জাইদুল হক, আপনজন: ৩৪ বছরের দীর্ঘ বাম শাসনের পর ২০১১ সালে রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের শাসন কায়েম করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু তাই নয়, পশ্চিমবাংলায় ক্ষমতায় আসার পর থেকে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বামেদের সঙ্গে কংগ্রেসকে একেবারে রাজ্য থেকে নির্মূল করার প্রয়াস নেন। সেই প্রয়াসে তিনি সফল হন। বলতে গেলে ২০১১ সালের পর থেকে বাম ও কংগ্রেসকে প্রায় রাজ্য থেকে মুছে ফেলার উদ্যোগ নেন। তৃণমূলের দাপটে বামফ্রন্টের কর্মীরা ও কংগ্রেস কর্মীরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। সিপিএম ও কংগ্রেস অভিযোগ তোলে তৃণমূলের স্বৈরচারিতা নিয়ে। কোণঠাসা হয়ে পড়ে সিপিএম ও তৃণমূল। তৃণমূল প্রধান প্রতিপক্ষ করে তোলে বিজেপিকে। যদিও বিজেপি তখন পশ্চিমবঙ্গে একেবারে নবজাতক বলা যেতে পারে। ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনে ২৯৪টি আসনের মধ্যে ১৮৪টি আসন পেয়ে রাজ্যে সরকার গঠন করে তৃণমূল কংগ্রেস। বাম ফ্রন্ট পায় ৬২টি আসন পেয়ে প্রধান বিরোধী দল হয়ে ওঠে। কংগ্রেস ৪২টি আসন। বিজেপির আসন ছিল শূন্য। ফলে, বাম ও কংগ্রেস বিরোধী দল হিসেবে শক্তিশালী থাকে। সেটাকে ভাঙতে উঠেপড়ে নামে তৃণমূল। তাতে সফল হয় তৃণমূল। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে বামেদের ভোট ধস নামে। ২১১ টি আসন পেয়ে সরকার গঠন করে তৃণমূল সিপিএম পায় ২৬টি, আরএসপি ৩টি, ফরওয়ার্ড ব্লক দুটি, সিপিআই একটি। কংগ্রেস ৪৪টি আসন পেয়ে প্রধান বিরোধী দল হয়ে ওঠে আর বিজেপি পায় সাকুল্যে তিনটি। নব জীবন পায় তৃণমূল। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনের আগে একের পর এক কংগ্রেস ও বাম বিধায়ককে তৃণমূল কংগ্রেস তাদের দলে যোগদান করায়। আর এই যোগদান প্রকাশ্য জনসভায় করা হয়। এই ভাঙ্গন কিছুতেই রুখতে পারেনি বাম ও কংগ্রেস। এক বৃহৎ সংখ্যক কংগ্রেস ও বাম বিধায়ক তৃণমূলে যোগদান করায় সাংগঠনিক দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। একদা হার্মাদ বাহিনীর তকমা পাওয়া সিপিআইএমের কর্মী সমর্থকদের মধ্যে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। তৃণমূল কংগ্রেসের হতে সিপিএম সমর্থকদের হামলার অভিযোগ ওঠে। কোণঠাসা হয়ে পড়ে কংগ্রেসও। এই পরিস্থিতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস সিপিএম কংগ্রেসকে একেবারে মাটিতে মিশিয়ে দিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা দাবি করতে থাকেন আর কোনো অস্তিত্ব নেই বামেদের। এমনকি কংগ্রেসের। তাদেরকে দমিয়ে রাখার পর এবার লক্ষ্য হয়ে বিজেপি। বিরোধী দল হিসেবে বা কংগ্রেসকে উপেক্ষা করে তৃণমূল প্রধান প্রতিপক্ষ করে তোলে বিজেপি। সেই সুযোগটা কাজে লাগায় বিজেপি। লোকসভা নির্বাচনের আগে তারা তৃণমূল কংগ্রেস থেকে বিধায়ক ও সাংসদকে নিজেদের দলে নিয়ে আসার প্রাণপণ চেষ্টা করে। তাতে সফল হয় বিজেপি। যে বিজেপির মাত্র তিনজন বিষয়ক ছিল ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে সেই বিজেপির সাংসদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৮। তৃণমূল পায় ২২টি আর কংগ্রেস পায় দুটি। সিপিএম বা বাম দল একেবারে শূন্যে পৌঁছায়। আর তারপর থেকে কোন জাদু বলে বিজেপির এই উত্থান তা নিয়ে জোর বিশ্লেষণ চলে। বিশ্লেষকদের ধারণা, তৃণমূল ভেবেছিল বাম কংগ্রেস রাজ্যে শূন্য হলে একাই রাজত্ব করবে তারা। কিন্তু হঠাৎ উত্থান হয়ে পড়ে বিজেপির। এর জন্য বিজেপি মোদি ম্যাজিক দাবি করছে। আর তাকে ঠেকাতে হিমশিম তৃণমূল।এরপর ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল ২১৩টি আসন পায়, বিজেপি পায় ৭৭টি। বাম কংগ্রেস কোনো আসন পায়নি। সাগরদিঘি উপনির্বাচনে কংগ্রেস জিতলেও জেতা প্রার্থী বায়রন বিশ্বাস তৃণমূলে চলে যাওয়ায় ফের শূন্য কংগ্রেস। আইএসএফ অবশ্য একটি আসন পায়।
২০২১ বিধানসভায় বিপুল ভাবে জিতে আসায় তাতে থামতে চায়নি তৃণমূল। তারা বিজেপি থেকে বিধায়ক ভাঙিয়ে এনেছে জনা ছয়েক। তবু বিজেপি রাজ্যে প্রধান বিরোধী দল তবে, সাগরদিঘি উপনির্বাচনে তৃণমূলের জেতা আসন কংগ্রেস ছিনিয়ে নেওয়ার প্রশ্ন উঠতে থাকে তৃণমূলের জনপ্রিয়তা কমছে কিনা। সেই ড্যামেজ কন্ট্রোল সামলাতে অনেকটা রাহুল গান্ধির ভারত জোড়ো যাত্রার আড়ালে তৃণমূলের দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্য জুড়ে নব জোয়ার যাত্রা করছেন। তাতে ব্যাপক মানুষ যোগ দিচ্ছেন। সেই পরিস্থিতিতে পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন পত্র জন দেওয়া ঘিরে নানা ঘটনা নানা প্রশ্নের মুখে থেকে দিচ্ছে তৃণমূলকে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম শাসনের মধ্যে সবচেয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। তিনি একদিকে বাম জোটকে ধরে রাখেন। অন্যদিকে কংগ্রেস তৃণমূলকে সংঘবদ্ধ হতে দেননি। আবার পুরো নির্মূল করার প্রচেষ্টায় যাননি, যাতে জন মনে এই প্রশ্ন না জাগে তৃণমূল গণতন্ত্র বিপন্ন করে একা রাজত্ব চালাতে চায়। কারণ, বাম শাসনে দেখা গেছে সিপিএম কংগ্রেস বা বিরোধী দলের তুলনায় কম ভোট পেয়েও বিধায়ক সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। তাই সরকার গঠন করেছে। কারণ তাদের জোট সঙ্গী ছোট ছোট বাম দলগুলি ছিল। উদাহণস্বরূপ ১৯৯৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএম ৩৭.১৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। বাম জোট পেয়েছিল ৪৯.৩ শতাংশ। কংগ্রেস পেয়েছিল ৩৯.৪৮ শতাংশ ভোট। কিন্তু সিপিএম পেয়েছিল ২১৩টি আসন। আর কংগ্রেস পায় ৬০টি আসন। সেই ধারা বুদ্ধদেব বাবুর প্রথম দিকে বিদ্যমান ছিল। ২০০১ সালের বিধানসভায় সিপিএম মাত্র ৩৬.৫৯ ভোট পেয়েছিল। বাম জোট পেয়েছিল ৪৯ শতাংশ। ২০০৬ সিপিএম ৩৭.১৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। বাম জোট পেয়েছিল ৫০.২ শতাংশ। আর ২০১১ সালে সিপিএম পায় ৩০.০৮ শতাংশ ভোট। বাম জোট পেয়েছিল ৪১ শতাংশ। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছিল মাত্র ৩৮.৯৩ শতাংশ ভোট। কিন্তু ২৯৪টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ১৮৪টি আসন পেয়ে রাজ্যে সরকার গঠন করে তৃণমূল কংগ্রেস। বাম ফ্রন্ট পায় ৬২টি আসন। তাই বাম ফ্রন্টের জনসমর্থন ছিল না বললে ভুল হবে। বামজোটের মিলিত জন সমর্থন তৃণমূলের থেকে বেশি হলেও ভোটে কিন্তু হারতে হয়েছিল। ২০১৬ সালের নির্বাচনে তৃণমূল তাদের ভোট হার অনেকটা বাড়িয়ে ৪৪.৯১ করেছে। আর ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের ভোটের হার ৪৮.০২ শতাংশ। বিজেপি পায় ৩৭.৯৭ শতাংশ। বিজেপি তাদের অনুমান অনুযায়ী ভোট পেয়েছে। বরং বেশি পেয়েছে। অতীত রেকর্ড বিশ্লেষণ করে বিজেপি দেখেছে সিপিএম ২০১৬ সালে ৩৭.১৬ শতাংশ ভোট পেলেও ছোট শরিকদের নিয়ে সরকার গড়েছিল। ২০১৬ সালে যদিও তারা পেয়েছিল মাত্র ১০.১৬ শতাংশ। তাই বিজেপি ৩৭ থেকে ৪০ শতাংশ ভোট পাবে আঁচ করেই দাবি করেছিল একুশের বিধানসভা তাদের দখলে থাকবে। এরপর দরকার হলে অন্য রাজ্যের মতো কিছু বিধায়ককে ভাঙিয়ে নেবে, যেমনটা লোকসভা নির্বাচনের আগে করেছিল। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন বিফলে গেছে তৃণমূল একাই ৪৮.০২ শতাংশ ভোট পাওয়ায়। সেই ধরনের চুলচেরা নির্বাচন তৃণমূল না করে থাকলে শিয়রে বিপদ। কারণ ১০ শতাংশ ভোট কম অয়েলে তৃণমূলের বিপদ হতো। দরকার ছিল বিজেপির ভোটের হার কিভাবে কমানো যায়। সেই পথে যে মমতা এগোচ্ছেন না তা বোঝা গেল পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন দাখিল বিরোধী দলগুলোকে বাধা দেওয়ায়। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের পরিসংখ্যান বলছে, তৃণমূলের পর সবচেয়ে বেশি মনোনয়ন জমা দিয়েছে। তার অনেক পিছনে সিপিএম, তারপর কংগ্রেস। আর মাত্র সীমিত এলাকায় আইএসএফ। এর পরে সে সব প্রশ্ন উঠছে, তা হল বিজেপিকে তৃণমূল প্রধান প্রতিপক্ষ হলেও সিপিএম, কংগ্রেস, আইএসএফকে বাড়তে দিতে চাইছে না। অথচ সাগর দীঘি বিধানসভা নির্বাচনে যে বিজেপি দ্বিতীয় স্থানে ছিল তাদের উপনির্বাচনে জামানত জব্দ হয়েছে। রাজ্য জুড়ে বিজেপিতে ভাঙ্গনের চিত্রা স্পষ্ট। সেক্ষেত্রে সিপিএম, কংগ্রেস, আইএসএফকে নির্বিচারে মনোনয়ন করতে দিলে তৃণমূলের লাভ ছিল। কিন্তু তৃণমূল ভেবেই নিয়েছে সাগর দিঘী উপনির্বাচনে তাদের হারা মানেই হয়তো বাম কংগ্রেস আইএসএফ তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ। বিজেপির ভোট কমে এদের ভোট বাড়লে বিরোধীদের ক্ষমতা হারানোর ভয় থাকতো না। বাম জোট তৃণমূল তো দূরের কথা বিজেপির ভোট প্রাপ্তির ধরে কাছে নেই। তাই তৃণমূলের ভয় ছিল না। তৃণমূল একেবারে নবজাতক দল আইএসএফকে প্রতিপক্ষ ভাবছে। যদি ভাঙড়ে আইএসএফকে মনোনয়নে বাধা না দিতে তাহলে কেন্দ্রীয় বাহিনীর মতো বিপদকে ডেকে আনত না। বরং, ইমেজ বাড়িয়ে দিল আইএসএফকে। তারা যেভাবে ভাঙড়ে দাপট দেখাল তাতে সিপিএম বিজেপি না পারুক আইএসএফ পাল্টা দিতে পারে তৃণমূলকে সেটা বুঝিয়ে দিল। আর এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে আইএসএফকে কেন্দ্রীয় বাহিনী ডেকে আনার জন্য হিরো বানিয়ে দিল। বিষয়টা তৃণমূলের ভেবে দেখা দরকার। দেখে মনে হচ্ছে তৃণমূল নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct