পাভেল আখতার, আপনজন: পুকুরে ঢিল ছুঁড়লে যে আবর্তের সৃষ্টি হয় তা মিলিয়ে যেতে বেশিক্ষণ সময় লাগে না। আমাদের সমষ্টিগত ও উচ্চকিত প্রতিবাদগুলোও ঠিক তেমনই। দেখা যায়, একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, আর আমরা ধিক্কারে, ঘৃণায়, ক্রোধে ফেটে পড়ি, প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠি ; কিন্তু তারপর? প্রশ্ন উঠবে, আমরা এর চেয়ে বেশি কী করতে পারি? পারি, অনেক কিছুই করতে পারি। অন্য সময় তো খুব বলি, মানুষ অসাধ্যসাধন করতে পারে, পঙ্গুও পাহাড় ডিঙিয়ে যায় ইত্যাদি! তাহলে এক্ষেত্রে এই প্রশ্ন কেন?
রোগের চিকিৎসা করতে গেলে আগে রোগের কারণ নির্ণয় করতে হয়। একথা ঠিক যে, ধর্ষণ যে করে তার কঠিন শাস্তি দরকার। হত্যা যে করে তারও কঠিন শাস্তি দরকার। সর্বোচ্চ শাস্তি দরকার। অপরাধী বিন্দুমাত্র সহানুভূতি পাওয়ার যোগ্য নয়। কিন্তু, শুধু শাস্তিই কি ধর্ষণ, হত্যা এই অপরাধগুলির উৎপাটনে সহায়ক? না। শাস্তি কেবল মুদ্রার একটি দিক। অন্য দিকটি হ’ল, অনিয়ন্ত্রিত যৌন উত্তেজনার ও হিংস্রতার প্ররোচক সমস্ত উৎসমুখগুলিও বন্ধ করা প্রয়োজন। পর্নো সাইট থেকে শুরু করে চোলাই মদ নিষিদ্ধ তো করতে হবেই, তার সঙ্গে চলচ্চিত্রে উত্তেজক যৌন দৃশ্য, মারদাঙ্গার প্রদর্শনীও বন্ধ করতে হবে। আরও আছে। শিশুকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সঙ্গ, স্নেহ-ভালবাসা দিতে হবে। আর তাকে মনুষ্যত্বের পাঠটি অবশ্যই দিতে হবে, যে পাঠে অবশ্যই থাকবে সমস্ত নারীকে ‘মা, বোন, মেয়ে, বন্ধু, সর্বোপরি মানুষ’ হিসেবে দেখা ও শ্রদ্ধার মনোভঙ্গি অর্জন করা। কিন্তু তার আগে যে নিজেকে বিশুদ্ধ হতে হবে! কেমন করে? বিভিন্ন আঙ্গিকের চর্চায় নারীকে নিছক ভোগ্যপণ্য ভাবার মানসিকতাটা বিসর্জন দিতে হবে। নইলে আপন ঘরের শিশুটিকে কীভাবে ওই শিক্ষা দেওয়া যাবে? নরকের কীট ধর্ষকরাই তো শুধু নয়, দেখা যায় প্রতিদিন মানুষের চোখের দৃষ্টিতে, মুখের বচনে, মনে-মননে, শয়নে-স্বপনে কত নারী যে ‘ধর্ষিতা’ হয় তার কি সীমাসংখ্যা আছে? ধর্ষকরা ‘দুঃসাহস’টা দেখিয়ে ফেলছে, আর কেউ দেখাতে পারছে না, আদতে দুটো ব্যাপারই কিন্তু এক! অতএব, সমাজমানসের শুদ্ধিকরণ খুব জরুরি। আমরা এমনটাও দেখতে পাই যে, ধর্ষণ হলে ধর্ষিতার চরিত্র নিয়েও সমাজে সন্দেহ ওঠে, প্রশ্ন অনুরণিত হয়--তার পোশাক, তার একাকী অথবা ‘বন্ধু’সহ বাইরে বেরোনো নিয়ে ইত্যাদি। এ কেমন পরস্পরবিরোধিতা? একদিকে ধর্ষিতার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন, আবার ধর্ষণের জন্য শাস্তির দাবি! এজন্যেই শুদ্ধিকরণ জরুরি!
ইদানীং শুরু হয়েছে ‘ধর্ষণ-রাজনীতি’! এত কলরব, কোলাহল ইত্যাদি এই শব্দবন্ধটিকেই কেবল যেভাবে উচ্চকিত করে তুলছে তাতে সমাজ থেকে ধর্ষণ ও হত্যা বন্ধের চেয়ে যেন সেটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে, যার থেকে মুক্তি কীভাবে মিলবে? সমাজ ধর্ষণমুক্ত হোক--এই অভিপ্রেত একমাত্রিক শুদ্ধ আকাঙ্ক্ষার বিস্তার যদি ‘ধর্ষণ-রাজনীতি’ ছাপিয়ে না তরঙ্গিত হয় তাহলে কি সব কলরব, কোলাহলই একসময় দিগন্তে মিলিয়ে যাবে না?
সত্যি বলতে কি, যে বাস্তবতা নিত্যদিন প্রত্যক্ষগোচর হচ্ছে তাতে দিনের শেষে হতাশাই গ্রাস করছে! এমনও বলতে হচ্ছে, যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে, আমাদের সমাজব্যবস্থায় কি কি বিলুপ্ত হওয়ার আশা ছেড়ে দেওয়াই ভাল তাহলে সেই তালিকাটা দীর্ঘ হতে বাধ্য! ধর্ষণ, পণপ্রথা, র্যাগিং ইত্যাদি। কেবল কঠোরতম শাস্তি দিয়েই যে এসব বন্ধ করা সম্ভব নয় সেই ভাবনা ও বোধের উদয় কোথায়? ভাবনা ও বোধের কাম্য দিগন্তে উপনীত হতে আমরা কি পেরেছি? চিকিৎসাব্যবস্থায় দুটি প্রথা আছে। প্রতিকার ও প্রতিরোধ। শাস্তি হচ্ছে প্রতিকার। আসল চিকিৎসা সেটা নয়। প্রতিরোধই হচ্ছে প্রকৃত চিকিৎসা। আমাদের সমষ্টিগত চিন্তার গোড়ায় গলদটা হচ্ছে যে, যে অনিঃশেষ চারিত্রিক অবনমন, মনুষ্যত্বের বিনাশকাল শুরু হয়েছে সেটা নিয়ে আমরা সম্ভবত ভাবিত নই! চরিত্র গঠনের আগেও তা ধ্বংসের উৎস সম্পর্কে চেতনার বিকাশ দরকার, যা উপরে কিঞ্চিৎ বর্ণিত হয়েছে। এবং, শৈশব থেকেই চরিত্রবান বা ভাল মানুষ হিসেবে গড়ার কাজটা শুরু করা দরকার। এবং, সেটা অবশ্যই নিজ নিজ পরিবারে। ইস্কুল-কলেজকে যতই গালভরা কথায় বলা হোক না কেন--’মানুষ গড়ার কারখানা’, আদতে সেটা নিছক ‘কেতাবি শিক্ষিত’ বানানোর বা ডিগ্রি প্রদানের জায়গা। উপরন্তু ‘শিক্ষিত’ হলেই যে ‘ভাল মানুষ’ হবে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় সেটা সোনার পাথরবাটিতে পরিণত হয়েছে! সত্যি কথা এই যে, দায়িত্বটা আসলে পরিবারের বা মা-বাবার।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct