যন্ত্রণা
গোলাম মোস্তাফা মুনু
______________
নাদিরা সরকারি চাকরি করে। ভালো মাইনে পায়। তার বিয়েও হয়েছে সম্ভ্রান্ত পরিবারে। সামিজুদ্দিন যখনই নাদিরাকে দেখে তখনই তার মনে পড়ে যায় ফেলে আসা দিনের এক ঘটনা। তখন সামিজুদ্দিনের বয়স দশ বছর। নাদিরারও। তারা একই সাথে পড়াশোনা করত। চতুর্থ শ্রেণিতে। সামিজুদ্দিনের বাড়ির পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। নাদিরার বাড়ি বিদ্যালয় থেকে এক গ্রাম পরে। সামিজুদ্দিন পড়াশোনায় ভালো। নাদিরাও। সামিজুদ্দিনের স্কুল যেতে একটু বিলম্ব হলে নাদিরা তাকে ডাকতে চলে আসতো। তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল। সামিজুদ্দিনের বাবা বেঁচে ছিলেন না। বড় ভাই বিয়ে করে একই বাড়ির মধ্যে আলাদা ঘর সংসার করছিল। মা ছোট ছেলে সামিজুদ্দিনকে নিয়ে কষ্ট করেই সংসার চালাচ্ছিলেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাঁথা সেলাই করতেন। কখনও কখনও তাঁতিদের কাজে সহযোগিতা করেও কিছু পয়সা পেতেন। তাতে সংসারে কুলাতো না। কোন কোন দিন তাদেরকে সকালে না খেয়ে থাকতে হতো। সেদিনও সকাল থেকে প্রায় না খেয়েই ছিল সামিজুদ্দিন। মা চলে গেছেন পাশের গ্রামে কাঁথা সেলাই করতে। সামিজুদ্দিনকে বলে গেছেন - যার বাড়ি কাঁথা সেলাই করছি, অরা তো নাস্তা খ্যইতে দিবেই। তো হামি স্যবটা খাবো না। তোর গুণে লিয়্যা আসবো। ওগুলা খায়্যাই তুই স্কুল যাবি। হামার আসতে দেরি হইলে তুই আকজারা থামিস।
মায়ের কথা অনুযায়ী সামিজুদ্দিন পথ চেয়ে বসেছিল। যখন সাড়ে দশটা বেজে গেল তখন সে আর ধৈর্য ধরতে পারল না। স্কুল যাওয়ার জন্য পোশাক পরিধান করল। বই-খাতা বুকে জড়িয়ে নিয়ে যেমনই স্কুলের উদ্দেশ্যে বের হবে তেমনই তার পেটটা ক্ষুধার জ্বালায় যেন জ্বলে উঠল। বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে গিয়ে মনে মনে বলতে লাগল - মা তো খাবার লিয়্যা আইলো না। ভোকও ল্যইগাছে খুব। এখ্নি হামি কী খাবো! ভাবির ঘরে যায়্যা দেখি। অঘরে গ্যরম ভাত রান্নাও হয়্যা গেছে। এখ্নি অরা বাড়িতেও নাই। ঘরে ঢুইকা চ্যইট্টা ভাত খায়্যা লিবো। কেহু দেখতেও পাইবে না। - এ বলে সামিজুদ্দিন ভাবির ঘরের দরজার কাছে গেল। গিয়ে দেখতে পেল, দরজায় তালা দেওয়া। সামিজুদ্দিন চিন্তায় পড়ে গেল। ঘরে সে ঢুকবে কী ভাবে! হঠাৎ করেই আবার তার মাথায় এক বুদ্ধি এল। ঘরের মাঝখানের দেওয়াল টপকে ভিতরে ঢুকে যাবে। পাশাপাশি দুটি ঘর। টালির ছাউনি। মাঝখানের দেওয়াল টপকে এ ঘর থেকে ও ঘর আসা-যাওয়া করা যাবে। কিন্তু খানিক কষ্ট হবে। সামিজুদ্দিন তা-ই করল। নিজের ঘরে এসে মাঝখানের দেওয়াল টপকে ভাবির ঘরে ঢুকে গেল। থালায় ভাত নিয়ে খেতে শুরু করল। খাওয়া প্রায় সমাপ্ত এমন সময় ভাবি ঘরে প্রবেশ করল। থালা হাতে নিয়ে সামিজুদ্দিনকে ঘরের ভিতরে দেখে সে অবাক হল এবং তার সাথে সাথে গর্জে উঠল। সামিজুদ্দিনকে উচ্চস্বরে গালাগাল দিতে শুরু করল। খানিক পরেই ঘরে মা এলেন। বউমাকে বিস্ময়ের সুরে জিজ্ঞাসা করলেন - কী হয়্যাছে গে বহু? সামিজুদ্দিনকে এত্তা বকাবকি করছো কিনে? একই রকম সুরে বউমা বলল - তোমার ব্যাটাকে একেবারে চোর-ডাকাইত বানিয়্যা দিলা?
- সামিজুদ্দিন তুমাঘেরে কী লিয়্যাছে? - মা আবারও বিস্ময়ের সুরে জিজ্ঞাসা করলেন।
- তালা দেওয়া ঘরে দেওয়াল টপকিয়া ঢুইকাছে। ঢুইকা কাত্তা কী যে চোরি কইর্যাছে, এখ্নি হামি ক্যমন কইর্যা...!
সামিজুদ্দিন খুবই লজ্জিত। থালা হাতে নিয়ে নীচে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল। এক পলক ভাবির দিকে দেখে নিয়ে আবার মাথা নীচু করে নিল। সে মৃদু স্বরে ভাবিকে বোঝানোর চেষ্টা করল - ভাবি, তুমাঘেরে টাকা-প্যয়সা বা অন্যকিছু হামি চোরি করিনি। কুনুদিন করবোও না। আইজকা খুব ভোক ল্যইগাছিলো, ভোক সহ্য করতে না প্যইরা ঘরে ঢুইকা ভাত খায়্যাছি। তুমরা হয়তো বেশি বকাবকি করবা তাই গ্যরম ভাত খাইনি। গ্যরম ত্যরকারি দিয়্যা পান্তা ভাত খায়্যাছি। ভাতগুলা খাট্টা হয়্যা গেহেল্লো। তুমরা হয়তো ফেলা দিতাক। ভাবি, আর কুনুদিন তুমাঘেরে ঘরে আসবো না। এই কান ধরছি। দাদাকে আর কিছু কহিও না। ছেলের কথা শুনে মায়ের বুকটা যেন ফেটে গিয়েছিল। তিনি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেননি। চোখের জল মুছে নিয়ে, সামিজুদ্দিনের কাছে গিয়ে বলেছিলেন - এটঠে খাড়া রহ্যা আর কী করছি? চ্যল্, নিজের ঘরে চ্যল্। - এ বলে ছেলের কান ধরে সেই ঘর থেকে বের করে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। নাদিরা স্কুল যাওয়ার জন্য সামিজুদ্দিনকে ডাকতে এসে সবই দেখল এবং শুনলো। সামিজুদ্দিনের করুণ অবস্থা দেখে সেদিন নাদিরার চোখেও জল এসেছিল। তা দেখে সামিজুদ্দিন আরও লজ্জা পেয়েছিল। বন্ধুর সামনে এত বড় অপমান সে যেন সহ্য করতে পারছিল না। নাদিরার মাধ্যমে স্কুলের সবাই যদি জেনে ফেলে তাহলে সে মুখ দেখাতে পারবে না। এ ভেবে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে মাকে জানাল -মা, হামি আর কুনুদিন স্কুল য্যাইতে পারবো না। হাংকে আর বাধ্য করিও না। ছেলের কথা শুনে মা আবারও নিজের চোখের জল মুছলেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct