মেঘনাদবধ অনন্য কবি কল্পনা
এস ডি সুব্রত
___________________________
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও নাট্যকার এবং প্রহসন রচয়িতা। তিনি বাঙরা নবজাগরণ সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি । ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু কায়স্থ পরিবারে মধুসূদনের জন্ম। তাঁর পিতা রাজনারায়ণ দত্ত এবং জাহ্নবী দেবী।পিতা রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতার সদর দেওয়ানি আদালতের খ্যাতনামা উকিল। মধুসুদনের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় তার মা জাহ্নাবী দেবীর কাছে। জাহ্নবী দেবী তাকে রামায়ন, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতির সঙ্গে সুপরিচিত করে তোলেন। সাগরদাঁড়ির পাশের গ্রামের শেখপুরা মসজিদের ইমাম মুফতি লুৎফুল হকের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। বিদ্বান ইমামের নিকট তিনি বাংলা, ফারসি, আরবী পড়েছেন। তের বছর বয়সে মধুসুদন কলকাতাায় যান। স্থানীয় একটি স্কুলে কিছুদিন পড়া সোনা করেন। পরে তিনি তদনীন্দন হিন্দু কলেজে বর্তমান প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। বাংলা সাহিত্যে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের আবির্ভাব ঘটেছিল মূলত নাটক রচনার মাধ্যমে । বাংলা নাটকের চরম দুরবস্থা প্রত্যক্ষ করে মধুসূদন নাটক রচনায় মনোনিবেশ করেন । সাহিত্য সাধনার পরবর্তী পর্যায়ে এসে তাঁর অনন্য সাধারণ বৈচিত্র্যমুখী প্রতিভা বিকশিত হতে থাকে আপন মহিমায়। বাংলা সাহিত্যে মহাকাব্যের ধারার সূত্রপাত ঘটে মূলত “মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাত ধরে ।
উঠিলা রাক্ষসপতি প্রাসাদ-শিখরে,
কনক-উদয়াচলে দিনমণি যেন
অংশুমালী। চারিদিকে শোভিল কাঞ্চন-
সৌধ-কিরীটিনী লঙ্কা... “ (মেঘনাদবধ কাব্য)
সংস্কৃতে রচিত মহাকাব্য রামায়ণের আংশিক কাহিনি অবলম্বন করে মধুসূদন দত্ত ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে ‘মেঘনাদবধ ‘কাব্য রচনা করেন যা বাংলা সাহিত্যের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য হিসেবে খ্যাত । মেঘনাদবধ কাব্যের বিশাল বিস্তৃত পটভূমির মধ্যে নানা ধরনের চরিত্র এবং নানা রসের সমাবেশ ঘটেছে । লেখক কাব্যের প্রথম দিকে বীররসের কথা বললেও এই কাব্যে করুণরসই প্রধান হয়ে উঠেছে ৷ ১৮৫৭ সালে সংঘটিত সিপাহি বিপ্লবের স্বাধীনতামন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে রাবণকে নায়ক ও রামকে খলনায়ক করে মধুসূদন রচনা করে এই স্বাধীনতাভিলাষী মহাকাব্য। মেঘনাদবধ মহাকাব্যটির নয়টি সর্গ । প্রথম সর্গ - অভিষেক,দ্বিতীয় সর্গ - অস্ত্রলাভ, তৃতীয় সর্গ - সমাগম , চতুর্থ সর্গ - অশােক বন, পঞ্চম সর্গ - উদ্যোগ , ষষ্ঠ সর্গ - বধ , সপ্তম সর্গ - শক্তিনির্ভেদ ,অষ্টম সর্গ- প্রেতপুরী, এবং নবম সর্গ - সংস্ক্রিয়া । নয় সর্গে সম্পূর্ণ ‘মেঘনাদবধ কাব্যে বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদ থেকে মেঘনাদ হত্যা, প্রমীলার চিতারােহণ পর্যন্ত মােট তিন দিন দুই রাতের ঘটনা বর্ণিত। একটু গভীরে ঢুকে লক্ষ করলে দেখা যাবে কবি মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ মহাকাব্যে শয়তান যেমন দুর্জয় বাসনা ও ঋজুতা প্রদর্শন করে, মাইকেল মধুসূদন দত্তও লংকাধিপতি রাবণকে দিয়ে সে কাজ করিয়েছেন। এখানে দেখা যায় যে , ভাব-ভাষা ও শব্দ ব্যবহারে কবি বিদেশি ক্লাসিক রীতি আয়ত্ত করে তা বাংলায় ব্যবহার করেছেন নান্দনিক ভাবে। কাব্যের বিভিন্ন সর্গে বীরত্ব, অভিমান, আক্ষেপ ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে সুন্দর ভাবে। কয়েকটি প্রধান চরিত্র : রাম, মেঘনাদ, রাবণ, সীতা, লক্ষ্মণ, সরমা, বিভীষণ, প্রমীলা ইত্যাদি মেঘনাদবধ কাব্যে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন মাইকেল । মেঘনাদবধ কাব্যের ট্র্যাজেডি সৃজন হয়েছে নায়ক রাবণের চরিত্রকে অবলম্বন করে। মহাকাব্যের ভাব ভাষা হবে ঐশ্বর্যবান এবং রাজসিক গুণবিশিষ্ট। মহাকাব্যের থাকবে বিশালতা ও ঔদার্য। অমৃততুল্য পরমরস সম্পন্ন মন্ত্রমুগ্ধ ছন্দে যে কাব্যের মধ্যে আনন্দ ও বিশালতার রসােত্তীর্ণ ঐক্য আর স্থাপত্যশৈলীর চরমােকর্ষ প্রােথিত, তাই মহাকাব্য। মেঘনাদবধ কাব্যের মাঝে এ সব স্থাপত্য শৈলীর রুপায়ন ঘটেছে নিখুঁতভাবে ।
একটি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অভীপ্সার ইতিহাস হচ্ছে মহাকাব্য। একটি যুগ বিধৃত করে তার পরিপূর্ণ উদঘাটন ঘটে মহাকাব্যে। কাহিনিবিন্যাস ও চরিত্রসৃষ্টির দিক থেকে দেখা যায়, মাইকেল রামায়ণ কাহিনির মহৎ ও স্নিগ্ধ কবিত্বের ওপর হােমারের ইলিয়াড’ কাহিনির অত্যন্ত সাবলীল ও চমৎকার রুপায়ন ঘটিয়েছেন । মাইকেল মধুসূদন দত্তের অনন্যসুন্দর কবিকল্পনার ফসল মেঘনাদবধ মহাকাব্য । তবে মেঘনাদবধ কাব্যে বাঙালির ঐতিহ্য রক্ষিত। যেমন পরিকল্পনায় তেমনি চরিত্র সৃষ্টিতে মহাকাব্যের সমস্ত বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান । প্রত্যেকটি চরিত্র অনুভূতির ঐশ্বর্যে ঐশ্বর্যবান এবং স্বমহিমায় উজ্জ্বল । এ কাব্যের ভাষায় তেজস্বিতা, গাম্ভীর্য ও বিস্তৃতির পরিচয় পাই আমরা সহজেই। মহাকাব্যের অন্যতম লক্ষণ উপমা বৈশিষ্ট্য। উপমা প্রয়ােগে কবি মাইকেল বিস্ময়কর রকমের পটু । এ কাব্যের উপমায় উপমান ও উপমেয় এর সাদৃশ্য কেবল নয়, উপমানের বৈশিষ্ট্যকে কবি পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন। তার বেশিরভাগ ঐশ্বর্য, বৈচিত্র্য, ঐতিহ্য ও সূক্ষ্ম অনুভূতির পরিচয় দেয়। এ কাব্যের উপমা অতিশয় ঐতিহ্যসম্মত। মধুসূদনের ব্যক্তিজীবন, কবিমানস ও যুগমানসে যে বিদ্রোহ বিদ্যমান ছিল মেঘনাদবধ কাব্যের ছন্দে ও ভাবে তার প্রকাশ ঘটেছে অবলীলায় । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- ‘মেঘনাদবধ কাব্যের কেবল ছন্দোবন্ধে ও রচনা প্রণালীতে নহে, তাহার ভিতরকার ভাব ও রসের মধ্যে একটা অপূর্ব পরিবর্তন দেখিতে পাই । মেঘনাদবধ কাব্যে মধুসূদন দত্তের প্রবল দেশপ্রেমের অপূর্ব প্রকাশ ঘটেছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct