দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দেশ মালয়েশিয়ায় বহুল আলোচিত নির্বাচনের পর আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বে ঐক্য সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আনোয়ারের পাকাতান হারাপান জোট ছাড়াও রয়েছে বারিসান ন্যাশনাল ও সারাওয়াকের জিপিএস জোট। অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার হিমালয় কন্যাখ্যাত দেশ নেপালে সংসদের পূর্ণ মেয়াদ শেষে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শাসক জোট সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা গেলেও জোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে নতুন হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। এ নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ তৃতীয় কিস্তি।
পালে জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর বেশ কয়েক দিন পেরিয়ে গেলেও পূর্ণাঙ্গ ফলাফল আসেনি। তবে নির্বাচনী ফলের একটি পূর্ণ চিত্র বোঝা যাচ্ছে। এই চিত্র অনুসারে কেপি শর্মা ওলির নেতৃত্বাধীন বিরোধী নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (ইউনাইটেড) সর্বাধিক ২৮ শতাংশের মতো ভোট পেলেও জোটগত সমীকরণে প্রধানমন্ত্রী দেউবার নেপাল কংগ্রেসের প্রাপ্ত আসন সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। নেপালের সংবিধানে এমন এক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও নির্বাচন পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয় যেটি দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো দেশে নেই। নেপালের গণতন্ত্র ও নির্বাচনের অভিনব দিকটি হলো এতে একটি মিশ্র নির্বাচনপদ্ধতি রয়েছে, যেখানে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সংসদের ৬০ ভাগ সদস্য (কেন্দ্রীয় সংসদে ২৭৫ এর মধ্যে ১৬৫ জন) নির্বাচিত হচ্ছেন প্রত্যক্ষ প্রতিদ্বিদ্বতায় সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্তির ব্রিটিশ পদ্ধতিতে। বাকি ৪০ ভাগ আসনে (কেন্দ্রে ১১০ আসন) রাজনৈতিক দলগুলো যে প্রার্থী তালিকা দেবে সেখান থেকে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে ক্রম অনুসারে সংসদ সদস্য বাছাই করা হবে। ১৮ বছর ও এর বেশি বয়সের ভোটাররা দু’টি ব্যালটের একটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থী এবং আরেকটিতে দলের পক্ষে ভোট দেন। এই ব্যবস্থায় কম ভোট পেয়ে অনেক বেশি আসনপ্রাপ্তির অসম ব্যবস্থা যেমন এড়ানো যায় তেমনি দলের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিরা নির্বাচনে প্রতিদ্বিদ্বতা না করে দলের মনোনীত হয়ে সংসদে যেতে পারেন। এবার ১৬৫টি আসনে যে সরাসরি নির্বাচন নেপালে অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে ১৫৫টির ফলাফল অনুসারে শাসক জোটের তিন দল সোয়া শ’ আসনে জয় পাচ্ছে। চূড়ান্ত ফলাফলে আরো ৪-৫টি আসন বাড়তে পারে। এখন পর্যন্ত পাওয়া ফল অনুসারে ইউনাইটেড নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি সবমিলিয়ে ৭৪টি আসন পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবার নেপালি কংগ্রেস পেয়েছে ৮৬টি আসন। মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি পাচ্ছে ৩২টির মতো। মাধব চন্দ্র নেপালের ইউনিফাইড সোশ্যালিস্ট কমিউনিস্ট পার্টি পাচ্ছে ১০টির মতো আসন। রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টি লাভ করছে ২১টি, রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি ১৫টি, পিপলস সোশ্যালিস্ট পার্টি ১০টি আসন পাচ্ছে। লোকতান্ত্রিক সমাজবাদী পার্টি পাচ্ছে চারটি এবং নেপাল উনমুক্তি পার্টি লাভ করছে তিনটি আসন। এর বাইরে ছোট ছোট দল ও স্বতন্ত্র সদস্যরা গোটা দশেক আসনে জয় পেতে চলেছে।
নির্বাচনপূর্ব জোট হিসাব করা হলে ১৩৮ আসনের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কংগ্রেস-মাওবাদী-সোশ্যালিস্ট জোটের সরকার গঠন খুব একটি কঠিন হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে শাসক জোটে নেপালি কংগ্রেসের ফল ভালো এলেও জোটের অংশীদার মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ও মাধব চন্দ্র নেপালের নেতৃত্বাধীন ইউনিফাইড সোশ্যালিস্ট কমিউনিস্ট পার্টির ফলাফল আশানুরূপ হয়নি। এ দুটি দলের নেতারা নেপালি কংগ্রেসকে দোষারোপ করতে শুরু করেছেন। তারা দলের আদর্শের সাথে নেপালি কংগ্রেসের ধ্যান-ধারণার মিল না থাকায় জনগণের মধ্যে তাদের দলকে সমর্থন কম করার প্রবণতাটি এবার পাঠ করছেন। এর ফলে এর মধ্যে কেপি শর্মা ওলির নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির সাথে মাওবাদী নেতাদের আলোচনা ও মতবিনিময় শুরু হয়েছে। নির্বাচনে জোট বা আলাদা দল হিসাবে অংশগ্রহণকারী পক্ষগুলো দেউবার কংগ্রেস বা ওলির ইউএমএল এই যেকোনো দলের নেতৃত্বে জোট সরকার গঠন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে পুষ্প কুমার দহল প্রচণ্ড ও মাধব চন্দ্র নেপালের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারে। এই দুটি দল এক হওয়ার একটি কথা উভয় দলের নেতারা বলেছেন। ফলে আগের মতো কমিউনিস্ট দলগুলো এক হলে দুয়েকটি মাদেসি দলের সমর্থনে নেপালি কংগ্রেসকে বাদ দিয়েও সরকার গঠন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে। এ ধরনের ইঙ্গিত নিয়ে এর মধ্যে নেপালি রাজনৈতিক মহলে আলোচনা হচ্ছে। এ ব্যাপারে মেরুকরণে চীন ও ভারতীয় স্বার্থের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এ নিয়ে সক্রিয় হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশও।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct