ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ একটি বহু আলোচিত ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহ,বেশির ভাগ আলোচনা বা বর্ননা পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকদের কলমে এবং তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিতেই লেখা, সেগুলি যে নিরপেক্ষ নয় এরকম বলার সাহস না দেখানোই ভাল। মধ্যপ্রাচ্য থেকে উত্থিত জনৈক চর্চাকারী ঐতিহাসিকের এ বিষয়ে লেখা বই ‘The Crusades Thrugh Arab Eyes’ পড়লামI বইটির লেখক Amin Malouf জর্ডনের লোক এখন থাকেন প্যারিসে, এবিষয়ে দু চার কথা বলা দরকার মনে করছি। লেখক নিজেই epilogou হিসেবে লিখেছেন, আমি বঙ্গানুবাদ করলাম। আব্দুস শুকুর
এই ধর্মযুদ্ধের প্রারম্ভে সম্মিলিত ইউরোপের প্রবল আক্রমনে প্রথম দিকে মুসলমানরা পিছু হটে, একটা বড় অংশ খ্রীষ্টান তথা ফরাসীদের দখলে যায়, এবং বিবাদের মৃল ক্ষেত্র প্যালেষ্টাইন তাদের দখলে চলে আসে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, ২০০ বছরের মধ্যে ইঊরোপিয়নরা ,প্যালেষ্টাইনসহ সমস্ত আরবভূমি থেকে পুরো বিতারিত হয় এবং প্যালেষ্টাইন আরবদের দখলেই থেকে যায় ইহাকে ইসলামের জোরালো বিজয় মনে করা যেতেই পারে।যদিও পশ্চিমের জোরালো আক্রমন বারবার ঝাঁপিয়ে পড়ে ভেবেছিল, ইসলামের শক্তিকে আটকে রাখা যাবে,কিন্তু বাস্তবে ঘটেছিল ঠিক উলটো,দুইশত বছরের মধ্যে আরব ভুখন্ড থেকে ফরাসিরা পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হয়েছিল;এমন কি তুরস্ক সুলতানের মাধ্যমে মুস্লিমরা পশ্চিমাদের উপর এত আধিপত্য বিস্তার করেছিল যে মুল ইউরোপেও তাদের বিজয়রথ পৌছে গিয়েছেল।১৪৫৩ সালে কনস্তানতিনোপল বিজয় এবং১৫২৯ সালে ভিয়েনা আক্রমন তার প্রমান। উপর থেকে দেখলে যেমন মনে হয়,অনেক সময় ঘটনা চক্র সেরকম হয়না,অনেক সময় ইতিহাসের বৃহত্তর প্রেক্ষাপট দিয়ে ইতিহাসৈর বিচার হয়। ক্রুসেডের সময় আরব জগৎ বিস্তৃত ছিল স্পেন থেকে ইরাক পর্যন্ত,এবং সে সময় বিশ্বে জ্ঞান বিজ্ঞানের তারাই ধারক ছিল,এবং শিক্ষা সভ্যতা সংস্কৃতি বিজ্ঞানের নানা শাখা যেমন গনিত রসায়ন,জোতির্বিদ্যা প্রভৃতিতে , ইউরোপের চেয়ে কয়েকগুন এগিয়ে ছিল। এখান থেকেই সভ্যতার ভরকেন্দ্র নির্দিষ্টভবে ইউরোপের দিকে সরতে শুরু করে। এখানে কার্য কারন সম্পর্ক কি ছিল, ভাবা দরকার। আমরা বলতে পারি কি এই সময় থেকেই ইউউরোপের সভ্যতার উত্থ্যানের সুচনা ও আরবদের পতন শুরু হল বলা যাবে কি1 এবং ইউরোপ পৃথিবীর উপর আধিপত্য বিস্তার শুরু করলো।
যদিও এই ধারনা পুরোপূরি বেঠিক নয়,তবুও এই ধারনার কিছু পরিবর্তন আবশ্যিক। ক্রসেডের আগের সময়ে আরবদের কিছু দুর্বলতা ছিল ফরাসী আক্রমনের পর যাহা বোঝা গেল,এবং সম্ভবতঃ বাড়ল, কিন্তু কিছুতেই বলা যাবেনা যে ফরাসী আক্রমন থেকেই এগুলির শুরু হয়েছিল। হযরত সঃ অনুসারী আসল শিষ্যরা প্রশাসন ও মুল ধারার উপর তাদের প্রভাব নবম শতাব্দীতেই হারিয়ে ফেলেছিলেন, তারপর যারা ক্ষমতার দখল নিয়েছিলেন প্রায় সকলেই অনারব,ফরাসী দখলদারীর কালে নানা কাজের মধ্যে যে আরব ব্যক্তিরা ছিলেন তারা কারা , বেশির ভাগই খুব গুরুত্বপূর্ন কাজে বা ক্ষমতার অলিন্দে বিচরন করতেননা মুলতঃ যেকাজগুলি করতেন সেগুলি , ছিল রোজনামচা রাখা , কারীর কাজ, অল্প ক্ষমতার রাজা বা শাসক যেমন ইবনে আমর মুনকির,এবং নিস্তেজ খলিফারা। কিন্তু বিদেশী ফরাসীদের বিরুদ্ধে মূল লড়াই যারা চালিয়ে ছিলেন যেন–জাঙ্গি, নুরাল দিন,কুটুজ,বেইবার,কালাউন ছিলেন তূর্কী,আল আফজাল ছিলেন আর্মেনিয়ান,শিররখু, সালাদিন এবংআল কামিল ছিলেন কুর্দ। অবশ্য সঠিক যে এরা সাংস্কৃতিক ও মানসিক ভাবে আরব দ্বারা প্রভৃত প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু এও জানা দরকার যে ১১১৩৪ সালের সুলতান মাসসুদ, বাগদাদে খলিফা আল মুলতারসিদের সাথে কথা বলার জন্য অনুবাদক/interpreter/ ব্যবহার করতে হয়েছিল। ৮০ বছর আগে তূর্কিরা বাগদাদে পৌঁছনোর পরেও এই অবস্থা ছিল। এমন কি আরও গুরুতর ব্যাপার হল অধিকাংশ তুর্কি যোদ্ধারা যাদের আরব বা ভূমধ্যসাগরীয় সভ্যতার সাথে কোন যোগ ছিলনা,তারাও নিয়মিত পশ্চিম বিরোধী যুদ্ধবাহনীতে নিয়মিত যোগদান করত এবং এখানে তাঁদের প্রাধান্য হয়েছিল, ফরাসীদের দাবিয়ে দিয়েছিল এবং এদেশে থামিয়ে দিয়েছিল। বরং আরবরা সপ্তম শতাব্দীতে ফুটে উঠা সুন্দর ফুল গুলিকে আরও চর্চা ও বিকশিত করতে পারেনি। ইহা দুঃখের।পশ্চিমাদের আগমনের সময়কালে তাঁদের উজ্জলল সময় কাটিয়ে এসেছে তাদের অতিত গৌরবের স্মৃতিচারনে মশগুল, সেরা সময় পেরিয়ে এসেছে,এবং আক্রমনকারী ফরাসীদের চেয়ে তারা সমস্ত ব্যাপারেই অনেক এগিয়ে,কিন্তু তাদের পতন শুরু হয়ে গেছে। আরবদের দ্বিতীয় দুর্বলতা ছিল, নির্দিষ্ট প্রতিষ্টান তৈরী না করতে পারার অক্ষমতা, ফরাসীরা মধ্যপ্রাচ্যে পৌঁছনোর পর পরই তাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরী করে ফেলেছিল, জেরুজালেমে পরপর ক্ষমতা গ্রহন করছিল সুশৃঙ্খলভাবে কোন গোলমাল ছাড়াই,রাজার কাউনসিল বা পরমর্শ সভা সুচারুভাবে রাজাদের কাজকর্মের উপর নজর রাখতে পারতেন,কিন্তু আরবদের মধ্যে এই ব্যবস্থাপনা বা institution গুলি দেখা যেতনা। বরং উল্টো ঘটতো, একজন রাজার অবসানে আর একজন রাজা আসতে বহু বিসম্বাদ খুনোখুনি এসব হতো বিদেশীদের সুবিধা হতো,দেশীরা বহু জেতা লড়াই হেরে যেতো,সম্ভবতঃ দেশীয়দের যাযাবরী পশ্চাদপট এর জন্য দায়ী। আরব তুর্কী বা মঙ্গোল সবার একই পৃকৃতি ছিল।। এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে এই জটিল ধাঁধা বোঝা মুস্কিল, তবে এই ধাঁধা বর্তমান আরব জগতেও বিদ্যমান।
স্থায়ী,স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানের অভাব এর ফল অবশ্যই সাধারন মানুষের অধিকারের ঊপরই পড়ছে ক্রুসেডের সময়ে, ইউরোপীয় রাজাদের ক্ষমতা সুনির্দিষ্ট নীতির দ্বারা নিয়ন্তরিত হতো সেই নীতি লঙ্ঘন করা সহজ ছিলনা। ঊসামা একবার জেরুজালেম ভ্রমন করে মন্তব্য করেছিলেন,নাইটদের করা সিদ্ধান্ত রাজারাও বাতিল করতে পারতেন না,পরিবর্তনও করতে পারতেননা। ইবনে জুবেরের করা বক্তব্য আরো তাৎপর্যপূর্ন ; টায়ার বন্দরের কাছে তিবনিন ছাড়িয়ে গ্রামপুঞ্জ দেখলাম,চারদিকে সুন্দর চাষ করা জমি সমস্ত মুস্লিমদের এবং ফরাসীদের সাথে উত্তম সহাবস্থনে রয়েছে।বাড়ী ঘর সব সুরক্ষিত,সিরিয়াতে ফরাসীদের দখল করা এলাকাগুলোও একই রকম। ভূমি এলাকা, বাড়ীঘর, ফার্ম মুসলমানদেরই দখলে একই ভাবে মুস্লিম শাসকদের সাথেও যারা আছেন,সমধর্মীয়দের সাথে যে খুব ভাল হচ্ছিল তাহা বলা যায়না। ইবনে জুবায়েরের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারন ছিল, সে সময় দক্ষিন লেবাননের একটি রাস্তা দিয়ে কিছু গুরুত্বপৃর্ণ রপ্তানী তার নজরে পড়েছিল, এবং ফরাসী বিচার ব্যবস্থার কিছু আদিম রুপ যেগুলিকে বর্বর বলতে হত,যেমন ওসামা জোর দিয়েছিলেন, তাদের সমজের অধিকার বিভাজনের সুবিধা ছিল,নাগরিকত্বের ধারনা যদিও তখনো দানা বাধেনি, কিন্তু সামন্ততান্ত্রিক ভুস্বামী,নাইট, যাজক,বিশ্ববিদ্যালয়,বুর্জোয়াশ্রেনী এবং ঐমন কি বিধর্মী চাষীদেরও সুনির্দিষ্ট অধিকার ছিল। প্রাচ্যের আরবে, বিচার পদ্ধতি ছিল অনেক যৌক্তিক কিন্তু রাজকুমারের স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা সীমাহীন; তার ফলে ধারনা উদ্ভাবনের মত নগরোন্নয় পিছিয়ে যায়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct