বাংলার নবজাগরণ বলতে বোঝায় ব্রিটিশ রাজত্বের সময় অবিভক্ত ভারতের বাংলা অঞ্চলে ঊনবিংশ ও বিংশ শতকে সমাজ সংস্কার আন্দোলনের জোয়ার ও বহু কৃতি মনীষীর আবির্ভাবকে। মূলত রাজা রামমোহন রায়ের (১৭৭২-১৮৩৩) সময় এই নবজাগরণের শুরু এবং এর শেষ ধরা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) সময়ে। যদিও এর পরেও বহু জ্ঞানীগুণী মানুষ এই সৃজনশীলতা ও শিক্ষাদীক্ষার জোয়ারের বিভিন্ন ধারার ধারক ও বাহক হিসাবে পরিচিত হয়েছেন। ঊনবিংশ শতকের বাংলা ছিল সমাজ সংস্কার, ধর্মীয় দর্শনচিন্তা, সাহিত্য, সাংবাদিকতা, দেশপ্রেম ও বিজ্ঞানের পথিকৃৎদের এক অনন্য সমাহার যা মধ্যযুগের অন্ত ঘটিয়ে এদেশে আধুনিক যুগের সূচনা করে। তা িনয়ে সন্দর্ভটি লিখেছেন দিলীপ মজুমদার...
দ্রঃ গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ ( সাহিত্য সাধক চরিতমালা )/ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাঙ্গালা সাময়িক সাহিত্য/কেদারনাথ মজুমদার। আত্মচরিত/রাজনারায়ণ বসু।
১৯. মধুসূদন গুপ্ত ( ১৮০০-১৮৫৬)- মেডিকেল কলেজের ছাত্র। সংস্কারকে উপেক্ষা করে ১৮৩৬ সালে শব-ব্যবচ্ছেদ করে সাহসিকতার পরিচয় দেন। তাঁকে সাহায্য করেছিলেন রাজকৃষ্ণ দে, উমাচরণ শেঠ, দ্বারকানাথ গুপ্ত ও নবীনচন্দ্র মিত্র। মেডিকেল কলেজের শিক্ষক হন, পরে হিন্দুস্তানি ক্লাশের সুপারিনটেনডেন্ট ও প্রথম শ্রেণির সাব-অ্যাসিসটেন্ট সার্জেন পদ লাভ করেন।
দ্রঃ কলিকাতার ইতিবৃত্ত/প্রাণকৃষ্ণ দত্ত। মেডিকেল কলেজের ইতিহাস/ড. জয়ন্ত ভট্টাচার্য। কলকাতা মেডিকেল কলেজের গোড়ার কথা ও পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত/ডাঃ শঙ্করকুমার নাথ।
২০. রমানাথ ঠাকুর (১৮০১- ১৮৭৭)
দ্বারকানাথের কনিষ্ঠভ্রাতা রমানাথ জেনারেল ও ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের কোষাধ্যক্ষ হন। সংস্কারমুক্ত রমানাথ সতীদাহপ্রথা বন্ধ করার জন্য জোড়াসাঁকো ব্রাহ্ম সমাজের প্রার্থনা সভায় সরকারকে ধন্যবাদ জানান। ১৮৩১ সালে প্রকাশ করেন ‘দ্য রিফর্মার’ পত্রিকা, যা তখনকার প্রগতিপন্থীদের সাহায্য করেছিল। হিন্দু কলেজ ও জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইন্সট্রাকশনের পরিচালনা সমিতির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। হিন্দু বেনাভোলেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ও হিন্দু চ্যারিটেবল ইন্সটিটুশন তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিল। ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন গঠনের বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন; এই সংগঠনের প্রথমে সহ-সভাপতি ও পরে সভাপতি হন। ১৮৬৪ সালে সরকার সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার নিয়ম পরিবর্তন করায় রমানাথ ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে তার প্রতিবাদ করেন এবং পরীক্ষার্থীর সর্বোচ্চ বয়স ২৫ করার দাবি জানান। তিনি ছিলেন রায়তের বন্ধু।
দ্রঃ ঠাকুরবাড়ির কথা/হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতবর্ষীয় সভা/যোগেশচন্দ্র বাগল। Freedom Movement in Bengal/Nrimal Sinha (edt.) . The Modern History of Indian Chiefs, Rajas, Zaminders/Loknath Ghosh
২১. প্রসন্নকুমার ঠাকুর ( ১৮০১- ১৮৬৮) – দেওয়ান হিসেবে এবং আইন ব্যবসায়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন প্রসন্নকুমার ঠাকুর। কিন্তু সে অর্থ তিনি নিছক আত্মস্বার্থে ব্যবহার করেন নি। অজ্ঞতা ও কুসংস্কার থেকে দেশবাসীর মুক্তির প্রশ্ন তাঁকে তাড়িত করেছিল। সতীদাহ বিরোধী আন্দোলনে তিনি রামমোহনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি অনুভব করেছিলেন কুসংস্কার থেকে দেশবাসীর মুক্তি ঘটতে পারে আধুনিক শিক্ষার বিস্তারে। স্কুল সোসাইটির সদস্য হিসেবে সে চেষ্টা করেন তিনি। হিন্দু ফ্রি স্কুলসহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সাহায্য দান করেন। হিন্দু কলেজে ইংরেজি শিক্ষা ও বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যাপারেও তাঁর উৎসাহ ছিল। প্রসন্নকুমার স্ত্রীশিক্ষারও অনুরাগী ছিলেন। নিজের কন্যা ও পুত্রবধূর শিক্ষার আয়োজন করেন তিনি। দেশের যুবকরা যাতে আইন শিক্ষার প্রতি অনুরাগী হন, তার চেষ্টা করেন। কিন্তু শিক্ষার নামে মিশনরি সম্প্রদায়ের ধর্মান্তরকরণের দুরভিসন্ধির প্রতিবাদ করেছেন। ‘গৌড়ীয় সমাজে’র সদস্য হিসেবে ধর্মান্তরকরণের বিরুদ্ধতা করেছেন। কিন্তু তাঁর দুর্ভাগ্য যে তাঁর পুত্র জ্ঞানেন্দ্রমোহন খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন ও কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জীর কন্যাকে বিবাহ করেন। ‘গৌড়ীয় সমাজে’র মাধ্যমে তিনি মাতৃভাষা চর্চার উপরে জোর দেন ও বঙ্গ সাহিত্যের সমৃদ্ধির চেষ্টা করেন। ১৮৩১ সালে তিনি আদালতে পারসি ভাষার পরিবর্তে বাংলা প্রচলনের প্রস্তাব দেন। হিন্দু কলেজ পাঠশালা প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেন তিনি। মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতার সমর্থক ছিলেন প্রসন্নকুমার। ‘রিফর্মারে’ এ বিষয়ে তাঁর প্রবন্ধগুলি উল্লেখযোগ্য। এই পত্রিকার সাহায্যে তিনি জনগণের রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধির চেষ্টা করেছেন। তবে তিনি বিদ্রোহী নন, ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদও চান নি, শুধু সরকারের ত্রুটিগুলি তুলে ধরে সরকারকে সচেতন করতে চেয়েছিলেন। ল্যাণ্ডহোলর্ডাস সোসাইটির সদস্য প্রসন্নকুমার ১৮৩৯ সালে টাউন হলে নিষ্কর জমির ব্যাপারে সরকারি সিদ্ধন্তের প্রতিবাদ করে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা উল্লেখযোগ্য। ১৮৫১ সালে ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ও ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হিসেবে তিনি দেশবাসীর স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টা করেন।
দ্রঃ প্রসন্নকুমার ঠাকুর ( বিশ্বভারতী পত্রিকা, মাঘ-চৈত্র, ১৩৫৫)/যোগেশচন্দ্র বাগল। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা/যোগেশচন্দ্র বাগল। Bengal under the Lieutenant Governors ( vol. 11, 1902)/C.E. Buckland
২২. জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন ( ১৮০১-১৮৫১ )—এ দেশের স্ত্রীশিক্ষার বিস্তারে যাঁর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তিনি গ্রিক, ল্যাটিন, জর্মান, ফরাসি ও ইতালীয় ভাষায় সুপণ্ডিত জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন। তাঁর উদ্যোগে এবং দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রভৃতির সাহায্যে ১৮৪৯ সালের ৭ মে নেটিভ ফিমেল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এই স্কুল বেথুন স্কুল নামে পরিচিত। তিনি তাঁর যাবতীয় অস্থাবর সম্পত্তি দান করে যান স্কুলের নামে। কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরি ও বঙ্গভাষানুবাদক সমাজের সঙ্গেো তাঁর নিবিড় যোগ ছিল।
দ্রঃ ভারতকোষ। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান।
২৩. আশুতোষ দেব ( ১৮০৩- ১৮৫৬) – বাংলা, উর্দু এবং ব্রজভাষায় দক্ষ আশুতোষ দেব ১৮৩০ থেকে ‘ধর্মসভা’র সদস্য। কিন্তু গোঁড়া নন। নিজের কন্যাকে উপযুক্ত শিক্ষাদান করেছিলেন। বেথুনের হিন্দু ফিমেল স্কুলের ব্যাপারে উৎসাহ ছিল। স্ত্রীশিক্ষার ক্ষেত্রে আলেকজাণ্ডার ডাফের প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানান। খ্রিস্টান মিশনরিদের শিক্ষাবিস্তার সমর্থন করলেও তাঁদের ধর্মান্তরকরণের চেষ্টা পছন্দ করেন নি। তাই হিন্দু চ্যারিটেবল ইন্সটিটুশন গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। স্ট্যাম্প ডিউটি ও লাখেরাজ সম্পত্তির ব্যাপারে সরকারি নীতির প্রতিবাদ করেন ল্যাণ্ডহোলডার্স সোসাইটির সদস্য আশুতোষ দেব। তিনি প্রথম ভারতীয় যিনি ১৮৩৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের গ্র্যাণ্ড জুরিতে অন্তর্ভুক্ত হন।
দ্রঃ পুরাতন প্রসঙ্গ/বিপিনবিহারী গুপ্ত। Freedom Movement of Bengal/Nrimal Sinha (edt)
২৪. পঞ্চানন কর্মকার (১৮০৩/৪--?) – চার্লস উইলকিনসের কাছে পঞ্চানন নাগরি ও ফারসি অক্ষর খোদাই শিখে তার উন্নতিবিধান করেন। ১৮০৩ সালে উইলিয়ম কেরি তাঁকে নাগরি অক্ষরের একটি সাঁট রচনায় নিযুক্ত করেন। পঞ্চানন এই কাজে নিযুক্ত থাকার সময়ে বাংলা অক্ষরেরও একটি সাঁট নির্মাণ করেন। পঞ্চানন ও তাঁর জামাতা উভয়ে মিলে ১৮ বছরে ১৪টি বিভিন্ন বর্ণমালার টাইপ তৈরি করেন। বহু দিন তাঁর হরফ প্রচলিত ছিল।
দ্রঃ সংবাদপত্রে সেকালের কথা/ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। পঞ্চাননের হরফ/রজত চক্রবর্তী। গ্রন্থচিন্তন : মুদ্রণ ও প্রকাশনা/খান মাহবুব ( সম্পাদিত )। বাংলা ছাপাখানার ইতিবৃত্ত/উদয়শংকর বিশ্বাস
২৫. তারাচাঁদ চক্রবর্তী ( ১৮০৪- ১৮৫৫) - হিন্দু কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র, রামমোহনের অনুরাগী তারাচাঁদ চক্রবর্তীকে জীবিকার্জনের জন্য নানা কাজ করতে হয়েছিল, যার ফলে দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্খার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন তিনি। প্রখর আত্মমর্যাদা ছিল তাঁর। তাই জাতিগর্বে আচ্ছন্ন ইউরোপীয় সিবিল সার্ভেন্টদের কোন অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেন নি তিনি। দেশের মানুষের রাজনৈতিক চেতনাবৃদ্ধির চেষ্টা করেছেন। ১৮৩৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি যে ‘সোসাইটি ফর দ্য অ্যাকুইজিশন অব জেনারেল নলেজ’ গঠিত হয় তিনি ছিলেন তার স্ভাপতি। মাসে একবার হিন্দু কলেজে সেই সোসাইটির বৈঠক বসত। জর্জ টম্পশনের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে সোসাইটির সদস্যরা ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা করতেন। এমনি এক আলোচনায় কলেজের অধ্যক্ষ ডি. এল. রিচার্ডসন ক্ষিপ্ত হয়ে ঘোষণা করেন যে তিনি হিন্দু কলেজকে ‘den of treason’ হতে দেবেন না। তারাচাঁদ তাঁকে এই মন্তব্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেন। টাউন হলের সভায় ১৮৩৩ সালের চার্টার অ্যাক্টের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন তিনি। ১৮৪৩ সালের ১৮ এপ্রিল যে বেঙ্গল ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া সোসাইটি গঠিত হয়, তাতেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কোম্পানির বড় বড় পদে ভারতীয়দের নিয়োগের ব্যাপারে ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর’ এ প্রবন্ধ লেখেন তারাচাঁদ। শিক্ষাক্ষেত্রে অধিক ব্যয়ের দাবি তোলেন তিনি। ১৮৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ক্যালকাটা মেকানিকস ইন্সটিটিউটের মাধ্যমে প্রযুক্তিগত শিক্ষার বিস্তারের কথা বলেন তিনি। খ্রিস্টান মিশনরিরা অবৈতনিক স্কুলের মাধ্যমে ধর্মান্তরকরণ প্রচেষ্টা চালাতেন। তাই তারাচাঁদ তাঁর সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে ১৮৪৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন হিন্দু চ্যারিটেবল ইন্সটিটুশন।
দ্রঃ রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ/শিবনাথ শাস্ত্রী। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা/যোগেশচন্দ্র বাগল। A Biographical Sketch of David Hare/Peary Chand Mitra . History of Political Thought/B. B . Majumdar . Speeches by Mr. George Thompson, Father of Political Education/Raj. Jogeshur Mitter.
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct