মহবুবুর রহমান : এবার গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকা হামাস ইসরায়েলি ভূখণ্ডে অতর্কিতে ভয়াবহ হামলার পর নিরবচ্ছিন্ন বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। উভয় পক্ষের আক্রমণে বহু বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়েছেন।তাই নিয়ম করে যেমন সূর্য উঠে এবং অস্ত যায়, তেমনি নিয়ম করে তাদের জীবনেও বারবার নির্মমতা নেমে আসে। দশকের পর দশক ধরে তা চলছে। এক সময় তাদের জমি ছিল, মাথার উপরে ছাদ ছিল। সব দখল হয়ে গেছে। সর্বশেষ আশ্রয়টুকুও দখলের পথে।পৃথিবী একটি নির্দয়-নিষ্ঠুর সময় অতিক্রম করছে। এমন সময় আগে কখনো আসেনি—বলা যাবে না। বেশ কয়েকবার এসেছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, হিটলারের ইহুদি নিধন, ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম অধ্যায়। তবে, এবারের নিষ্ঠুরতা-নির্মমতা ও বর্বরতা একটু ব্যতিক্রমী। সমগ্র পৃথিবী এবারের বর্বরতা-নিষ্ঠুরতাকে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা করছে, যা সম্ভবত কখনো এমনভাবে দৃশ্যমান হয়নি। বলছি ফিলিস্তিনিদের কথা। বলছি বিশ্ব শক্তির সহযোগিতায় ইসরায়েল কর্তৃক সংগঠিত দখল-হত্যা ও নিষ্ঠুরতার কথা। বিশ্বের অনেক দেশে যুদ্ধের থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। কোনো কোনো দেশের সীমান্তে যুদ্ধ চলমান অবস্থায় রয়েছে। ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সৌদি-ইয়ামেন যুদ্ধ, আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধ, পাক-ভারত যুদ্ধ, চীন-ভারত যুদ্ধ, সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ প্রভৃতি যুদ্ধক্ষেত্রগুলো চলমান। আমেরিকা-আফগানিস্তান যুদ্ধে টানা ২০ বছরের যুদ্ধ শেষে আমেরিকা ২০২১ সালে সৈন্য গুটিয়ে নিয়েছে। এসব যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ কয়েক বছর ধরে তুঙ্গে থাকলেও গত মাসখানেক থেকে ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো এখন বেশ সরগরম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, প্রায় ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ চলমান। টানা দেড়মাস পেরিয়েছে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধ। এতে নিহতের সংখ্যা হাজার হাজার বললেও ভুল হবে।নিহত অজস্র অগণিত। ক্রমশ এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আলজাজিরার প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।উল্লেখ্য, হামাস ২০১৭ সালের এক নীতিনির্ধারণী নথিতে ইঙ্গিত দিয়েছিল, তারা ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল যেসব অঞ্চল দখল করেছিল, সেগুলো যদি ফিরিয়ে দেয় ও অঞ্চলগুলোকে যদি ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করা হয়, তাহলে তারা তা মেনে নেবে।অন্যদিকে, ইসরায়েল বরাবরই হামাসের ওই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। এমনকি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুও একাধিকবার বলেছেন, ইসরায়েল কখনোই ছয় দিনের যুদ্ধ দখল করা ভূখণ্ড ফেরত দেবে না বা ১৯৬৭ সালের সীমান্তে ফিরে আসবে না।গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে আকস্মিক রকেট হামলা চারায় হামাস। সেদিন মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ্য করে প্রায় ৫ হাজার রকেট ছোড়ে তারা। পরে সীমান্তবেড়া ভেঙে ইহুদি দেশটির অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েন হামাসের যোদ্ধারা।
প্রশ্ন এখানেই, জাতিসংঘের মতো পৃথিবীতে সংঘ থাকতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত এত যুদ্ধক্ষেত্রের আবির্ভাব হয় কীভাবে? যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে বাস্তবায়নে কতটা সফল পৃথিবীর বিবেকখ্যাত এ সংঘটি?পৃথিবীতে এসব যুদ্ধ আসলে হঠাৎ করেই সংঘঠিত হয়নি। আজ যে বড় বড় ঘটনা ঘটছে, সে ঘটনা অতীতের ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন ঘটনার প্রতিফলন মাত্র। অতীতের ঘটনাগুলোই বর্তমানে বড়সড় হয়ে প্রতিফলিত হয়। লেখক ও অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান তার ‘বিশ্ব রাজনীতির ১০০ বছর’ গ্রন্থে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নেপথ্যে বলেছেন, ঊনবিংশ শতকের সংঘটিত ঘটনারই প্রতিফলন বিংশ শতাব্দীতে ফল হিসেবে পৃথিবী পেয়েছিল ‘প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মতে, ছোট ছোট বালুকণা/বিন্দু বিন্দু জল/গড়ে তোলে মহাদেশ/সাগর অতল। শুরুতেই যে যুদ্ধগুলোর নাম উল্লেখ করেছি সেই প্রত্যেকটা যুদ্ধ কবির পঙ্ক্তির ভাষায়, ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল। তাহলে কি আমরা বালুকণা আর বিন্দু বিন্দু জল নিয়ে নিকট ভবিষ্যতে সাগর, মহাসাগরের মতো তৃতীয় কোনো বিশ্বযুদ্ধের সম্মুখীন হতে যাচ্ছি? কেননা, আজ যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যুদ্ধগুলো পৃথিবীর মানুষ প্রত্যক্ষ করছে, কয়েক দশক পরে এই যুদ্ধগুলোই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের নিয়ামক হবে না তা বেশ সন্দেহাতীত। চলমান ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধের অতীত ও বর্তমান সম্পর্কে একটু জেনে আসি। তাহলে বিষয়টি বুঝতে বেশ সুবিধা হবে। সপ্তম শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত দীর্ঘ ১২০০ বছর ফিলিস্তিন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। ফিলিস্তিন তখন অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশবলয়ের বিরুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে অটোমান সাম্রাজ্য পরাজয় বরণ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশবলয় জয়লাভের নেপথ্যে ছিল কৃত্রিম ফসফরাস বোম। ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বেইজম্যান সেই দুর্লভ বোমার আবিষ্কারক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ব্রিটিশবলয় ড. হেইস বেইজম্যানকে তাৎক্ষণিক উপহার দিতে চাইলে ড. বেইজম্যান উপহারস্বরূপ ফিলিস্তিনের বুকে একটি ইহুদি রাষ্ট্রের দাবি করে। বেইজম্যানের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনের বুকে ইহুদি রাষ্ট্র বাস্তবায়নের জন্য ১৯১৮-১৯৪৮ পর্যন্ত প্রায় ৩০ বছর ফিলিস্তিনকে উপনিবেশ হিসেবে ব্রিটিশরা শাসন করতে থাকে। তখন ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনি জনগণকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দেয়ার মিথ্যে আশ্বাস দেয়। মূলত ৩০ বছরে এই মিথ্যা আশ্বাসের ফাঁকে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে জাহাজভর্তি করে ইহুদিদের ফিলিস্তিনে আশ্রয় দিতে থাকে। ১৮৭৮ সালে ফিলিস্তিনে মাত্র ৩.২ শতাংশ ইহুদির বাস করত। ১৯১৮ সালে ফিলিস্তিনে যেখানে ইহুদি ছিল মাত্র ২০ হাজার সেখানে মাত্র ৩০ বছরের ব্যবধানে ১৯৪৮ সালে ইহুদি জনসংখ্যা উন্নীত হয় ৬ লাখে! ১৯৪৮ সালে ১৪ মে রাতের আঁধারে ইসরাইল নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দিয়ে ফিলিস্তিন থেকে ব্রিটিশ হাত গুটিয়ে নেয়। এরপর ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে আরবদের পরাজিত করে ইসরায়েল বিস্তৃত এলাকা দখল করে নেয়। ১৭ বছর ধরে গাজা অবরুদ্ধ, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় খোলা কারাগার। ২০০৫ সালের নির্বাচনে ফিলিস্তিনিদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মাহমুদ আব্বাস। ২০০৪ সালে ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পর আল ফাত্তাহর নেতৃত্বে আসেন মাহমুদ আব্বাস। ২০০৬ সালের প্রাথমিক নির্বাচনে পরাজিত হয় ফাত্তাহ। সেই বছরই হামাস-ফাত্তাহ গৃহযুদ্ধে পরাজিত হয় ফাত্তাহ। ২০০৭ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে গাজায় সরকার গঠন করে হামাস।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct