নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের আট বছর পূরণ করেছেন এবং ভারত যখন তার স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী উদ্যাপনের নিবেদিত প্রাণ, তখন মোদির শক্তিশালী নির্বাচনী প্রভাব তাঁকে প্রায়-অজেয় নেতা হিসেবে তুলে ধরেছে। কিন্তু তুমুল জনপ্রিয় এই নেতার ব্যক্তিকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের নীতিকৌশল অতিশয় আবেগনির্ভর ও মূর্খতাপূর্ণ, যা ভারতের শাসনব্যবস্থার জন্য বিপর্যয়কর পরিণতি ডেকে আনছে। বর্তমান ভারতের ভবিষ্যৎ পরিণতি বিশ্লেষণ করেছেন শশী থারুর। আজ শেষ কিস্তি।
দি যদি তাঁর টেবিলে নিয়মিত বসতেন, তাহলে তিনি মন্ত্রিপরিষদের সবাইকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি সামাল দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তাঁর সময়ের একটি বড় অংশ সফরে ব্যয় করেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি এ পর্যন্ত ৬০টির বেশি দেশ সফর করেছেন। এ ছাড়া তিনি ভারতের অগণিত স্থানে প্রায় সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ও দলীয় প্রচারের মেজাজে সফর করে বেড়াচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে, মোদি আইনসভার প্রতি যে অবমাননা প্রদর্শন করেন, তার ওপর খুবই পাতলা আবরণ থাকে; গুজরাটে যেমনটা তিনি দেখিয়েছেন। সেখানে তিনি তাঁর আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ততক্ষণই মূল্যায়ন করেছিলেন, যতক্ষণ সেই আইনসভা তাঁকে তাঁর নির্বাহী ক্ষমতাকে সক্ষম করেছিল এবং বৈধতা দিয়েছিল। অন্যথায়, বাজেট পাস করা এবং আইন অনুমোদন করার মতো অনিবার্য কাজ ছাড়া আইনসভার প্রয়োজন তিনি বোধই করেন না। মহামারির কারণে পার্লামেন্টের পুরো অধিবেশনগুলোকে ছেঁটে ফেলার আগেও মোদির অধীন পার্লামেন্টের অধিবেশনের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পেয়েছিল। যখন লোকসভার অধিবেশন বসে, তখন সংসদীয় কমিটির যাচাই–বাছাই বা পার্লামেন্টে বিতর্ক ছাড়াই প্রায় সব বিলই কয়েক মিনিটে পাস হয় যায়। মোদি রেলপথের মতো সমান্তরাল ও একমুখী করে যে পার্লামেন্ট গড়ে তুলেছেন, তা একটি সত্যিকারের রাষ্ট্রপতিব্যবস্থার চিত্র উন্মোচন করে।
পার্লামেন্টই একমাত্র প্রতিষ্ঠান নয়, যাকে মোদির সরকার খাটো করেছে। ২০১৪ সালে ক্ষমতা নেওয়ার সময় মোদি ‘ন্যূনতম সরকার, সর্বোচ্চ শাসন’–এর (মিনিমাম গভর্নমেন্ট, ম্যাক্সিমাম গভর্ন্যান্স) প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি উল্টোটা দিয়েছেন। যেমন সরকারি নিয়ন্ত্রণকে তিনি এমন স্তরে নিয়ে গেছেন যে তাঁর সরকারকে অনেকেই কর্তৃত্ববাদী বলে মনে করে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রীকরণকে এমন একটি মাত্রায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যা মন্ত্রণালয়গুলোকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে ফেলা হয়েছে এবং একটি প্রশাসনিক স্টাইল দাঁড় করানো হয়েছে, যা মোদির নিজের বাহ্যিক ব্যক্তিত্বকে প্রতিফলিত করে। অনেকে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক, নির্বাচন কমিশন, কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো এবং বিচার বিভাগের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করার এবং বাক্ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণের মাধ্যমে মিডিয়াকে দুর্বল করার চেষ্টা করার অভিযোগ করেছেন। মোদির বিপর্যয়কর নোট বাতিলের কারণে ২ শতাংশের বেশি পয়েন্ট জিডিপি বৃদ্ধির হার থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেছে। তিনি বেকারত্বের সর্বোচ্চ স্তর আমাদের উপহার দিয়েছেন। সর্বশেষ তিনি ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। ভারত যখন ৭৬ বছর বয়সে পড়ছে এবং মোদি যখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর নবম বছর শুরু করছেন, তখন তিনি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে রয়েছেন। তাঁর সেবায় নির্বাচনী যন্ত্র শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে, বিরোধীরা বিভক্ত অবস্থায় আছে এবং তাঁর উৎসাহী অনুগামীরা মিছিল করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনে তার সাফল্য প্রশ্নাতীত। কিন্তু ভারতীয়দের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠের সুবিধার জন্য সেই জনপ্রিয়তাকে তাঁর ব্যবহার করার ক্ষমতা খুব সন্দেহের মধ্যেই রয়ে গেছে। (সমাপ্ত...)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct