দিলীপ মজুমদার: রসের ভক্ত আমরা সবাই। সেদিক থেকে আমরা সবাই রসিক। রসগোল্লার রসের কথা আসে। সে রস আমরা চেটেপুটে খাই। ফলের রসর কথাও বলা যায়। চুকচুক করে সে রস আমরা খাই। চোখে দেখা যায় এসব রস। চোখে দেখা যায় না এমন রসও আছে। চোখে যা দেখা যায় না, তা কী নেই নাকি! আল্লা বা ভগবান বা গডকে কী চোখে দেখা যায়? যায় না। তা বলে তিনি কী নেই নাকি !
চোখে দেখা যায় না এমন অনেক রসই আছে। যেমন প্রেমের রস, কামের রস, লোভের রস, হিংসার রস। আরও কত কী ! রাজনীতিতেও একটা নতুন রস আছে। সেটা হল প্রতিশ্রুতির রস। তাকেও দেখা যায় না চোখে। তবু সে আছে, বহাল তবিয়তেই আছে। যাকে নেতাবাবুরা বলেন ‘জনতা-জনার্দন’, সেই জনতা-জনার্দনকে প্রতিশ্রুতির রস পান করালেই কেল্লা ফতে। তারা নেচে-কুদে মাতাল হয়ে যাবে। এ রসের নেশার মতো নেশা আর কিছুতে নয়। মদ, গাঁজা, চরস, কোকেন, মারিজুয়ানা হেরে ভূত হয়ে যাবে।
ভোট এলে উছলে পড়ে প্রতিশ্রুতির রস। লাল, নীল, হলুদ দলের নেতারা দেদার বিলিয়ে যান এই রস। দিল্লিকা লাড্ডুর মতো সে রস ঝুলতে থাকে জনতা-জনার্দনের মুখের সামনে। তারপরে তারা তিরিয়ে তিরিয়ে পান করে সে রস। না, মশাই, জেনেবুঝে বিষ পান নয়। ঘোরের মধ্যে সে রসটাকে বিষ বলে মনেই হয় না। আরে, এ রসে তো দাদু মজেছিল, তারপরে মজল বাবা, এখন আমি। রসে মজে দলের গুণগান করি, ভোট দিতে ছুটে যাই আকুল হয়ে।
এ রস বড় উপাদেয়। হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্তদের মতো গরিব-গুর্বো দের কাছে এ রস যে সঞ্জীবনী সুধা। ভোট এলে এই রস পান করে তারা পরবর্তী ভোট পর্যন্ত বেঁচে থাকার শক্তি পায়। সেটা কী কম কথা! হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকি লাগে, তা লাগুক, বেঁচে তো থাকে !
এই দেখুন, আমাদের রঙ্গভরা বঙ্গদেশে ভোটের ঢাকে কাঠি পড়েছে। তাই উছলে উঠেছে প্রতিশ্রুতির রস। রামরাজ্যের প্রতিশ্রুতি, সোনার বাংলার প্রতিশ্রুতি, দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি, গরিবের কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি, বেকারিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার প্রতিশ্রুতি...। আমাদের মহামহিম নেতারা, নেতার চামচেরা অক্লান্তভাবে বিলিয়ে চলেছেন প্রতিশ্রুতির রস। বলতে বলতে তাঁরা বলার আর বাকি রাখেন না কিছু। হবে হবে সব হবে। সব করে দেব। বন্ধ্যা নারীর সন্তান করে দেব, মূককে বাচাল করে দেব, পঙ্গুকে গিরি লঠ্ঘনে সক্ষম করে দেব, অপুষ্টিজর্জর শিশুর মুখে কোলগেটের হাসি ফুটিয়ে দেব, জিরো ব্যালান্স পাশবুকে টাকা ভরে দেব, ঘরে ঘরে কম দামে গ্যাস সিলিণ্ডার পাঠিয়ে দেব, বেকারদের কাজের বান ডেকে দেব, কলকারখানায় দেশ উজাড় করে দেব...। হাঃ হাঃ, আমরা সব পারি, আমরা জাদুকর।
এও এক খেলা। খেলাটা কী বোঝে না হাসিম শেখ, রামা কৈবর্তরা ? বেশ বোঝে। এর আগের ভোটে এমনি সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সব ভোটেই থাকে, সব দলই দেয়। না দিয়ে উপায় নেই। প্রতিশ্রুতি তো ভোট বৈতরণী পার হবার উপায়, অন্যতম উপায়। হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্তরা জেনেবুঝে পান করে প্রতিশ্রুতির রস। কেন পান করে ? কারণ অলৌকিক এই রস পান করে তারা স্বপ্ন দেখে। আগামী দিনের স্বপ্ন। ভবিষ্যতের স্বপ্ন। এই স্বপ্নটাই যে তাদের একমাত্র সম্বল।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct