ইউক্রেন যুদ্ধে পুতিনের জয় হোক বা পরাজয় হোক, তাঁর প্রতি বিরুদ্ধবাদীদের মনোভাব বদলাবে বলে মনে হয় না। এই বিরুদ্ধবাদীদের একটি বিরাট অংশ দেশান্তরি হয়েছেন। কিন্তু তাঁরা তাঁদের দেশ নিয়ে সব সময়ই চিন্তিত একথা আন্দাজ করা যায়। তাঁরা তাঁদের মেধাকে দেশের কল্যাণে খাটাতে চান সেই মতও গ্রহণযোগ্য। রাশিয়া থেকে পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়া সুদক্ষ রুশ অভিবাসীরা পুনরায় রাশিয়ার নেতৃত্ব দিতে পারেন। ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে লিখেছেন ফৈয়াজ আহমেদ।
ইউক্রেনে রাশিয়ার ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’এর নানা দিক নিয়ে প্রতিনিয়ত অজস্র খবর বের হলেও একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ খবর উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। সেটি হল, রাশিয়া থেকে প্রচুরহারে রুশ নাগরিকদের অন্য দেশে চলে যাওয়া। তারা সংখ্যায় কত, তা এখনই সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে একটি সমীক্ষায় বলা হচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত দু লাখের বেশি মানুষ রাশিয়া ছেড়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। এদিকে জো বাইডেন যেহেতু রাশিয়াকে ‘মেধাশূন্য’ করার পদক্ষেপ নেবেন বলে ঘোষণা করেছেন এবং এর ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু অতি দক্ষ রুশ নাগরিকদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, সেহেতু ধরে নেওয়া যায় রুশদের এই গণদেশান্তরির সংখ্যা দিনে দিনে আরও বাড়বে। রাশিয়ায় যখন আর ভ্লাদিমির পুতিনের শাসন থাকবে না, তখন এই প্রবাসী রুশ নাগরিকেরাই এক নতুন রাশিয়া গড়ায় ভূমিকা রাখবেন। কিন্তু যে সমস্ত রাশিয়ানরা পুতিনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছেন, তাঁদের যে উষ্ণ আলিঙ্গনে স্বাগত জানানো হচ্ছে তা কিন্তু মোটেও নয়।
ইউক্রেনে পুতিনের ‘বিশেষ সামরিক অভিযানে’ রুশ নাগরিকদের কত শতাংশের স্বতঃস্ফূর্ত সায় আছে, তা অবশ্য মোটেও পরিষ্কার নয়। যা রাশিয়ানদের সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনগুলিই তার প্রমাণ। রাশিয়ার প্রোপাগান্ডা যন্ত্রের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে এ–সংক্রান্ত যেসব সমীক্ষার ফল দেখানো হচ্ছে, তার ওপর ততটা ভরসা করা যায় না। কিন্তু তারপরও নিরপেক্ষ সমীক্ষা করার জন্য সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকৃত রুশ সমীক্ষা প্রতিষ্ঠান লেভাদা সেন্টার যে ফল প্রকাশ করেছে, তা লক্ষ করার মতো। একটি গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক নেতাদের জনপ্রিয়তা সমীক্ষা করার জন্য সাধারণ মানুষকে তিন–চারজন নেতার নাম দেওয়া হয়। সবচেয়ে সমর্থনযোগ্য নেতার ক্রমানুসারে তালিকা করা হয়। সেইমতো তাঁরা সমীক্ষা করেছিলেন। সেখানে দেখা গেছে ৮৩ শতাংশ উত্তরদাতা পুতিনের নামের পাশে টিক চিহ্ন দিয়েছেন। তাঁদের জবাবের মধ্যেই এই সমীক্ষার অংশগ্রহণকারীদের মনস্তত্ত্ব ধরা পড়ে। আন্দাজ করা হয়, পুতিনের বিরুদ্ধে যায়, এমন যেকোনো মতামত দিতে সাধারণ রুশ নাগরিকেরা একেবারেই প্রস্তুত নন। ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক, তাঁরা পুতিনকে সমর্থন করে থাকেন। যদিও সমীক্ষায় দেখা যায় পুতিনকে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ রুশ নাগরিক সমর্থন করেন, তবে অনুমান করা যায়, আসল সংখ্যা অত নয়। তবে তাঁর সমর্থকদের সংখ্যা ৫০ শতাংশের আশপাশে হবে বলেই ধারণা করা যায়। এখন যদি সত্যিকার অর্থে ২০ শতাংশ লোকও পুতিনের বিরোধিতা করে থাকেন, তাহলেও তাঁদের সংখ্যা ২ কোটি ৮০ লাখ হবে। সুতরাং ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিনের বিরোধিতা করতে গিয়ে গোটা রুশ সমাজের বিরোধিতা করলে সেটি এই বিশাল জনগোষ্ঠীরই বিরোধিতা করা হবে। সেটি রাজনৈতিকভাবে সঠিক হবে না। ইউক্রেন যুদ্ধে পুতিনের জয় হোক বা পরাজয় হোক, তাঁর প্রতি বিরুদ্ধবাদীদের মনোভাব বদলাবে বলে মনে হয় না। এই বিরুদ্ধবাদীদের একটি বিরাট অংশ দেশান্তরি হয়েছেন। কিন্তু তাঁরা তাঁদের দেশ নিয়ে সব সময়ই চিন্তিত একথা আন্দাজ করা যায়। তাঁরা তাঁদের মেধাকে দেশের কল্যাণে খাটাতে চান সেই মতও গ্রহণযোগ্য।
রাশিয়া থেকে পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়া সুদক্ষ রুশ অভিবাসীরা পুনরায় রাশিয়ার নেতৃত্ব দিতে পারেন। অতীতে যাঁরা রাশিয়া বা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে পালিয়েছিলেন, তাঁরা তৎকালীন রুশ শাসনকে ঘৃণা করতেন; কিন্তু তঁারা বিশ্বাস করতেন, রাশিয়া সত্যিকার অর্থেই মহান হতে পারে এবং হওয়া উচিত। আলেকসান্দর সোলঝেনেৎসিন এবং জোসেফ ব্রদস্কির মতো ভিন্নমতাবলম্বীরাও এভাবে চিন্তা করেছিলেন। আজকে রাশিয়া থেকে যেসব মেধাবীরা স্রোতের মতো রাশিয়া থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন, তাঁরাই হয়তো পুতিন মুক্ত রাশিয়ায় এক নতুন সমাজ বিনির্মাণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারবেন। রাশিয়া থেকে যে মেধাবী জনশক্তি এখন বেরিয়ে যাচ্ছে, তা যাতে শেষ পর্যন্ত এক পরিবর্তিত রাশিয়ার কাজে লাগে, তা নিশ্চিত করার দায় এই দেশান্তরিতদের ঘাড়েই বর্তায়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct