ঘর ও পরিবার
অশোক কুমার হালদার
অনিমেষ বর্মন উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর জেলার এক পাড়া গাঁয়ে ঘর ও পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। পরিবারে সদস্য সংখ্যা রয়েছে ছয়জন। অনিমেষ বাবুর স্ত্রীর নাম সুলেখা বর্মন। সুলেখা দেবীর দুই পুত্র এবং দুই কন্যা। পুত্রের নাম চন্দন বর্মন এবং দ্বিতীয় পুত্রের নাম সুকেশ বর্মন। প্রথম কন্যার নাম শঙ্করী বর্মন। এবং দ্বিতীয় কন্যার নাম মাধবী বর্মন। পরিবারের যিনি প্রধান কর্তা ব্যক্তি থাকেন, তিনি তার সামর্থ অনুযায়ী এবং পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনুযায়ী ঘর তৈরি করেন পরিবারের বসবাসের জন্য। অনিমেষ বর্মনের পূর্ব পুরুষগণ এই দিনাজপুর জেলার এই পাড়াতেই বহুদিন ধরে বাস করেছেন। এখন বর্তমানে তারা কেউ বেঁচে নেই কিন্তু স্মৃতিটুকু রয়েছে মাত্র। এই সংসারে মানুষ, আসে এবং যে যার মতো কাজ সমাপ্ত করে মানুষ প্রস্থান করে শান্তির দেশে যেখানে পরম শান্তি থাকে, দুঃখের লেশ মাত্র থাকে না বা দুঃখ, বেদনা সেখানে পৌঁছাতে পারে না। এই সংসার জীবনটা ঠিক যেন নাট্য মঞ্চের মতো সাজানো রয়েছে। এই ঘর পরিবারে দেখা যায় কেউ স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেন, কেউ আবার স্বামীর ভূমিকায় অভিনয় করেন, কেউ আবার পুত্রের ভূমিকায় অভিনয় করে, কেউ বা কন্যার ভূমিকায় অভিনয় করে ঠিক যেন নাট্য মঞ্চের মতো ঘর ও পরিবার। নাটকের অভিনয়ের স্থানটিও একটা মঞ্চ। এই মঞ্চের সমস্ত অভিনেতা এবং অভিনেত্রীগণ যেন মনে হয় একই ঘর ও পরিবারের সদস্যবৃন্দ। ইহাতে কোন সন্দেহ নেই। নাট্য ঘরের সদস্য বা সদস্যা বৃন্দ যারাই অভিনয়ের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করেন। অভিনয়ের অবসানে বা অভিনয় শেষ করে যে যাহার ঘরে ফিরে যান। স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে কর্মের চরিত্র প্রায় একই রকম, ঘর ও পরিবারের সঙ্গে ঠিক যেন সমন্ধ রয়েছে। দুই ক্ষেত্রের কর্মই অস্থায়ী। মঞ্চ অভিনয়েও দেখা যায় কেউ পুত্রের অভিনয় করছেন আবার একজন কন্যার অভিনয় করেছেন, কেউ বা স্ত্রীর অভিনয় করছেন আবার কেউ বা স্বামীর অভিনয় করে চলেছেন। ঘরের সঙ্গে পরিবারের নিবিড় সর্ম্পক যুক্ত রয়েছে। সেটা আমরা কর্মক্ষেত্রে দেখতে পাই। অনিমেষ বাবু তার স্ত্রী সুলেখা দেবীকে এই কথাগুলি বলছেন। সুলেখা দেবী তখন তার স্বামী অনিমেষকে বলছেন পরিবার নিয়ে বসবাস করতে গেলে ঘরের অবশ্যই দরকার রয়েছে কারণ ছেলেমেয়েদের বিয়ের পরে আত্মীয় পরিজন সংসারে বেড়ে যায়। ছেলেমেয়েদের বিয়ের পরে ছেলেমেয়েদের শ্বশুর, শাশুরী এবং আত্মীয় পরিজনরা যখন পরিবারে আসেন, তখন তাদের পরিবারে আদর যত্নের সহিত যেমন সেবা ও যত্নের ব্যবস্থা করতে হয়, তেমনি আবার বিশ্রামের জন্য ঘরের ও দরকার হয় সমাজ সংসারে মান সম্মান নিয়ে বাঁচতে গেলে। আর হ্যাঁ বড়ছেলে ও বড়মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। আর আগে আমাদের আরো ঘর বানাতে হবে। কারণ নতূন আত্মীয় কুটুম যখন আসবে তখন তাদের যেমন খাবার দিতে হবে তেমনি আবার থাকার ব্যবস্থাও করতে হবে। তবেই সম্মান বাঁচবে পরিবারের।
তাহলে দেখা যাচ্ছে ঘর ও পরিবারের সঙ্গে যেমন সামাজিক রীতি, নীতি এবং মান ও সম্মান জড়িয়ে রয়েছে। পরিবারের সঙ্গে ঘরের কী সম্পর্ক রয়েছে বা পার্থক্য সূচক কী বৈশিষ্ট্য রয়েছে সময় এলে সেটা বোঝা যায়। সুলেখা দেবী আরও বলছেন যে ঘর কেন প্রয়োজন পরিবারে? তার কারণ ব্যবসায়ী বা কৃষক বন্ধু যারা সমাজে রয়েছেন বিশেষ করে তাদের ঘরের বিশেষ প্রয়োজনও রয়েছেন। যে সমস্ত মানুষজন মজুতদার রয়েছেন সমাজে তাদের কাজ হচ্ছে মাল কেনা এবং সেই মাল একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মজুত করে রাখতে হয়। তার জন্য ঘর প্রয়োজন। অর্থাৎ বাজার দর মজুতদারের পক্ষে এলেই সেই মজুত করা মাল ঘর থেকে বাজারে নিয়ে যায় বিক্রি করার জন্য। আর অন্য ক্ষেত্রে যারা চাষের কাজ করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করেন, তাদের ক্ষেত্রেও ঘরের প্রয়োজন রয়েছে। ঘরের মধ্যেই জমি চাষ করার হাল, লাঙ্গল ইত্যাদি প্রয়োজনীয় উপকরণ রাখতে হয় কৃষকদের। তারপর গরু বাছুর ও বলদ রাখার জন্যও ঐ ঘরেরই প্রয়োজন হয়। রোদ, তাপ বৃষ্টি এবং ঠান্ডা বা গরম যাই হোক প্রকৃতির কুপ্রভাব থেকে বাঁচতে গেলেও ঐ ঘরেরই প্রয়োজন হয়ে পড়ে। চোর ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার ক্ষেত্রেও ঐ ঘরের প্রয়োজন। অর্থাৎ সংসারী মানব জীবনে ঘর ছাড়া পরিবার বা সংসার জীবন চলতে পারে না। আবার ছোট পাখিরও বাসায় থাকে সেখানে নিয়মিত থাকিবার স্থান বা আরাম বিরামের স্থান থাকে। শুধু বন্য প্রাণী যারা ঘর বানাতে পারে না। তারাই কেবলমাত্র বন, জঙ্গল বা পাথারের গুহায় বাস করে জীবন অতিবাহিত করে চলেছে এই সংসারে। আর এক শ্রেণির মানুষ রয়েছেন সমাজে যাদের এই সংসারে সামাজিক এবং পারিবারিক বন্ধন দ্বারা আবদ্ধ হননি, এইরকম মানুষজনদের একদিকে যেমন পরিবার নেই, অন্যদিকে ঘরেরও প্রয়োজন হয় না। সামাজিকতা এবং সমাজের বন্ধন যেখানে থাকবে সেখানে ঘর অবশ্যই থাকবে এক সময়ে গ্রামের বাড়ি ঘর বেশিরভাগই ছিল মাটি দিয়ে তৈরি, উপরের ছাউনি সাধারণত ছিল টিন বা টালি, খুব কমই ছিল পাকাবাড়ি। মজুতদার বা জমিদার ছাড়া পাকা বাড়ির প্রচলন বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলে খুব কম দেখা গেছে। সময় এগিয়েছে, মানুষের সভ্যতার অগ্রগতি হয়েছে এবং আর্থিক স্বচ্ছলতা বেড়েছে, আর যার কারণে, আমরা ইদানিংকালে পাকা বাড়ির প্রচলন গ্রাম অঞ্চলেও দেখতে পাই। এই কথপোকথন চলাকালীন নকুলবাবু গ্রামের মধ্যে বয়স্ক এবং এক বিচক্ষণ ব্যক্তি বাড়ির বাইরে থেকেই ডেকে উঠল ভাই অনিমেষ বাড়ি আছো? অনিমেষ বাবু তখন বাড়ির ভেতর থেকেই বলে উঠলো যে হ্যাঁ দাদা বাড়িতেই রয়েছি? আপনি বাড়ির ভেতরে আসুন। নকুলবাবু রাস্তা থেকেই বললেন হ্যাঁ ঠিক আসছি। নকুলবাবু বাড়ির বৈঠকখানায় এসে বসলেন এবং অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বললেন, কেমন আছো ভাই, ঘর ও পরিবার কেমন চলছে? অনিমেষবাবু বললেন, দাদা এই চলছে, মোটামুটি ভাবে। এইবার আবার নকুলবাবু অনিমেষকে ভাই বৌমা এবং ছেলে মেয়ে ওরা সব কেমন আছে। সবাই কুশল আছে তো? এইবার অনিমেষবাবু নকুলবাবুকে বলছেন যে দাদা, আপনার বৌমা বলছে যে বড়ছেলে এবং বড়মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। এই কথা শুনে নকুলবাবু বলছেন যে ইহাতো খুব আনন্দের কথা ভাই, আর ছেলেমেয়ে বড় হলে বা বিয়ের উপযুক্ত হলে বাবা ও মায়ের ইহা চিন্তার অবশ্যই কারণ থাকে, বিশেষ করে মেয়ে বিবাহ উপযুক্ত হলে সব মা, বাবাদেরই অবশ্য কর্তব্য থাকে মেয়েকে সৎ পাত্রে পাত্রস্থ করা। ইহা সংসারী ক্ষেত্রে মা বাবার বিশেষ কর্তব্য। এইবার অনিমেষ বললেন হ্যাঁ দাদা আর এইজন্য অনেকদিন থেকেই ভাবছি দুই একটা ঘর বানাতে হবে জমিতো রয়েছেই। এই কথা শুনে নকুলবাবু বললেন ভাই একটা পাত্রের সন্ধান আমাকে ঐ পাড়ার হরিবাবু বলেছেন। হরিবাবুদের চাষবাসের ব্যবসা ঠিক তোমাদের মতোই। আর হরিবাবুদের অনেক জমিজমা রয়েছে চাষবাস করার জন্য। পরিবারটা বুনেদী পরিবার আদর্শ পরিবার তোমাদের মতোই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন কোন সাত পাঁচে ঐ পরিবারটি থাকে না। তাহলে দেখা যাচ্ছে বিবাহ বন্ধনের সঙ্গে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে ঘর ও পরিবারের। নকুলবাবু অনিমেষকে বলছেন যে আমার সারা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বুঝেছি যে সমাজিক জীবনে ঘর ও পরিবারের গুরুত্ব কতখানি। কারণ যারা পরিবারের পুরূষ সদস্য তাদের সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নানা রকম কর্মকান্ডে যুক্ত থাকতে হয়, কখনো পরিবারের খাদ্য সংস্থানের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কাজে লিপ্ত থাকতে হয় এবং কাজের শেষে যখন ক্লান্ত এবং পরিশ্রান্ত হয়ে ঘরে ফিরে পক্ষ সমর্থনের জন্য আরাম। বিশ্রামের জন্য ঠিক যেন সন্ধ্যায় বাসায় ফেরা পাখির মতো। এছাড়া ঘর ও পরিবার হচ্ছে একটা জীবনের স্থায়ী ঠিকানা। ইহা সমাজিক জীবনে শনাক্ত করনের ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে প্রয়োজন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct