তারুণ্যেই যে প্রাণকে ঝরে যেতে হয়েছিল, সেই তরুণ ক্ষুদিরাম বসু ওরফে দূর্গাদাস সেনের মৃত্যু হলে ও আজো অমর হয়ে আছেন প্রায় প্রতিটি ভারতবাসীর মনের মণিকোঠায়। মাত্র আঠারো বছর বয়সে নিজের জীবন প্রদীপ বিলিয়ে দেন লাখো লাখো মানুষের বুকে প্রতিবাদের আগুন জ্বালাতে। লিখেছেন এম ওয়াহেদুর রহমান...
তারুণ্যেই যে প্রাণকে ঝরে যেতে হয়েছিল, সেই তরুণ ক্ষুদিরাম বসু ওরফে দূর্গাদাস সেনের মৃত্যু হলে ও আজো অমর হয়ে আছেন প্রায় প্রতিটি ভারতবাসীর মনের মণিকোঠায়। মাত্র আঠারো বছর বয়সে নিজের জীবন প্রদীপ বিলিয়ে দেন লাখো লাখো মানুষের বুকে প্রতিবাদের আগুন জ্বালাতে। এ যেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের দুরন্ত পথিক - ‘ মারো ,- বাঁধো , কিন্তু আমাকে বাঁধতে পারবে না/ আমার তো মৃত্যু নাই! আমি আবার আসব! .../ আমার পশ্চাতে ওই যে তরুণ যাত্রীদল, ওদের/ মাঝখানেই আমি বেঁচে থাকব। ...’ ক্ষুদিরাম বসু ব্রিটিশ শাসকদের আতঙ্কগ্ৰস্থ করে তুলেছিলেন। তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী বিপ্লবী। ভারতের জন্য তাঁর তীব্র দেশপ্রেম ছিল। তাঁর যুদ্ধ ছিল ব্রিটিশদের নিকট থেকে ভারতের মানুষের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার যুদ্ধ।
ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ অর্থাৎ আঠারো বছর বয়সী কিংবদন্তি বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু ১৮৮৯ সালের ৩ রা ডিসেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত মেদিনীপুর জেলা শহরের নিকটবর্তী হাবিবপুর মতান্তরে মোহবনী গ্ৰামে জন্ম গ্ৰহন করেন। তাঁর পিতা ত্রৈলোক্যনাথ বসু ছিলেন নাড়াজোলের ( নাদাজাল প্রদেশ শহরের) তহসিলদার।মা ছিলেন লক্ষীপ্রিয় দেবী। তিন কন্যার পর তাঁর মায়ের চতুর্থ সন্তান হলেন ক্ষুদিরাম বসু। ক্ষুদিরাম বসুর দুই ভাই আগেই মৃত্যুবরণ করেন। ফলে তৎকালীন সামাজিক নিয়মানুযায়ী ক্ষুদিরাম বসুকে তাঁর পিতা তার বড়ো বোন অপরুপা দেবীর নিকটে তিন মুঠি খুদের ( শস্যের খুদ) বিনিময়ে বিক্রি করে দেন।তাই ক্রয়রত শিশুটির নাম রাখা হয় ক্ষুদিরাম। প্রসঙ্গত ক্ষুদিরাম বসু মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মা এবং ছয় বছর বয়সে পিতাকে হারিয়েছিলেন। তিনি ডানপিটে ও রোমাঞ্চপ্রিয় হলে ও আসলে ছিলেন মেধাবী ছাত্র। তবে কিশোরসুলভ সাহস, সত্যেন্দ্রনাথ বোস,গেয়ানানন্দ বোস এবং দেশপ্রেমি কার্যক্রমের প্রচারাভিযান সর্বোপরি একটি গুপ্তসভার নেতৃত্ব তাকে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রভাবিত করেছিল। যখন ক্ষুদিরাম বসু স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশগ্রহণ করেন তথা ফাঁসির সংস্পর্শ লাভ করেন তখন তিনি নিছক একটি শিশু। ফাঁসির সময় তাঁর বয়স ছিল আঠারো বছর সাত মাস এগারো দিন।
মেদিনীপুরে তাঁর বিপ্লবী জীবনের অভিষেক। তিনি বিপ্লবীদের নবগঠিত আখড়ায় যোগদান করেন। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু এবং রাজনারায়ণ বসুর প্রভাবে মেদিনীপুরের একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলেন। সেই সংগঠনের নেতা ছিলেন হেমচন্দ্র দাস কানুনগো এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন হেমচন্দ্র দাসের সহকারী। ১৯০২ এবং ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে শ্রী অরবিন্দ ও ভগ্নিনী নিবেদিতা মেদিনীপুর ভ্রমণ করেন।
তাঁরা স্বাধীনতার জন্য জনসমক্ষে ধারাবাহিক বক্তব্য রাখেন এবং বিপ্লবী জনগোষ্ঠী গুলির সঙ্গে গোপন অধিবেশন করেন। তখনই কিশোর ক্ষুদিরাম বসু এই সকল বিপ্লবী আলোচনায় অংশ গ্ৰহন করেন ও অনুশীলন সমিতিতে যোগদান করেন।
বিখ্যাত বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষের কর্মতৎপরতার সংস্পর্শে আসেন। তিনি পনেরো বছর বয়সেই অনুশীলন সমিতির একজন স্বেচ্ছাসেবী হয়ে ওঠেন এবং ভারতে ব্রিটিশ শাসন বিরোধী পুস্তিকা বিতরণের অপরাধে গ্রেপ্তার হন। ক্ষুদিরাম বসু ভারতের গর্ভনর জেনারেল লর্ড কার্জনের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভাবে স্বদেশী আন্দোলনে অংশ গ্ৰহন করেন। ১৯০৭ সালে ৬ ডিসেম্বর রেলওয়ে স্টেশনে ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড এর উপর তিনি ও প্রফুল্ল চাকী ওরফে দীনেশ চন্দ্র রায় বোমা হামলায় সক্রিয় ভাবে অংশ গ্ৰহন করেন। কিন্তু এই বোমা হামলায় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড।
কিন্তু এই বোমা হামলায় নিহত হন ব্রিটিশ দুই জন নাগরিক। এই দুই ব্যক্তির হত্যা কান্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য ১৯০৮ সালের ১১ আগষ্ট ভোর ছয়টার সময় মুজফফর পুর জেলে ক্ষুদিরাম বসুকে ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু প্রফুল্ল চাকী গ্ৰেপ্তারের পূর্বেই আত্নহত্যা করেন।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশকে স্বাধীন করার জন্য হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে নির্দ্ধিধায় জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন মেদিনীপুরের সেই আঠারো বছরের ক্ষুদিরাম বসু। যিনি ছিলেন একজন বিপ্লবী,যার উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরোধীতা করা।
ক্ষুদিরাম বসুর সাহসীকতা ও আত্মত্যাগ ভারতবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবোধের উন্মাদনা ছড়িয়ে দিয়েছিল এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যোগদানে অনুপ্রাণিত করেছিল। অর্থাৎ দেশকে ব্রিটিশ শাসক - শোষকের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য ক্ষুদিরাম বসু যে অমিত সাহসীকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তার গৌরব গাঁথা আজ ও অমলিন রয়েছে।
মৃত্যুভয় কে তুচ্ছ করে দেশমাতার স্বাধীনতার জন্য অন্যায় আর শোষন থেকে মুক্তির জন্য প্রান বিসর্জন করে অমর হয়ে রয়েছেন ক্ষুদিরাম বসু। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম পথিকৃৎ তথা ফাঁসির মঞ্চে প্রথম শহীদ কিংবদন্তি বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু আজ ও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে স্মরণীয় - বরণীয় হয়ে রয়েছেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct