিংটনের পেন্টাগনে ধ্বংসাত্মক আক্রমণের পর ‘ইসলামফোবিয়া’ হিস্টিরিয়ার আকার নেয়। অমুসলিম দুনিয়ায় আরও দুটি ধারণা আমূল প্রোথিত। ১. ইসলাম তরবারি দ্বারা প্রচারিত। ২. হজরত মুহাম্মদ সা. এই বর্বর অভিযানের নেতা। এই বিষয় দুটোর ব্যাপারে ইসলামধর্মীরা আকাশস্পর্শী ‘সেনসেটিভ’। ফার্সিতে একটি কহাবত আছে:
‘বা খুদা দিওয়ানা বাসো,
বা মোহাম্মাদ হোশিয়ার।’
অর্থাৎ, ‘খুদা সম্পর্কে তুমি যা খুশি বলো / কিন্তু মুহাম্মদ সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করার আগে হুঁশিয়ার হয়ে যাও।’পাশ্চাত্যের ইসলাম বিরোধী প্রচার ভারতের শহরে, প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে শিক্ষিত ব্যক্তিদের ওপর গভীরভাবে রেখাপাত করে। ঐতিহাসিক নানান প্রেক্ষাপটে এমনিতেই ইসলাম সম্পর্কে সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা ঘৃণার মনোভাব পোষণ করে। পাশ্চাত্যের নিরন্তর প্রপাগান্ডার মধ্যে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রায়ান্ধ জনসমাজ সান্ত্বনা খুঁজে পায় এবং মুসলমানদের সন্ত্রাসবাদী ভেবে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা পুলকিত হয়। মুসলিম ও হিংসা আর সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে এই আজগুবি ও ভূতুড়ে তত্ত্বকে জোরে-শোরে প্রচার করে। হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা উচ্চারিত ‘অ্যান্টি মুসলিম বেটরিক’-এ বিদ্ধ হয় মুসলিম ভারতীয়রা। হরওয়াক্ত এই ধরনের হীন প্রচারে শান্তি বিঘ্নিত হয়। সাম্প্রদায়িকতা, দেশ-দশকে গ্রাস করে। নয়া ভারতের ‘নব্য হিন্দুত্ববাদীরা’ ব্রাহ্মণ্যবাদকে সহিষ্ণু বলে জাহির করে। এই দাবি হাস্যকরভাবে বৈপরীত্যে ভরা। ইতিহাসে তার ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে। সে আলোচনায় আমরা যাচ্ছি না। এমনতর পরিস্থিতিতে, একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগঠনের শাসনতান্ত্রিক ‘ওয়াদা’ অধরা এবং অপূরিত থেকে যায়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct