সারওয়ার হাসান, আপনজন: লুনা রুশদি ফ্যাসিবাদের যে লক্ষণগুলি শনাক্ত করেছিলেন। ২০০৩ সালে ‘ফ্রি এনকোয়ারি’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল তাঁর লেখা। যা বর্তমান ভারতের সঙ্গে ব্যাপক মিল দেখা যায়। লক্ষণ গুলি নিম্নরূপ:
১. পরাক্রমী জাতীয়তাবাদ – ফ্যাসিবাদী শাসনকালে মেকি দেশভক্তিমূলক আদর্শ, শ্লোগান, গান, প্রতীক এবং অন্যান্য সাজসজ্জা ইত্যাদি ব্যবহার বেড়ে যাওয়া।
২.শত্রু/বলির পাঁঠা শনাক্ত করা – ফ্যাসিবাদ এক বলির পাঁঠা বা ছায়াশত্রু খুঁজে নেয়। (এক্ষেত্রে ভারতের ফ্যাসিবাদের বলির পাঁঠা মুসলিম-দলিত-আদিবাসী। অবশ্য প্রধানতম বলির পাঁঠা এক্ষেত্রে মুসলিমরাই। এন-আর-সি নামক প্রক্রিয়া সেই ছায়াশত্রুকে মার দিতে চাইছে। যদিও অসমে এর ফলে মুসলিমদের চেয়ে হিন্দুরাই নাগরিকত্ব হারালেন বেশি এবং প্রমাণিত হল যে মুসলিমদের বহুল সংখ্যায় অবৈধ নাগরিকত্ব একটি মিথ্যা প্রচার মাত্র। )
৩.সামরিক আধিপত্য – দেশের অভ্যন্তরীণ দুর্যোগ ও সমস্যা অবহেলা করেও সামরিক বাহিনীকে গুরুত্ব দেওয়া। (জনসাধারণকে বৈদেশিক শত্রুর ভয় দেখিয়ে উত্তেজিত রাখা হয়। চিন, পাকিস্তান..কে জব্দ করার মিথ)
৪. নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম –(ভারতের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো নিজেদের প্রাইমটাইমের বড় অংশ ক্ষমতাসীন দলের প্রচার-প্রোপাগান্ডায় ব্যয় করে,)
৫. ধর্ম ও রাষ্ট্র অঙ্গাঙ্গী জড়িত থাকা(হিন্দুরাষ্ট্রের পরিকল্পনা)।
৬.শ্রমিক-কৃষকদের ক্ষমতা রোধ – (যেহেতু খেটে খাওয়া মানুষের সাংগঠনিক শক্তি ফ্যাসিবাদী সরকারের জন্য হুমকি স্বরূপ, তাই এখানেও এসে গেছে কৃষি আইন-শ্রমকোড ইত্যাদি)।
৭.অবাধ স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি–( আদনি আম্বানি প্রীতি এবং ইলেক্ট্রোল বন্ড,পিএম কেয়ার এর অন্যতম উদাহরণ)
৮. নির্বাচনে কারচুপি – (ফ্যাসিবাদী দেশে নির্বাচন মানেই ধোঁকাবাজি)।
১৯৯২ সাল পরবর্তী সময়ে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মাধ্যমে ভারতে আরএসএস-ও বিজেপির নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলনের এক নতুন পর্ব শুরু হয়। উগ্র জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, ধর্মীয় মৌলবাদ ইত্যাদিকে কাজে লাগিয়ে নব্য ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়েছে। আমরা যদি বিজেপির শেষ পাঁচ বছরের কার্যসূচী দেখি, তাহলে দেখব রামমন্দির, ঘরওয়াপসি, লাভজিহাদ, গৌ-রক্ষা...আরএসএস-এর যাবতীয় স্বপ্নকেই তা একে একে বাস্তবায়িত করেছে এবং নব্য ফ্যাসিবাদের প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু এই জয়যাত্রার পিছনে যে ইতিহাস, তা মোটেই মাত্র দশ বছর পুরোনো নয়। ১৯২৫ সাল থেকে সঙ্ঘপরিবারের উত্থান শুরু। পশ্চিমবঙ্গের কথাও যদি বলা হয়, তবে সেই সময় থেকেই এখানে ছিল তাদের কার্যকলাপ। এই দীর্ঘ অধ্যাবসায়ের ফসল তারা এখন ঘরে তুলছে।
ভারতের মতো দেশ, যার নাগরিক সমাজ সুগঠিত, যেখানে দীর্ঘ গণতন্ত্রের ধারা আছে, যেখানে শুধুমাত্র শাসন দিয়ে ফ্যাসিবাদী শক্তি কায়েম করা মুশকিল। তাই সুসংহত ভাবে আঘাত করা হচ্ছে সংস্কৃতিকে। মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক ও সংস্কৃতি মন্ত্রককে কাজে লাগানো হচ্ছে হিন্দুরাষ্ট্রের পক্ষে অনুকূল সংস্কৃতি গড়ে তুলতে। শুধু তাই নয়, অতিহিন্দু শক্তি নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে সৈন্যপ্রধানদের সঙ্গে। এমনকি জানা যায়, অবসরপ্রাপ্ত সেনাপ্রধানদের উপরেও তাদের যথেষ্ট প্রভাব। অন্যদিকে বিচারব্যবস্থার মাথাদেরও তারা প্রভাবিত করছে। বিদ্বজ্জন ও বুদ্ধিজীবীদের, সাংবাদিক ও শিক্ষকদের পোষ মানাতে না পারলে, তারা তাদের আটক করছে নির্বিচারে। সংবাদমাধ্যমও তাদের বশংবদ। শিক্ষাব্যবস্থা, পাঠ্যক্রম সবই বদলে যাচ্ছে। এসবের অন্তিম লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট৷ আস্তে আস্তে নানা আইনে পরিবর্তন আনা। শেষপর্যন্ত সংবিধানকেও পরিবর্তিত করে তাকে হিন্দুরাষ্ট্রের অনুকূল করে তোলা। বৈচিত্র্য ভুলে সারা দেশে সংঘের একচ্ছত্র শাসন প্রতিষ্ঠা করা। তারা যখন ‘এক দেশ এক ভোট’-এর কথা বলছে, তখন তারা আসলে আঘাত করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয়, যেখানে রাজ্যগুলির কিছু নিজস্ব ক্ষমতা আছে। রাজ্যগুলির বিধানসভা দখল করতে পারলে, কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় জায়গাতেই একই শাসন চলবে। এহেন ধ্বংসাত্বক ফ্যাসিবাদী শক্তি কে রুখে দেওয়ার মোক্ষম সুযোগ হলো আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ও N.D.A কে পরাস্ত করা। এতে পশ্চিমবঙ্গের ভূমিকা খুবি গুরুত্বপূর্ন। গোটা দেশ তাকিয়ে আছে বাংলার রাজনীতির দিকে। তৃণমূল যদি চাইতো তাহলে I.N.D.I.A জোটের মাধ্যমে বিজেপি কে বাংলায় শুন্য করেদিতে পারতো, কিন্তু তৃণমূল শুধু নিজস্ব প্রয়োজনে বিজেপি ‘বিরোধিতা’ করতে গিয়ে গোটা দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। মুসলমানদের অনেকে তৃণমূল দল ও তার প্রার্থীদের উপরে ভরসা করতে পারছেনা কারন বিজেপির বিরুদ্ধে যে প্রার্থী আছে সে জয়লাভের পর বিজেপিতে চলে যাবেনা তার কোনো নিশ্চয়তা নাই। আবার সুযোগ বুঝে এই তৃণমূল দলটাই N.D.A তে চলে যাবেনা তার ও কোনো গ্যারান্টি নাই। কারন এই দল পূর্বেও বিজেপির সাথে বহাল তরবিয়তে সংসার করেছে, সরকারেও থেকেছে। এই সংকটময় পরিস্থিতিতে পুরোপুরি তৃণমূলের উপরে ভরসা করে যারা পুরো মুসলিম ভোট তৃণমূলের দিকে ঢেলে দিতে মরিয়া তারা পুরো জাতিকে আত্বহননের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রত্যেক রাজ্যবাসীর দায়িত্ব হলো বিজেপিকে বাংলায় রুখে দেওয়া , যেহেতু এই বাংলায় বিরাট অংশের মুসলিমদের বাস সেহেতু মুসলিমদের একটা বিশেষ অবদান রাখতে হবে। খুবই সচেতনতার সাথে ভোট প্রয়োগ করলে বিজেপিকে বাংলায় রুখে দেওয়া সম্ভব।
আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে ভোট প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে বিষয় গুলি মাথায় রাখা দরকার -
১) ফ্যাসিবাদকে প্রকৃত অর্থে একমাত্র ওয়েলফেয়ার পার্টিই আগামীতে পরাস্ত করতে পারবে তাই পশ্চিমবঙ্গের তিনটি লোকসভা কেন্দ্রে এই দলের প্রার্থী রয়েছে। মুর্শিদাবাদ, জঙ্গিপুর ও উত্তর মালদা। উক্ত লোকসভায় সমস্ত শক্তি দিয়ে এই দলের প্রার্থীকে জয় লাভ করানো ওই কেন্দ্রের প্রত্যেক ভোটারের দায়িত্ব। এই দল এতটাই ছোট যে তাদের কর্মীরা প্রত্যেক ভোটারের কাছে পৌঁছাতে পারবেনা। তাদের সেই অর্থবলও নাই কিন্তু তাদের কাছে আছে মূল্যবোধের আদর্শ যা অন্য কোনো দলের নাই।
২) বিজেপির বিরুদ্ধে শক্তিশালী মুসলিম প্রার্থী, সে যে দলেরই হোকনা কেনো তাকে জিতিয়ে নিয়ে আসা।
৩) বিজেপির বিরুদ্ধে শক্তিশালী কংগ্রেস ,বাম ও গণতন্ত্র প্রেমী অসাম্প্রদায়িক দলের প্রার্থীদের জিতানো। মনে রাখতে হবে দেশ ও রাজ্যে গণতন্ত্র রক্ষা করতে এই দল গুলোর ও প্রয়োজন রয়েছে।
৪) তৃণমূলের সেই সমস্ত প্রার্থী যারা ধর্মনিরপেক্ষ এবং জয় লাভের পর বিজেপিতে পালিয়ে যাবেনা বলে মনে করেন তাদের জিতিয়ে নিয়ে আসা ।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct