ইসলাম চর্চিত জ্ঞান-বিজ্ঞান, মর্যাদা, গাম্ভীর্য আর সম্ভ্রম সম্পর্কে ওয়াকিফহাল করে তোলার অভিপ্রায়ে বর্তমান আলোচনাটির উপস্থাপনা। ‘হাফ বেকড’ তথাকথিত পণ্ডিতবর্গ ‘মধ্যযুগের বর্বরতা’ বলে আলটপকা মন্তব্য করে বসেন। ইসলাম ‘মিস আন্ডারস্টুড রিলিজিয়ন’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। ক্রুশেডের কাল থেকে এই বেতমিজ অপপ্রচার চলছে। সদ্যতন সভ্যতার আলোকবর্তিকাটি ইসলাম-ই মধ্যযুগ থেকে জ্বালিয়ে রেখেছিল। চার্চ এবং যাজক সম্প্রদায়ের কুসংস্কার আর অমানবিক কার্যাদির কারণে বহু বৌদ্ধিক ব্যক্ত্বিকে তারা নির্মভাবে হত্যা করেছে। ইসলাম তার ‘আহল-ই-কলম’ (বিদ্বৎসমাজ)-কে কস্মিনকালেও বিড়ম্বিত করেনি। সর্বোত্তম পৃষ্ঠপোষকতায় জ্ঞানের অন্তহীন বিকাশে মদদ করেছে। অত্যুজ্জ্বল এই মহত্তম বিষয়টির উপর আলোকপাত করলেন এই বঙ্গের মেধা আর মননের অন্যতম বিশিষ্ট প্রতিনিধি খাজিম আহমেদ।
এক অনুপম ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন জামালউদ্দিন আল্ আফগানি (জামাল-আল-দিন আল-আফগানি)। আদর্শে অবিচল এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষণে প্রায় অভ্রান্ত এই মানুষটি ইসলামি সভ্যতা আর সংস্কৃতির (তাহজিব-তমদ্দুন) ইতিহাসে ‘কলোসাস-পার্সোনালিটি’ হিসেবে স্বীকৃত। তিনি ‘প্যান-ইসলামি’ আন্দোলনের উদগাতা প্রাণপুরুষ। তাঁর জীবন ছিল রোমাঞ্চকর অভিযানের মতো। তাঁর দীর্ঘ জীবনযাত্রার নাতিদীর্ঘ আলোচনা এখানে তুলে ধরা হল: জনাব জামাল মহাজ্ঞানী-পণ্ডিত, দার্শনিক, ইসলামবেত্তা সর্বোপরি রাষ্ট্রবিদ। এমন একজন বর্ণময় মহাপুরুষের জন্য আন্তর্জাতিক মুসলমান ‘কওম’ শ্লাঘা বোধ করে থাকেন। তিনি ছিলেন ‘প্যান ইসলামি’ আন্দোলনের সার্থক যোদ্ধা। ইজিপ্টে (মিশরে) যে বৈপ্লবিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার মূলে ছিলেন আল্ আফগানি। ধর্মের প্রতি জামালউদ্দিনের সুগভীর বিশ্বাস ছিল। তবে তাঁর সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল এই যে, তিনি যুক্তি-বুদ্ধির মানুষ ছিলেন। ধর্মের নামে গোঁড়ামিকে তিনি পছন্দ করতেন না। প্রশ্রয় দিতেন না। তিনি ছিলেন রুচিবান আর সংস্কৃতিশীল। উন্নত চিন্তা, তীক্ষ্ণ বাস্তববোধ আল্-দিনের ব্যক্তি বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রখর ব্যক্তিত্ব। জামাল আল-দিন স্বয়ং তাঁর রচনায় উল্লেখ করেছেন, তিনি ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে আফগানিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। বুখারায় শিক্ষাজীবন শুরু। তাঁর উন্নত চিন্তাধারার বিকাশ বুখারাতেই হয়েছিল। ইসলামি শিক্ষা আর দর্শনের বিভিন্ন শাখায় ব্যাপক পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। মুসলিম জাহানের নানাবিধ অবস্থা, তাঁর চিন্তা-চেতনার ধারাকে বিশেষ পথে পরিচালিত করার জন্য অনুপ্রাণিত করেছিল।
আফগানিস্তান, ভারত, পারস্য, তুরাক, সুদান, ইজিপ্ট প্রভৃতি যে কোন দেশে যখনই তিনি উপস্থিত হয়েছেন, আলোড়ন তুলে দিয়েছেন সেখানকার সুধী আর শিক্ষিত মহলে। তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল বিপুল। জামালউদ্দিন আল-আফগানি ছিলেন এমন একজন মানুষ যাঁকে শ্রদ্ধা করা যায়। কিন্তু সমালোচনা করার মওকা মেলে না। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ইসলামের আবির্ভাব শান্তি এবং সাম্য প্রতিষ্ঠার পথ খুলে দিয়েছিল। এখনও তা সব সমস্যা সমাধানের দিশা দেখাতে পারে। ইজিপ্টের তৎকালীন শাসক ইসমাইল ইউরোপীয়করণের নামে নীল উপত্যকাকে ইউরোপীয় সম্প্রসারণবাদীদের আখড়া করে তুলেছিল। জনাব আফগানি এর উচ্ছেদ করতে চাইলেন। ইসলামি সংস্কারের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে জামালউদ্দিন আল আফগানি ব্যাপক শিক্ষা বিস্তারের গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি এটি উপলব্ধি করেছিলেন যে অশিক্ষিত জনসাধারণের মধ্যে তাঁর অগ্রসর চিন্তাধারার বিস্তার ঘটানো সম্ভব নয়। ‘প্যান ইসলামি’ আদর্শের প্রচার করে জামাল আফগানি বিশ্বের সমস্ত মুসলমানদের মধ্যে একটা একতাবোধ বা ভ্রাতৃত্ববোধ স্থাপন করতে আগ্রহী ছিলেন। তিনি অনুভব করেছিলেন, দুনিয়ার যে প্রান্তেই মুসলমানরা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য থাকুক না কেন, তাঁদের মধ্যে চিন্তার একটা প্রবাহ নির্দেশিত পথ ধরে চলে। আচরণ আর ধর্ম তো একই। ‘কুল্লু মুসলিমিন ইখওয়াতুন’— দুনিয়ার মুসলমান ভাই, ভাই। সংস্কৃতি শব্দটি অবশ্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ইসলামি জগতে ‘ধর্ম ও সংস্কৃতি’ (তাহজিব ও তমদ্দুন)-কে অবশ্য ধর্মেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখা হয়। এই রাষ্ট্রবেত্তার মতবাদ নিখিল বিশ্বের মুসলমানদের আমুল নাড়িয়ে দিয়েছিল। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে জামালউদ্দিন আল্-আফগানি খুব অল্প সময়ের জন্য ইজিপ্টে অবস্থান করেছিলেন। এর পরে কনস্ট্যান্টিনোপলে চলে গেলেন। ১৮৭১ পর্যন্ত রাজনৈতিক সংগঠনের জন্য কর্মব্যস্ত ছিলেন। তুর্কি সরকার জামালের জন্য ভীত ছিল। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে তুরস্ক থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হল।
তাঁর সামনে এল পরম সুযোগ। জনাব আফগানি বিশ্ববিখ্যাত আল্ আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিযুক্ত হলেন। আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন অজস্র মুসলিম মনীষীর সামবেশ ঘটেছিল। ইজিপ্টের জাতীয়তাবাদী নয়া প্রজন্ম একজন প্রখ্যাত নেতার অভাববোধ করছিল। জামালউদ্দিন দীর্ঘদিন ধরে আল্-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছিলেন। এই সুবর্ণ সুযোগ তিনি হাতছাড়া করলেন না। যুবক শ্রেণির মধ্যে অভূতপূর্ব চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করলেন তিনি। ছাত্রদের মধ্যে তাঁর আদর্শ ছড়িয়ে পড়ল। এই যুব শ্রেণির দ্বারাই এই ভাবনার প্রভাব পড়ল ইজিপ্টের সর্বত্র। জামালউদ্দিন আল্ আফগানির আদর্শ বাস্তবে রূপায়িত করা সম্ভব হলে যে কোন মুসলিম দেশ উন্নতির শিখরে পৌঁছতে পারত। তিনি চেয়েছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ চিন্তার দিক দিয়ে একটি সৌহার্দ্যের সম্পর্ক স্থাপন করতে। মানুষের মনকে কুসংস্কার থেকে মুক্ত করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন জামাল আল দিন আফগানি। তাঁর স্বপ্ন ছিল, ইজিপ্টের যুব শ্রেণিকে উন্নত চিন্তা, প্রাগ্রসর ভাবনা আর জাতীয়তাবোধের দ্বারা উদ্বুদ্ধ করতে— যাতে তাঁরা ইসলামি মুলুকের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে পারে।জামালউদ্দিন আল্-আফগানি তাঁর দুর্বার মতবাদ, সাহস, ইউরোপীয় আদিপত্যভীতি এবং প্রাচ্যের নবজাগরণের বিষয় ছাত্রদের বিদিত করেছিলেন। জনাব আফগানি হর কিসিমের স্বৈরাচারকে ঘৃণা করতেন। তিনি শুধু ইউরোপীয় আদিপত্যবাদের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ জানাতেন তাই নয়, মুসলিম শাসকবর্গের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধেও বিপ্লব-এ উৎসাহ দিয়েছিলেন। তিনি এ কথাও তাঁর বিবিধ রচনার মধ্যে বিশদভাবে বিবৃত করেছিলেন যে জনপ্রিয় সরকারই হল ইসলামের কাম্য। তিনি বলতেন, বিশ্বাস করতেন এই তত্ত্বে— ‘সরকার জনগণের ইচ্ছের ওপর চলবে। আইন হবে জনগণের জন্য।’ আল্-আফগানি এই উদারবাদী রাজনৈতিক মতবাদ তামাম ইজিপ্টে এক প্রখর জাতীয়তাবোধের বিপ্লব ঘটিয়েছিল। জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ ইজিপ্টে যুব শ্রেণি শুধুমাত্র বিদেশি অধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রেখেছিলেন তাই নয়, স্বদেশের স্বৈরাচারী ‘খেদিভ’১ শাসনের বিরুদ্ধেও সংগ্রাম চালাতে লাগলেন। সমস্ত রকমের অনাচার আর জুলুমবাজির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন।
জামালউদ্দিন আল্-আফগানি একজন ঝানু রাষ্ট্রবেত্তা। তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েননি। পর্দার অন্তরালে তিনি ইজিপ্টের রাজনৈতিক মহলে তুফান তুলে দিয়েছিলেন। জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ ‘আল্-হিজর আল্-ওয়াতানি’ নামক প্রতিষ্ঠান গড়তে জনাব আফগানি যথেষ্ট মদদ করেছিলেন। ‘আল ওয়াতানি’ নামক দলে মুসলিম সদস্যদের সংখ্যাই গরিষ্ঠ ছিল। অন্য ধর্ম-সম্প্রদায়ের লোকেরাও এই প্রতিষ্ঠানের সদস্য ছিলেন। উদার এবং অত্যন্ত প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি সকলকে একই দেশপ্রেমের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছিল। বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায় আর শ্রেণির মানুষ পরম বিশ্বাসে বসবাস করছিলেন। ইউরোপীয় কর্তৃপক্ষ জামালউদ্দিনের তুখোড় জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে উঠল। এদের চাপে পড়ে ইজিপ্টের শাসক তৌফিক ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে আল্ দিনকে দেশ থেকে বহিষ্কার করলেন। তিনি বিতাড়িত হলেও ছাত্র সমাজ তাঁর আদর্শকে কেন্দ্র করে অনাচারের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রতিবাদ করে গেছিলেন। কোনও দ্বিধা না রেখে খোলাখুলি বলা যেতে পারে জামালউদ্দিন ছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যে জাতীয়তাবোধের বিকাশ আর প্রসারের অগ্রদূত। অতীত ‘ট্র্যাডিশন’-এর সঙ্গে অত্যাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির সংমিশ্রণ জামাল আল্-দিনের রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতিকে অত্যন্ত জনপ্রিয় আর গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল। ২ ১৮৮১-১৮৮২খ্রিস্টাব্দের আন্দোলনের পশ্চাতে তাঁর চিন্তাধারাই ক্রিয়াশীল ছিল। নির্বাসনের সময় তিনি প্যারিসে অবস্থান করছিলেন।৩ প্যারিসে তাঁর সুযোগ্য ভাবশিষ্য মহম্মদ আবদু’-র সঙ্গে তিনি একটি সংস্থা গড়ে তোলেন। এই সংস্থার নামকরণ করা হয়েছিল ‘আল উরওয়াহ আল ওয়াতফা।’ এই একই নামে একটি শক্তপোক্ত পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন।৪ তামাম মুসলিম জাহানে এই পত্রিকার প্রভাব ছিল অপরিসীম। ‘While Jamal-Al-Din advocated ‘Political revolution’, Muhammad Abduh advocated religious awakening.’ ৫ জামালউদ্দিন আল্ আফগানি (জামাল-আল্-দিন আল্ আফগানি) পুরো মধ্যপ্রাচ্যে জাতীয়তাবোধের (জাতীয়তাবাদ নয়) উদ্গাতা। তাঁর মতাদর্শের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে জনগণকে ‘ওয়াকেফহাল’ করতে সমর্থ হয়েছিলেন বলেই ‘প্যান ইসলামি’ চিন্তাধারা জনপ্রিয় হয়েছিল। আল্ আফগানির মূল লড়াইটা ইউরোপীয় খ্রিস্টিয় সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে ছিল। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে নয়। জামালউদ্দিন আল্ আফগানি উনিশ শতকের ‘বিশ্ব-ইতিহাসে’ এক প্রশংসিত আর আদরণীয় নাম।৬
নোট: জামাল আল্ দিন আল্-আফগানি (১৮৩৮-৯৭), মহঃ আবদু (১৮৪৯-১৯০৫)
*১. খেদিভ (Khedive): Lord, Ruler
*২. On Modernism in Islam, Consult— H.A.R Gibb, Modern Trends in islam. (Chicago, 1945), PP 39.
*৩. George Antonius, Arab Awakening (Philadelphia, 1939), Page 372-376.
*৪, ৫. Philip K. Hitti, History of the Arabs, Macmillan & Co. Ltd London, Page 753-754
*৬. জামাল আল্ দিন সম্পর্কে পুঙ্খানুপঙ্খ জানার জন্য পড়ুন, — Charles C. Adams. Islam & Modernism in Egypt (London, 1933, Page 4 onwards).
আমাদের মূল উৎস: Philip K. Hitti, History of the Arabs এবং George E Kirk, A Short History of the Middle East, Methuen & Co. Ltd, London, Page III, 309.
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct