আঞ্চলিক পরিসর ছাড়িয়ে মণিপুর এখন বিশ্ব সংবাদ। সেখানে সহিংসতায় ইতিমধ্যে প্রায় ৮০ জন মারা গেল। ঘটনা শুরুর ২৬ দিন পর ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইম্ফলে গেলেন। তিন দিন থাকলেন সেখানে। এই সহিংসতার কারণ ও ফলাফল নিয়ে দেশ-বিদেশে বিস্তর লেখা হচ্ছে। রাজ্যের রাজধানী ছাড়াও অমিত শাহ যে মোড়ে নামের একটা শহরেও গেলেন, সেটাই সহিংসতার পূর্বাপর বুঝতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হতে পারে। লিখেছেন আলতাফ পারভেজ।
আঞ্চলিক পরিসর ছাড়িয়ে মণিপুর এখন বিশ্ব সংবাদ। সেখানে সহিংসতায় ইতিমধ্যে প্রায় ৮০ জন মারা গেল। ঘটনা শুরুর ২৬ দিন পর ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইম্ফলে গেলেন। তিন দিন থাকলেন সেখানে। এই সহিংসতার কারণ ও ফলাফল নিয়ে দেশ-বিদেশে বিস্তর লেখা হচ্ছে। রাজ্যের রাজধানী ছাড়াও অমিত শাহ যে মোড়ে নামের একটা শহরেও গেলেন, সেটাই সহিংসতার পূর্বাপর বুঝতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হতে পারে।
সহিংসতার প্রতিক্রিয়া যখন ৮৫০ মাইলজুড়ে
মণিপুরের একদম পশ্চিমের ছোট্ট শহর মোড়ে। একেবারে সীমান্ত-লাগোয়া। উল্টো দিকে দুই মাইল দূরে মিয়ানমারের তামু। মোড়ে পড়েছে মণিপুরের তেঙনৌপাল জেলায়। তামু মিয়ানমারের সাগাইন বিভাগে। এই দুই এলাকাকে বিভক্ত করেছে সরু এক নদী; আর যুক্ত রেখেছে লোহার দুটো সেতু। এই সেতু দিয়ে মণিপুর যুক্ত মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডো হয়ে সুদূর থাইল্যান্ডের ম্যায় সত পর্যন্ত। ‘ম্যায় সত’ থাই শহর হলেও ভরে আছে মিয়ানমার থেকে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থী ও রাজনৈতিক কর্মীতে। এখানকার দোকানগুলোর সাইনবোর্ডও অধিকাংশ বার্মিজ ভাষায় লেখা। এ যেন বহু জাতিসত্তার আরেক মোড়ে। ম্যায় সত ও মোড়ের মাঝে ৮৫০ মাইল দীর্ঘ ত্রিদেশীয় সড়ক। ‘এশিয়ান হাইওয়ে-১’ যার নাম। নয়াদিল্লির কাছে এ সড়কের অনেক গুরুত্ব। তাদের ‘লুক ইস্ট’ বা ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির অংশ হিসেবে এ সড়ক সংস্কার হয়েছে। ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ বা ‘পূর্বে চলো’ কর্মসূচি নিয়ে ভারতের বিপুল স্বপ্ন ও প্রত্যাশা। কিন্তু মণিপুর সহিংসতা সেই প্রত্যাশাকে হুমকিতে ফেলেছে। আর ওই হুমকির দোরগোড়ায় আছে মোড়ে।
পরিচয়বাদী ঝগড়া
মোড়ে আয়তন ও লোকসংখ্যায় ছোট। কিন্তু বহু জাতিসত্তার মানুষ আছে এখানে। ভারতীয় পর্যটকেরা এখানে যায় ‘বার্মিজ পণ্যের’ আকর্ষণে। প্রায় ২০ হাজার মানুষের শহর মোড়েতে প্রচুর তামিলও আছে। তামিলরা কীভাবে মোড়েতে এল, তার লম্বা ইতিহাস। তবে যে যত থাকুক, এলাকাটি কুকি গেরিলাদের বড় বিচরণভূমি। এই কুকিরা মণিপুর সহিংসতার এক পক্ষ। অপর পক্ষ মইতইরা। এখানকার কুকি, মইতই, নাগা—সবার অল্পবিস্তর সশস্ত্রতা আছে। এর দৃশ্যমান কারণ চোরাচালান ও মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ। জাতিগত স্বাধিকারের বিষয়গুলোও ঐতিহাসিকভাবে সঙ্গে আছে। এবারের সহিংসতার ভরকেন্দ্র যদিও ইম্ফল, কিন্তু মোড়েতেও তার আঁচ লেগেছে। বহুকাল থেকে এখানে মইতই আর কুকিদের মধ্যে ঝামেলা চলছিল। সেই ঝামেলার মূল প্রশ্ন, কে মোড়ের আদি বাসিন্দা। গত ৪ মে এটিএসইউএমের ডাকে ‘আদিবাসী সংহতি পদযাত্রা’র সময় ইম্ফলে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। গত মে মাসের সহিংসতা সেই পুরোনো পরিচয়বাদী ঝগড়ার সঙ্গে নতুন অনেক উপাদান যুক্ত করেছে। কিন্তু অমিত শাহর জন্য সমস্যা হলো ইম্ফলে কুকিরা মার খেয়ে মোড়েতে ক্ষুব্ধ ও সশস্ত্র হয়ে থাকলে ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি বিপদে পড়ে। আবার মোড়ে নিয়ে ইম্ফলের মইতইদের ক্ষোভ থামানোও বিজেপির জন্য জরুরি। কারণ তারা হিন্দু; বিজেপির ভোটব্যাংক। ৬০ আসনের বিধানসভায় ৩৯টিতে মইতইদের জেতার মতো অবস্থা। অথচ তারা থাকে রাজ্যের মাত্র ১০ ভাগ এলাকায়। চলতি সহিংসতায় ইম্ফল বেশি ক্ষতবিক্ষত হলেও মোড়ের মতো প্রান্তিক অঞ্চলে মইতইদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করেছে কুকিরা। দীর্ঘ সময় কুকিরা মোড়ে-ইম্ফল রাস্তা আটকে রেখে মইতইদের পালাতেও দেয়নি। মইতইদের ওপর ঘটে যাওয়া এই অনাচার কমাতেই অমিত শাহকে যেতে হয়েছে সেখানে।
সমাধান আরেকটি রাজ্য?
মণিপুরে কেন সহিংসতা সৃষ্টি হলো এবং এত বেশি জীবনহানি হলো, তার কারণ দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে সংবাদপত্র পাঠকদের জানা হয়ে গেছে। রাজ্যের প্রধান জাতিসত্তা মইতইরা ‘শিডিউল ট্রাইব’ মর্যাদা চায়। আর রাজ্যের ছোট ট্রাইবগুলোর তাতে আপত্তি। আপত্তির পরও গত এপ্রিলে আদালত মইতইদের ওই মর্যাদা দেন। পাহাড়ি জো-জাতিগুলো মনে করছে, আদালতের এই ভূমিকায় রাজ্য ও কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের মদদ আছে। আপাতত, এটা সহিংসতার নগদ কারণ। তবে মইতই বনাম ‘অন্য সবার’ রেষারেষি চলছিল নানাভাবে—অনেক দিন থেকে। রাজ্যটি এ পর্যন্ত যে ১৩ জন মুখ্যমন্ত্রী দেখেছে তার ১১ জনই মইতই। এরও কারণ আছে। ১৯৪৯ সালে রাজ্যটির ভারতভু্ক্তির পর প্রথম সশস্ত্র অসন্তোষ দেখা দেয় মইতইদের ভেতর থেকে। সুতরাং নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে তাদের টেনে রাখার দায় ছিল নয়াদিল্লির। এবারের সহিংসতার পরপরই ইম্ফলের চারদিকের পাহাড়ি জাতিসত্তার মানুষ বলছেন, তাঁরা আর মইতইদের সঙ্গে থাকতে চান না। মণিপুর ভেঙে আলাদা রাজ্য চান। ইতিমধ্যে পাহাড়ি এমএলএদের অন্তত ১০ জন এই দাবি সমর্থন করেছেন। এই দাবি জনপ্রিয় হওয়ার ফল হবে দুটো। মইতইদের সঙ্গে অ-মইতইদের সম্পর্ক স্থায়ীভাবে খারাপ থাকা। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্তঘেঁষা নতুন রাজ্যে কুকি ও নাগাদের প্রাধান্য থাকা এবং সেটা হবে খ্রিষ্টান-অধ্যুষিত একটা রাজ্য। সম্ভাব্য এ রাজ্যের উত্তর-দক্ষিণে নাগাল্যান্ড ও মিজোরাম ইতিমধ্যে যথাক্রমে ৮৮ ও ৮৭ শতাংশ খ্রিষ্টান-অধ্যুষিত। নয়াদিল্লি ও নাগপুরে এসব অঙ্ক অস্বস্তিকর। মণিপুর ভেঙে আরেকটি রাজ্য মানেই মোরহে-তামু অঞ্চলে কুকি ও নাগাদের আধিপত্য, যা ভারতের নিরাপত্তারক্ষীদের জন্যও খারাপ খবর। ভারত এ অঞ্চল শান্ত রাখতে চায় মিয়ানমার হয়ে আসিয়ানমুখী প্রভাববলয় বাড়াতে। এতে আছে বিপুল অর্থনৈতিক ও কূটনীতিক স্বার্থ। রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের তরফ থেকে বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও নয়াদিল্লি যে মিয়ানমারকে চাপ দেয়নি, তার কারণ মোড়ে এলে বোঝা কঠিন নয়। মিয়ানমার ও আসিয়ান ভারতের কাছে এত গুরুত্ববহ যে, নেপিডোতে নির্মম ধাঁচের এক সামরিক সরকারের সঙ্গেও নির্বিঘ্নে সুসম্পর্ক রেখে চলছে তারা। একই লক্ষ্যে গত এক দশকে মণিপুরসহ উত্তর-পূর্ব ভারতীয় সশস্ত্র সংগ্রামী দলগুলোর সঙ্গেও নয়াদিল্লি নানামুখী চুক্তি ও সমঝোতা করছে। শক্তিশালী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ভেতর কেবল নাগাদের সঙ্গে সমঝোতা বাকি আছে। সে আলোচনাও চলছে। ঠিক এ সময়ই মণিপুর অশান্ত হলো।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct