একটি ফটোগ্রাফ বারবার অনুলিপি করা যেতে পারে। ছবিটির ব্যাখ্যাও ক্রমশ পালটে যেতে পারে। আমি সেই ছবিটার কথা ভাবি, ভারত জোড়ো যাত্রার সময় যখন আমি সেলফি আক্রমণের সম্মুখীন হই। লক্ষ্য করি যে আমার চারপাশ ঘেরাও করে একটি হাত এবং একটি ক্যামেরা আমাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে “দয়া করে হাসুন”। প্রায়ই বিভিন্ন গ্রুপ আমার ওপর হামলা করেছে। তারা আমাকে ঘিরে ফেলে কিন্তু কে ছবি তুলতে যাচ্ছে তা ঠিক থাকে না। সেসব সেলফি শিকারিদের নিয়ে লিখেছেন যোগেন্দ্র যাদব। আজ প্রথম কিস্তি।
কোনো রাজনৈতিক জগতে সংগঠন যদি ফাঁপা হয় এবং নেতাদের সান্নিধ্যই যদি প্রাসঙ্গিকতার একমাত্র চাবিকাঠি হয়, তাহলে সেলফিই হয়ে ওঠে জনগণ এবং ক্ষমতার মধ্যে সেতু।
আমাদের পৈতৃক গ্রামের বাড়িতে একটি ফটোগ্রাফ রয়েছে, যা আমার বাবার প্লেটোনিক শৃঙ্খলা অনুসারে দেওয়ালের জন্য অনুমোদিত কিছু জিনিসের মধ্যে একটি। এটি ১৯৩০-এর দশকের গোড়ার দিকে এলাহাবাদে তোলা হয়েছিল। কোনো ক্যাপশন বা নোটেশন নেই, তাই উপলক্ষ্যটি বোঝা শক্ত। তবে এটি স্পষ্টতই সাদা টুপি পরা কংগ্রেস কর্মীদের একটি গ্রুপ ছবি, সম্ভবত এলাহাবাদে তোলা। জওহরলাল নেহরু এবং কমলা নেহরু সামনের সারিতে বসে আছেন। তাঁদের পিছনে দ্বিতীয় সারিতে কর্মীদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন বলবীর সিং, যিনি আমার নানাজি বা মাতামহ। তিনি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে শীঘ্রই মারা যান। আমাদের কাছে এটি তাঁর একমাত্র ছবি এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে আমাদের মূল্যবান যোগসূত্র। তবুও এই ছবি তোলার মুহূর্তটি নিয়ে আমি দ্বিধান্বিত। এই ছবি কি নেহরু তুলতে চেয়েছিলেন? কর্মীদের সঙ্গে থাকতে পেরে তিনি কি খুশি ছিলেন? পরের মিটিংয়ের জন্য তাড়াহুড়ো করছিলেন? নাকি কেবল উদাসীন ছিলেন? ফটোগ্রাফটি আমাকে মনে করিয়ে দেয় যে আপনি কখনই জানেন না, কোন ছবি কোন সময়ে কার কাছে কী অর্থে ধরা দেবে। একটি ফটোগ্রাফ বারবার অনুলিপি করা যেতে পারে। ছবিটির ব্যাখ্যাও ক্রমশ পালটে যেতে পারে। আমি সেই ছবিটার কথা ভাবি, ভারত জোড়ো যাত্রার সময় যখন আমি সেলফি আক্রমণের সম্মুখীন হই। “আহ, যোগেন্দ্রজি, আমি ছোটবেলা থেকেই আপনাকে টিভিতে দেখে আসছি ...” ঠিক যখন আমি তার টাক মাথা দেখে নিজেকে ৯০ বছর বয়স্ক ভাবতে থাকি, লক্ষ্য করি যে আমার চারপাশ ঘেরাও করে একটি হাত এবং একটি ক্যামেরা আমাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে “দয়া করে হাসুন”। প্রায়ই বিভিন্ন গ্রুপ আমার ওপর হামলা করেছে। তারা আমাকে ঘিরে ফেলে কিন্তু কে ছবি তুলতে যাচ্ছে তা ঠিক থাকে না। যখন তারা একজন স্বেচ্ছাসেবক খুঁজে পায় এবং নিজেদেরকে সাজিয়ে নেয়, তখন মাঝখানে একটি সেলফির হাত বেরিয়ে আসে, অন্য সবার ফ্রেম নষ্ট করে। গ্রুপ ফটোর পর চলে সাব-গ্রুপ এবং একক ব্যক্তিকে নিয়ে সেলফি। আমার কিছু করার থাকে না। অনুরোধ জানানোর কোনো উপায় থাকে না। ভয়ে থাকি যে কোনও দিন এই সেলফিগুলির মধ্যে একটি আমার দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠবে। (কোনো ছবি দেখিয়ে বলা হবে “শ্রীযুক্ত ‘কখগ’ ছিলেন যোগেন্দ্র যাদবের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী”)
কখনও কখনও সেলফি শিকারিরা তাড়াহুড়ো করে এবং যথাযথ সম্ভাষণ ছাড়াই ট্রফি নিয়ে চলে যায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আমাকে চেনেও না। সেলফির পরে একটি অহিংস স্বীকারোক্তি থাকে: “আপকো কহিঁ দেখা হ্যায়। আপকা নাম? (আপনাকে কোথাও দেখেছি। আপনার নাম কী?)” প্রায়শই ঘনিষ্ঠতার একটি ইঙ্গিত থাকে: “যোগেন্দ্রজি, এক সেলফি তো বনতি হ্যায় (একটি সেলফি তোলা আবশ্যক)”। সেলফি যে কোনো জায়গায় হতে পারে: খাবার টেবিলে, স্লিপার বার্থে, ওয়াশরুমের ভিতরে। ভারতীয় সেলফি আপনার গোপনীয়তা এবং স্বতঃস্ফূর্ততার যে কোনো পশ্চিমি ধারণা ভেঙে দিতে পারে। আপনি যদি জনতার কাজে জীবন কাটান, তবে আপনি জনগণের সম্পত্তি।
আমি কয়েক বছর আগের একটি সেলফি হামলার কথা ভুলতে পারি না। তখন দুই সন্তানকে নিয়ে দিল্লির বিশ্ব বইমেলায় গিয়েছিলাম। হঠাৎ ছোট সন্তান চোখের আড়ালে চলে যায়, তখন সবে সাত বা আট বছর তার বয়স। চলন্ত ভিড়ের মাঝখানে তাকে খোঁজার সময় আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করেছিল। সেই মুহুর্তে আমার কাঁধে একটি হাত অনুভব করলাম, “যোগেন্দ্রজি, এক সেলফি হো যায়ে (একটি সেলফি হয়ে যাক?)”, আমি শুনলাম এবং সেটা উপেক্ষা করে চারপাশে তাকাতে থাকলাম। তখন সেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সেলফি শিকারি আমাকে একপাশে টেনে নিয়ে গেল। আমি তাকে আমার পরিস্থিতি বোঝালাম এবং ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম। “অবশ্যই,” তিনি বললেন, “পর এক সেলফি তো বনতি হ্যায়”। আমি ঘুরে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই অবস্থায় কেউ তার সঙ্গে এমন করলে তার কেমন লাগবে? তিনি সহানুভূতিতে মাথা নাড়লেন এবং তবুও সেলফি তুলতে গেলেন! তা সত্ত্বেও বিশ্বের এই অহংবোধের একক দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে আমি-আমার-আমিত্ব মহাবিশ্বের কেন্দ্রে রয়েছে, তা কোনওভাবেই সেলফির পিছনে একমাত্র চালিকা শক্তি নয়। গেছে।
লেখক ‘স্বরাজ ইন্ডিয়া’র প্রতিষ্ঠাতা।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct