দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দেশ মালয়েশিয়ায় বহুল আলোচিত নির্বাচনের পর আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বে ঐক্য সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আনোয়ারের পাকাতান হারাপান জোট ছাড়াও রয়েছে বারিসান ন্যাশনাল ও সারাওয়াকের জিপিএস জোট। অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার হিমালয় কন্যাখ্যাত দেশ নেপালে সংসদের পূর্ণ মেয়াদ শেষে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শাসক জোট সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা গেলেও জোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে নতুন হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। এ নিয়ে লিখেছেন মাসুম খলিলী। আজ দ্বিতীয় কিস্তি।
এই ফর্মুলা অনুসারে বারিসান ন্যাশনাল থেকে জাহিদ হামিদী অথবা মোহাম্মদ হাসান হতে পারেন উপপ্রধানমন্ত্রী। সাবাহ সারওয়াক থেকে জোহারি হতে পারেন দ্বিতীয় উপপ্রধানমন্ত্রী। প্রতি পাঁচজন সংসদ সদস্যের জন্য নেয়া হতে পারে একজন মন্ত্রী। এ হিসাবে পিকেআর ও বারিসান থেকে ছয়জন করে ডিএপি থেকে আটজন আমানাহ থেকে এক বা দু’জন এবং জিএসপি থেকে চারজন আর জিআরএস ও ওয়ারিসান থেকে একজন মন্ত্রিসভায় স্থান পেতে পারেন। আর নিজ নিজ দল বা জোট তাদের পক্ষ থেকে কে কে মন্ত্রী হবেন তা নির্ধারণ করবেন। আনোয়ার দায়িত্ব গ্রহণের পরই তার অগ্রাধিকার কী হবে তা তিনি উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, সংখ্যাগুরু মালয়দের অধিকার ও ধর্মীয় বিশ্বাস সংরক্ষণে ঐক্য সরকার ভূমিকা রাখবে, একই সাথে নিশ্চিত করবে অন্য জাতিগোষ্ঠীর ন্যায়ানুগ অধিকারও। আনোয়ার এর মধ্যে মালয়েশিয়ার সব জাতিগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করতে প্রাথমিক পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছেন। তিনি ইসলাম এবং অন্য ধর্মের অনুসারীদের ভুল ধারণা দূর করতে প্রত্যেক জুমায় মুসলমানদের জন্য বক্তব্যের পাশাপাশি অমুসলিমদের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে ইসলামের মৌলিক যে বক্তব্য রয়েছে তার উপর আলোকপাত করার আহ্বান জানিয়েছেন। এটি সামাজিক ঘৃণা ও উত্তেজনার পরিবেশের পরিবর্তে সংহতি ও সমন্বয় জোরদার করবে। আর ঐক্য সরকার গঠনের ফলে সরকারে সব জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যাবে। এর পাশাপাশি আনোয়ার জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য মূল্যস্ফীতি হ্রাস ও উন্নয়ন-বিকাশে গতি আনার চেষ্টা শুরু করেছেন, যার অংশ হিসাবে ৯০ এর দশক পর্যন্ত দেশটিতে যে মূল্য স্থিতি রক্ষা বা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ছিল সেটি ফিরিয়ে আনছেন। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মূল্য নিয়ন্ত্রণের কাঠামো ভেঙে দেয়ার পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন। স্থানীয় ও বৈশ্বিক বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নের পদক্ষেপ নিচ্ছেন। এই প্রচেষ্টা গতি পেলে স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের সাথে সাথে বিদেশী শ্রমিকদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এতে বাংলাদেশ নেপাল পাকিস্তানের মতো দেশের উদ্বৃত্ত শ্রমিকদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে, অন্য দিকে স্থানীয় কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রগুলোতে শ্রমিকের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হবে না। এর সুবিধা পাবে সব পক্ষ।
এটি ঠিক যে, বলা যত সহজ বাস্তবে করা তার চেয়ে অনেক কঠিন। তবে আনোয়ার ইব্রাহিমের অতীত যারা পর্যবেক্ষণে রেখেছেন তারা বিশ্বাস করবেন যে তিনি যা বলছেন তা করার ক্ষমতা রাখেন। তার প্রাথমিক পদক্ষেপে এর মধ্যে স্থানীয় মুদ্রা রিংগিতের দাম বাড়তে শুরু করেছে। শেয়ারবাজারের সূচক ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে স্থবির বিনিয়োগের গিঁট আবার খুলতে শুরু করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘৃণা ছড়ানোর পোস্ট কমে আশাবাদ বিস্তৃত হতে শুরু করেছে। সঙ্ঘাতমুখর বৈশ্বিক পরিস্থিতিও আনোয়ারের জন্য একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। এক দিকে সক্রিয়তাবাদী চীন, অন্য দিকে চীনের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে বেপরোয়া আমেরিকা। এই দুইয়ের সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য আনা সহজ নয়। ওআইসি ও মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও রয়েছে সঙ্ঘাতমুখরতা। সৌদি ও ইরান বলয়ের মাঝখানে রয়েছে মধ্যপন্থী তুর্কি বলয়। এই তিন বলয়ের মধ্যে সংযোগ ও সমন্বয় আনতে পারাটা আনোয়ারের সামনে একটি চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া মুসলিম বিশ্বের চারটি জ্বলন্ত সমস্যা ফিলিস্তিন, রোহিঙ্গা, কাশ্মির ও সিরিয়ার সঙ্কট রয়েছে। এর প্রতিটিতে মালয়েশিয়ার ভূমিকা রাখার অবকাশ রয়েছে।আগামী ১৯ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার সংসদে প্রথম অধিবেশন আস্থা ভোটগ্রহণের মধ্য দিয়ে শুরু হবে। এর আগেই সরকার গঠনের কাজ শেষ করে আনতে হবে। আনোয়ার ঐক্য সরকারের অনেক পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হলেও বিরোধী আসনে থাকবে শক্তিশালী পাস ও বারসাতুর ৭৩ আসনের এক-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের একটি ব্লক। সব মিলিয়ে মালয়েশিয়াকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া হবে ৭৫ বছর বয়সী পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ আনোয়ার ইব্রাহিমের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ তিনি জয় করতে পারবেন বলে আশা করা যায়। মালয়েশিয়ার শক্তিশালী সুলতানরা এই যাত্রায় আনোয়ারকে সমর্থন দিয়ে যাবেন বলে মনে হচ্ছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct