বিশ্বের ৫০ লক্ষের বেশি জনসংখ্যা রয়েছে এমন ১১৩ টা দেশের অপরাধ - তথ্য বিশ্লেষণ করে এই ভয়াবহ সত্য জানা গেছে যে, বিশ্বে হত্যার চাইতে আত্মহত্যার সংখ্যা অনেক বেশি। ব্যতিক্রম কেবল লাতিন আমেরিকা। ভারতে যত মানুষ ব্যক্তি হিংসার বলি হন তার চেয়ে ৫ গুণ বেশি মানুষ আত্মঘাতী হন। ভারতে সব রাজ্যেই হত্যার চেয়ে আত্মহত্যার সংখ্যা বেশি, ব্যতিক্রম শুধু বিহার। দেশ ও পৃথিবীর আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন সনাতন পাল।
সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ বেছে নিতে শুরু করেছেন আত্মহননের পথ। কিন্তু আজকে এই বিশ্বায়নের যুগে যখন ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে ল্যাপটপ, কম্পিউটার এবং স্মার্ট ফোন তখন সারা পৃথিবীতে হত্যার চেয়ে আত্মহত্যার সংখ্যা অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে সঠিক কারণ নির্ধারণ করা ভীষণই কঠিন। কার মনে কখন কি উদয় হয় তার কতটুকুই বা আমরা জানতে পারি ? কজনেরই বা মনের খোঁজ রাখতে পারি? সারা পৃথিবীতেই আনাচে-কানাচে রয়েছে কত ছোটো ছোটো কথা, ছোটো ব্যথা, যন্ত্রণার আত্ম কথা তা তো আমরা জানি না।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন. ‘চোখ কতটুকুই দেখে কান কতটুকুই শোনো স্পর্শ কতটুকুই বোধ করে। কিন্তু মন এই আপন ক্ষুদ্রতাকে কেবলই ছড়িয়ে যাচ্ছে।’ কিন্তু মন কি তার ভাবনাকে সব সময়েই প্রকাশ করতে পারে? কখনও কখনও এই অপ্রকাশিত ভাবনাই মানুষের হৃদয়ে চিতার আগুন জ্বালিয়ে তোলে, কবর খুঁড়ে। মানুষ স্বপ্নকে আধার করেই প্রতিটা শ্বাস নেয়। যখন কারো সামনে আর কোনো স্বপ্ন থাকে না তখন তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আত্মহননের পথকে বেছে নেন, তিনি আর তখন বাঁচার প্রেরণা পান না। আজকাল আত্মহত্যাকে মনো বিজ্ঞানীরা মানসিক রোগী বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। রবি ঠাকুরের বউঠান কাদম্বরী দেবী যখন আত্মহত্যা করেন, তখন তাকে বাঁচিয়ে তোলার যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়েছিল। দুজন ডাক্তারকে বাড়িতে রেখে কাদম্বরী দেবীকে বাঁচিয়ে তোলার যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন চেষ্টায় কাজে আসেনি। সব চেষ্টা বিফলে যায় এবং কাদম্বরী দেবী অকালে প্রয়াত হন। কিন্তু বর্তমান যুগে বহু ঘটনা এমন আছে, যাঁরা আত্মহননের পথ কে বেছে নিচ্ছেন তাঁদের বেশির ভাগকেই আজ আর রবীন্দ্র যুগের মত ডাক্তার দিয়ে চেষ্টা করার সুযোগ থাকছে না।
বিশ্বের ৫০ লক্ষের বেশি জনসংখ্যা রয়েছে এমন ১১৩ টা দেশের অপরাধ - তথ্য বিশ্লেষণ করে এই ভয়াবহ সত্য জানা গেছে যে, বিশ্বে হত্যার চাইতে আত্মহত্যার সংখ্যা অনেক বেশি। ব্যতিক্রম কেবল লাতিন আমেরিকা। ভারতে যত মানুষ ব্যক্তি হিংসার বলি হন তার চেয়ে ৫ গুণ বেশি মানুষ আত্মঘাতী হন। কেরলে প্রতি বছর যত মানুষকে হত্যা করা হয় তার চেয়ে ২৭ গুণ বেশি মানুষ আত্মঘাতী হন। কিন্তু বিহারে ছবিটা উল্টো, এখানে যত মানুষ আত্মহত্যা করেন তার চার গুণ মানুষকে হত্যা করা হয়। ভারতে সব রাজ্যেই হত্যার চেয়ে আত্মহত্যার সংখ্যা বেশি, ব্যতিক্রম শুধু বিহার। আবার বিশ্বেও সব দেশেই হত্যার চেয়ে আত্মহত্যার সংখ্যা অনেক বেশি তবে ব্যবধান টা সব দেশে সমান নয়। বিশ্বের মধ্যে জাপানে হত্যার সংখ্যার চেয়ে আত্মহত্যার সংখ্যাটা অনেক বেশি, হত্যার চেয়ে আত্মহত্যার সংখ্যা ৫৭ গুণ বেশি। তারপরেই রয়েছে আফ্রিকার সেনেগাল, এখানে হত্যা ও আত্মহত্যার আনুপাতিক ব্যবধান ৪৫; । এই হিসেবে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে দঃ কোরিয়া ( ৩৩; ১), সিঙ্গাপুর (৩১;১), হাঙ্গেরি (২০: ১) ।এশীয় দেশ গুলির মধ্যে তাইওয়ান,চিন এবং পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গুলির মধ্যে ক্যামেরুন, বারকিনা, ফাসো এবং ইউরোপের ফ্রান্স, স্পেন, ব্রিটেন সহ বেশ কিছু দেশে হত্যার চেয়ে আত্মহত্যার সংখ্যা উদ্বেগজনক ভাবেই বেশি। কিন্তু বর্ণ বিদ্বেষের হিংসার দীর্ঘ ইতিহাস থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হত্যার চেয়ে আত্মহত্যা সংখ্যা দুই গুণ বেশি। কিন্তু সারা পৃথিবীতে কেন এমনটা ঘটছে? দিন দিন মানুষের চাওয়ার সাথে কি পাওয়ার ব্যবধান বেড়ে যাচ্ছে ! নাকি মানুষের ধৈর্য কমে যাচ্ছে? না শিক্ষার অবমূল্যায়নের জন্য মানুষের চিন্তা এবং চেতনার স্তরকে উন্নত করা যাচ্ছে না? তবে এখন আবার মোবাইলের গেমকে কেন্দ্র করেও বাবা মায়ের বকুনিতে কিছু শিশু কিশোরের প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে। আত্মহত্যার কারণ যেটাই হোক না কেন! চিকিৎসা বিজ্ঞান যেহেতু মেনে নিয়েছে যে আত্মহত্যা করার প্রবণতা একটা মানসিক রোগ সুতরাং মানসিক চিকিৎসার বিষয়ে সারা পৃথিবীতে আরও যত্নবান হওয়া দরকার। শুধু চিকিৎসা বিজ্ঞানের কথাকে কাছে লাগিয়ে আত্মহত্যাগুলোকে বীমার আওতায় নিয়ে এসেই সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কারণ বীমার টাকা দিয়ে কখনই কারো জীবনের মূল্য নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তাই আত্মহত্যার পরে বীমার টাকা যেন পায় শুধু সেটা না দেখে আত্মহত্যাটাকেই কি ভাবে বন্ধ করা যায় সেটা দেখা দরকার।
(শিক্ষক এবং বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct