যাকে বলে অকালবোধন। অযোধ্যায় অসম্পূর্ণ রামমন্দিরের উদ্বোধন হয়ে গেল ২২ জানুয়ারি। ঠিক লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে। রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা হল। আলোর রোশনাই, তারকাদের ভিড়, উন্মাদ ভক্তের উচ্ছ্বাস –এ সব ছিল। সংবাদ মাধ্যমের একটা অংশ ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করার কসুর করল না যে এর ফলে নির্বাচনের আগে একটা রাম-জ্বরের ঢেউ উঠবে। হিন্দি বলয় বা গোবলয় তো বটেই, দেশের অন্যান্য অংশে পড়বে তার প্রভাব। বলা হল হিন্দুদের পাঁচশ বছরের আশা পূর্ণ করল ভারতীয় জনতা দল। ভক্তিপ্রণত হিন্দুরা সে দলকে দুহাত তুলে আশীর্বাদ করবে। ভরিয়ে দেবে ভোটের ঝুলি। যেমন ভরিয়ে দিয়েছিল ২০১৪ আর ২০১৯এর নির্বাচনে। লিখেছেন দিলীপ মজুমদার।
কে বলে অকালবোধন। অযোধ্যায় অসম্পূর্ণ রামমন্দিরের উদ্বোধন হয়ে গেল ২২ জানুয়ারি। ঠিক লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে। রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা হল। আলোর রোশনাই, তারকাদের ভিড়, উন্মাদ ভক্তের উচ্ছ্বাস –এ সব ছিল। সংবাদ মাধ্যমের একটা অংশ ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করার কসুর করল না যে এর ফলে নির্বাচনের আগে একটা রাম-জ্বরের ঢেউ উঠবে। হিন্দি বলয় বা গোবলয় তো বটেই, দেশের অন্যান্য অংশে পড়বে তার প্রভাব। বলা হল হিন্দুদের পাঁচশ বছরের আশা পূর্ণ করল ভারতীয় জনতা দল। ভক্তিপ্রণত হিন্দুরা সে দলকে দুহাত তুলে আশীর্বাদ করবে। ভরিয়ে দেবে ভোটের ঝুলি। যেমন ভরিয়ে দিয়েছিল ২০১৪ আর ২০১৯এর নির্বাচনে।রাম-রাজনীতিকে হাতিয়ার করে পথে নেমেছিল ভারতীয় জনতা দল। গত শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে যার শুরু। তারপরে রামরথযাত্রা, তারপরে বাবরি ধ্বংসের আয়োজন, তারপরে বিশ্বাসের ভিত্তিতে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় এবং তারপরে ২০১৪তে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারতের মসনদে বিজেপির অধিষ্ঠান এবং ক্রমিক শক্তিবৃদ্ধি। ‘ওহি মন্দির বানায়েঙ্গে’ স্লোগান বাস্তবায়িত হল বলে মনে করা যেতে পারে যে ২০২৪এর নির্বাচনে আসর মাত করবে বিজেপি। দেশের কোণায় কোণায় রাম-জ্বরের উত্তাপ ছড়িয়ে দিয়ে, বিরোধীদের ‘রামবিরোধী অতএব হিন্দুবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে এককাট্টা করবে হিন্দুভোট।কিন্তু না, শুধু রামচন্দ্র এবার নির্বাচনী বৈতরণী পার করাতে পারবেন না। কারণ এর মধ্যে বহু বহু প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। সাধারণ মানুষ, সাধু-সন্ত, এমন কি বিজেপির ভেতর থেকেই উঠতে শুরু করেছে প্রশ্ন। উঠেই থেমে যাচ্ছে না প্রশ্ন, আবার নতুন নতুন প্রশ্ন উঠছে। প্রশ্নগুলো এ রকম :
---এমন তাড়াহুড়ো করে উদ্বোধন কেন ? ভোটের জন্য ?
---অসম্পূর্ণ মন্দিরে কিভাবে হয় দেবতার প্রাণপ্রতিষ্ঠা ?
---রামলালার চেয়ে অনেক লম্বা নরেন্দ্র মোদির কাট-আউট কি দেবতার অসম্মান নয় ?
----দেবতার প্রাণপ্রতিষ্ঠা তো ধর্মগুরু সাধুদের করার কথা,সেখানে নরেন্দ্র মোদি কেন ?
--সমগ্র অনুষ্ঠান রামময় না হয়ে মোদিময় হল কেন ?
কারা তুলছেন এই সব প্রশ্ন ? বিরোধীরা নয়। তুলছেন ‘সনাতন ধর্মে’র মানুষজন। প্রশ্ন তুলছেন শঙ্করাচার্ষরা, প্রশ্ন তুলছেন হিন্দু মহাসভা। প্রশ্ন তুলছেন নির্মোহী আখড়া। প্রশ্ন তুলছেন রামানন্দ সম্প্রদায়ের সাধুরা। তার মানে সনাতন ধর্মের প্রবক্তাদের হাতে বিদ্ধ হচ্ছে সনাতনধর্মী বিজেপি। তার মানে একই ধর্মের মধ্যে বেধেছে বিরোধ। এর আগে এমন সংকটে পড়তে হয় নি বিজেপিকে।
এখানেই থামছে না প্র্রশ্ন। প্রশ্ন উঠছে :
---কোথায় গেল রামলালার পুরাতন মূর্তি ?
---পুরাতন ট্রাস্টের বদলে কেন গঠন করা হল নতুন ট্রাস্ট ?
---সেই নতুন ট্রাস্টের কিছু মাতব্বর, যেমন সম্পত রায়,কেন মোদিকে বিষ্ণুর অবতার বলে প্রচার করছেন ?
----মন্দির উদ্বোধনে কেন দেখা গেল না রামজন্মভূমি আন্দোলনের মূল হোতাদের ? কেন এলেন না লালকৃষ্ণ আদবানি, উমা ভারতী, বিনয় কাটিয়ার, মুরলিমনোহর যোশী ? কতজন করসেবককে নেমতন্ন করা হয়েছিল ?
---অনুষ্ঠানে কেন আসেন নি রাষ্ট্রপতি ? মোদিপ্রেমে মুখর উপরাষ্ট্রপতিই বা কেন অনুপস্থিত ?
না, এর আগে বিজেপিকে এত প্রশ্নে বিক্ষত হতে হয় নি। আর এই সব প্রশ্নের কেন্দ্র রয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। তাঁর লার্জার দ্যান লাইফ যে ভাবমূর্তি তৈরি করা হয়েছিল, সেটাই হয়েছে কাল। সব কিছুকে, দলের সব নেতাকে গ্রাস করতে চাই্ছেন তিনি। তিনিই সব, তাঁর জন্যই সাফল্য। তাই তিনি যা বলবেন তাই বেদবাক্য। যে কোন নেতাকে তিনি ওঠাবেন, যাঁকে মনে হবে বসিয়ে দেবেন। বসুন্ধরা রাজে, মধ্যপ্রদেশের মামা শিবরাজ তার উদাহরণ। দীর্ঘ তালিকায় আছেন রাজনাথ সিং, নিতীন গড়করি, এমন কি যোগী আদিত্যনাথ। অযোধ্যা যোগীরাজ্যের অর্ন্তভুক্ত না হলে রামমন্দিরের অনুষ্ঠানে তিনি আসতে পারতেন কিনা সন্দেহ। বিজেপিশাসিত রাজয়ের সব মুখ্যমন্ত্রীকে দেখা যায় নি অনুষ্ঠানে। এই তো কদিন আগে যোগী আদিত্যনাথ একটি সাক্ষাৎকারে পরোক্ষভাবে নরেন্দ্র মোদির ঘনঘন পোশাক পরিবর্তন নিয়ে কটাক্ষ করেছেন নাম উল্লেখ না করে। যোগীকে জব্দ করার জন্য অমিত সাহ তাঁর পছন্দের একজনকে উপমুখ্যমন্ত্রীর পদে বসিয়ে দিয়েছেন। এ বেদনা কি ভুলতে পারবেন যোগীরাজ ? লালকেল্লার অনুষ্ঠানে দেখেছি ছাপান্ন ইঞ্চি ছাতি ফুলিয়ে মোদি সাহেব যখন সকলের অভিবাদন গ্রহণ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছেন, তখন তাঁকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন নিতীন গড়করি। প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্যপাল সিং, সুব্রহ্মণ্যস্বামী মুখ খুলছেন।না, এর আগে বিজেপিকে এমন রাজনৈতিক-সাংগঠনিক সংকটের মুখোমুখী হতে হয়নি। অথচ নরেন্দ্র মোদি একেবারে বেপরোয়া। যেমন বিরোধীদের প্রতি, তেমনি নিজের দলের নেতাদের প্রতি।কিন্তু দলকে, দলের বর্ষিয়ান নেতাদের উপেক্ষা করার সাহস কি করে হল নরেন্দ্র মোদির ? কে বা কারা দিল সেই সাহস? প্রথমত সমস্ত নিন্দা ও সমালোচনাকে কণ্ঠরুদ্ধ করার পাশুপত অস্ত্র তাঁর হাতে আছে ; আছে ইডি, সিবিআই, ইনকাম ট্যাক্স এজেন্সিগুলি।দ্বিতীয়ত আছে গোদি মিডিয়া আর আইটি সেল ; যাদের ফলে সত্যকে মিথ্যা করা বাঁয়ে হাতকা খেল।তৃতীয়ত আছে ইভিএম মেশিন। সুপ্রিম কোর্টের উকিলরা এ নিয়ে শুরু করেছেন আন্দোলন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন প্রযুক্তিবিদরা। এঁরা ব্যালট পেপারে ভোট করার জন্য জনমত তৈরি করতে শুরু করেছেন রাজ্যে রাজ্যে ঘুরে। এঁরা বলছেন ইভিএম হভাক করে ভোটে জিতেছে বিজেপি। তাই মুধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়ে পুনর্নিবাচন দাবি করছেন তাঁরা।এদিকে নানা ঘোটালায়, নানা জুমলায় জড়িয়ে যাচ্ছে তাঁর নাম। গোবলয়েও জাগছে ক্ষোভ। মোদিসংস্কারের কুয়াশা কাটছে ধীরে ধীরে। ভারতচন্দ্রের কথাটা দাগ কাটছে মানুষের মনে : নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায় ?
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct