গোটা ভারতবর্ষের মধ্যে বর্তমানে একমাত্র মহিলা মুখ্য মন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের সর্বপ্রথম মহিলা মুখ্য মন্ত্রী হিসেবে যিনি জ্বলজ্বল করছেন, তিনি হলেন শ্রীমতি (কুমারী) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজকের জনগণ যাকে ভালোবেসে ‘দিদি’ বলে ডাক দেয়। তিনি তৃতীয় বারের মুখ্য মন্ত্রী হিসাবে বাংলার সংসার চালাচ্ছেন। আমরা এই প্রবন্ধে আমাদের জনপ্রিয় দিদি ‘একজন মুখ্য মন্ত্রী হিসেবে কেমন’, তার কিছু দিক বোঝার চেষ্টা করছি। লিখেছেন মোঃ সাহিদুল ইসলাম...
গো টা ভারতবর্ষের মধ্যে বর্তমানে একমাত্র মহিলা মুখ্য মন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের সর্বপ্রথম মহিলা মুখ্য মন্ত্রী হিসেবে যিনি জ্বলজ্বল করছেন, তিনি হলেন শ্রীমতি (কুমারী) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজকের জনগণ যাকে ভালোবেসে ‘দিদি’ বলে ডাক দেয়। তিনি তৃতীয় বারের মুখ্য মন্ত্রী হিসাবে বাংলার সংসার চালাচ্ছেন। আমরা এই প্রবন্ধে আমাদের জনপ্রিয় দিদি ‘একজন মুখ্য মন্ত্রী হিসেবে কেমন’, তার কিছু দিক বোঝার চেষ্টা করছি।
বাল্যকাল ও শিক্ষা : তিনি বুধবার, ৫ই জানুয়ারী, ১৯৫৫ সালে কলকাতায় একটি মধ্যবিত্ত বাঙালি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা, প্রমিলেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, দিদি যখন খুব ছোট ছিলেন, অজানা দেশে পাড়ি দেন। মা গায়ত্রী দেবীর আঁচলে তিনি বড়ো হয়ে ওঠেন। শৈশব কাল থেকেই মমতাদির পড়াশুনার প্রতি খুব ঝোঁক ছিলো। দিদি দেশবন্ধু শিশু শিক্ষালয়ে প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করেন এবং যোগমায়া দেবী কলেজ থেকে ইতিহাসে অনার্স ডিগ্রি নিয়ে স্নাতক হন। তারপরেও তিনি থেমে থাকেন নি। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আবার ইসলামিক ইতিহাসে স্নাতকোত্তর এবং শ্রী শিক্ষায়তন কলেজ থেকে শিক্ষায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। দারিদ্রতা দিদিকে আরো বেশি মজবুত করে তুলে ছিল। তিনি কলকাতার যোগেশ চন্দ্র চৌধুরী আইন কলেজ থেকে আইনের ডিগ্রি ছিনিয়ে নিয়েছেন । তার রাজনৈতিক কর্মজীবন ছাড়াও, তিনি একজন দক্ষ চিত্রশিল্পী এবং লেখক, বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন।
রাজনৈতিক জীবন: ছোট থেকে জীবনের সংগ্রামকে হার মানিয়ে বেশ কয়েকটা ডিগ্রি হাসিল করে, লড়াকু দিদির রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ১৯৭০ এর দশকে যখন তিনি কংগ্রেস পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৮৪ সালে, তিনি যাদবপুরের প্রবীণ ও অভিজ্ঞ কমিউনিস্ট নেতা শ্রী সোমনাথ চ্যাটার্জিকে পরাজিত করে ভারতের সর্বকনিষ্ঠ সংসদ সদস্য হয়েছিলেন । নরসিমা রাও সরকারের কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন, যুব বিষয়ক, এবং ক্রীড়া এবং মহিলা ও শিশু উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী সহ বিভিন্ন মন্ত্রীর পোর্টফোলিওতে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
দিদির রাজনৈতিক জীবনের ভিন্ন আরেকটা পথ তৈরি হয়, এই সেই ২১ শে জুলাই ১৯৯৩ থেকে। দিদির নেতৃত্বে রাইটার্স চলো অভিযান শুরু হয়েছিল, ততকালীন বাম ফ্রন্ট সরকারের প্রতিবাদে, ভোটার পরিচয়পত্রই একমাত্র নথির দাবিতে। যে অভিযানে ১৩ জন কর্মীর মৃত্যু হয় ও অনেকেই আহত হন, তার স্মরণে শহীদ দিবস পালিত হয় ২১ শে জুলাই।
তারপর, ১৯৯৭ সালে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস পার্টির সাথে আলাদা হয়ে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিনের বামফ্রন্ট সরকারের বিরোধীদের মুখ হয়ে ওঠেন। তার নিরন্তর প্রচেষ্টা ২০১১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয়ে পরিণত হয়, বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি আজকের শুধু ভারতবর্ষের দিদি নয় বরং বিশ্বের দিদি নামে বিদিত।
জনপ্রিয় প্রকল্প নীতি :
মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ব্যানার্জির কার্যকাল সমাজের গ্রামীণ এবং অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত অংশগুলির লক্ষ্যে কল্যাণমূলক বেশ কিছু জনপ্রিয় প্রকল্প আছে, যাদের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য হল:
কন্যাশ্রী প্রকল্প: এই স্কিমটি পশ্চিমবঙ্গে মেয়েদের অবস্থাকে উন্নত করার লক্ষ্যে স্কুলে পড়াতে এবং বিবাহ বিলম্বিত উৎসাহিত করে । এটি জাতিসংঘের পাবলিক সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড সহ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। সবুজ সাথী: এই উদ্যোগটি নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রদের সাইকেল সরবরাহ করে, স্কুলে উপস্থিতি বাড়ায় এবং গ্রামীণ এলাকায় স্কুল ছুট কমায়।
খাদ্যাসাথী: এই কর্মসূচির অধীনে, সরকার রাজ্যের জনসংখ্যার প্রায় 90%কে ভর্তুকিযুক্ত খাদ্যশস্য সরবরাহ করে, যা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রেণীর জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। স্বাস্থ্য সাথী: একটি স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্প যার লক্ষ্য তৃতীয় স্তরের পরিচর্যার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য কভার প্রদান করার লক্ষ্যে, পরিবার প্রতি বছরে ৫ লাখ টাকা ব্যবস্থা আছে।
উৎকর্ষ বঙ্গ : একটি দক্ষতা উন্নয়ন উদ্যোগ যার লক্ষ্য যুবকদের বিভিন্ন বৃত্তিমূলক ব্যবসায় প্রশিক্ষণ দেওয়া, তাদের কর্মসংস্থানের উন্নতি করা। অনেক সমালোচকরা যুক্তি দেন যে তার জনপ্রিয় নীতিগুলি স্বল্পমেয়াদে উপকারী হলেও দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নাও হতে পারে ও সমাজের উন্নতির ব্যাঘাত ঘটবে। সামাজিক প্রকল্পের সাথেও তিনি যথেষ্ট পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক ও পরিকাঠামোগত উন্নতির জন্য প্রচেষ্টা করেছেন । যেমন, রাজ্য সড়ক যোগাযোগ, শহুরে পরিকাঠামো এবং আইটি ও শিল্প হাবের উন্নয়নে উন্নতি, কলকাতা পূর্ব-পশ্চিম মেট্রো করিডোর এবং নতুন শিল্প পার্ক সস্থাপন ইত্যাদি। যাইহোক, গুজরাট বা মহারাষ্ট্রের মতো অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় উল্লেখযোগ্য শিল্প বিনিয়োগ আকর্ষণ না করার জন্য তার মেয়াদও সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রাম পর্ব, যা তার ক্ষমতায় উত্থানের ক্ষেত্রে মুখ্য ছিল, একটি শিল্প-বিরোধী ধারণাও তৈরি করেছিল যে তার সরকার ঝাঁকুনি দেওয়ার জন্য সংগ্রাম করেছে।
নিন্দা ও সমালোচনা
মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়াদ বিতর্কমুক্ত ছিল না। তার নেতৃত্বের শৈলী, প্রায়ই স্বৈরাচারী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে, তার সরকারকালীন, বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে সমোলাচিত। যেমন, সারদা চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি (২০১৩) এবং নারদা স্টিং অপারেশনের (২০১৬) মতো স্কিমগুলিতে দুর্নীতি এবং তহবিলের অপব্যবহার। এছাড়াও MGNREGA এবং প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার মতো কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলির বাস্তবায়নে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনিয়মের জন্য তদন্ত করা হয়েছে। কেন্দ্র রাজ্য সরকারকে ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ত্রাণ তহবিল এবং সংস্থান বিতরণে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ করেছে। সম্প্রতি শিক্ষা ব্যবস্থাই অনিয়ম। তবে, সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখে আর জি কর হাসপাতালের ইন্টার্ন হত্যার ঘটনা নিয়ে। একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হলেও রাজ্যে মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
উপসংহার: একদিকে, দীর্ঘ প্রায় ৪৫ বছরের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, একজন কংগ্রেস কর্মী থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত মমতার যাত্রা তার স্থিতিস্থাপকতা এবং জনসেবার প্রতি উত্সর্গের প্রমাণ। অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও, তিনি ভারতীয় রাজনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের জনগণের উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য তার নিরলস সাধনা বেশ প্রশংসনীয়। অন্যদিকে, বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগগুলি তার কার্যকালকে প্রভাবিত করেছে এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একটি বিতর্কিত ইস্যু হয়ে উঠেছে।
এটা আশা করা যাই যে উনার নজর ও গুরুত্ব সম্ভবত টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে কল্যাণমূলক প্রকল্পের ভারসাম্য বজায় রাখবে, দুর্নীতির অভিযোগ মোকাবেলাই থাকবে , এবং রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার উপর থাকবে। তার রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা এবং পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক গতিশীলতার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা, তার নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যত গতিপথ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ হবে।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct