এই উপমহাদেশের অন্যতম সেরা বাঙালি ইতিহাসবিদ, বাগ্মী, সুলেখক ও শিক্ষাসেবী গোলাম আহমদ মোর্তজা চির বিদায় নিয়েছেন বছর দুয়েক আগে। কিন্তু তাঁর সৃষ্ট গ্রন্থরাজি এখনও সন্ধিৎসু পাঠক বর্গের কাছে প্রয়োজনীয় হয়ে রয়েছে। তবে, লেখক সত্তার পাশাপাশি মানুষের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক ছিল। সেই স্মৃতিচারণা করেছেন সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেটা ছিল ২০২১ সালের ১৫ এপ্রিল অর্থাৎ ১৪২৮ বঙ্গাব্দের১ বৈশাখ। দুঃসংবাদটা ভোরেই পেয়েছিলাম যে, ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সেরা বাঙালি ইতিহাসবিদ, বাগ্মী, সুলেখক ও শিক্ষাসেবী গোলাম আহমদ মোর্তজা আর নেই। ভোরের আলো ঠিকমত ফোটার আগেই, পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে উনি চলে গিয়েছেন না ফেরার দেশে। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল, তবে সেটা শুধু তাঁর চলে যাবার কারনে নয়, তার পিছনে ছিল আমার নিজের এক গভীর আক্ষেপ, যা আমি আর পূরণ করার সুযোগ পাবো না। বয়সে পিতৃতুল্য এই মানুষটি একদিন আব্দার করলেন যে, একবার আমাকে তাঁর বাড়ি যেতে হবে, তিনি সেখানে বসে আমাকে অনেক কিছু বলবেন এবং আমাকেও কিছু প্রশ্ন করবেন। আমার কাছে মনে হল, এ যেন এক উলট্ পুরাণ, কারণ, সাধারণ মানুষ বিশিষ্ট মানুষদের তার নিজের বাড়িতে নিয়ে আসতে চায়,তাঁর কথা শুনতে চায়। কিন্তু গোলাম মোর্তজা সাহেব নিজে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হয়েও আমার মতো একজন অখ্যাত মানুষকে তাঁর ঘরে চাইছেন। আমি অবাক হয়ে গেলাম। একটা প্রশ্ন তিনি ফোনেই করলেন। সেটা ছিল, ‘এই বিদ্বেষ ছড়ানোর পরিস্থিতিতে তোমার লেখায় বুঝতে পারি যে, তুমি বিদ্বেষ ছড়ানোর ঘোর বিরোধী,অন্যের ধর্মের ওপর শ্রদ্ধাশীল এবং অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল। তোমার লেখায় থাকে সম্প্রীতির জোরালো আবেদন, কাউকে ঘৃণা করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ। এটা আমার খুব ভাল লাগে। এটি কিভাবে সম্ভব হয়েছে?’ ওনার বলা এই বিশেষণগুলোর আমি কতটা যোগ্য জানি না। কিন্তু ওনার কথায় আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তখন গুছিয়ে বলতে পারিনি তবে খুব শীঘ্র আসব বলে, কথা দিয়েছিলাম। আমার শ্বশুরবাড়ি ওনার বাসস্থান ও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর মেমারি থেকে অল্প কিছু দূরে “মণ্ডলগ্রাম”। সেদিন লকডাউনের মধ্যে পুলিশের ছাড়পত্র নিয়ে ভাড়া করা মোটরগাড়িতে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলাম। গোলাম মোর্তজা সাহেবকে বলেছিলাম,”কাকা, ফেরার সময় আপনার বাড়ি যাব।’ কিন্তু কোনও কারণে সেটা হয়ে ওঠেনি। পরদিন তাঁর বড় ছেলে কাজি ইয়াসিন ফোন করে এর কারণ জিজ্ঞেস করতে তাঁকে বলেছিলাম, এবার বিশেষ কারণে হল না, পরের বার অবশ্যই আসব।
এরপর লকডাউন এবং লকডাউন উঠে যাওয়া মিলে প্রায় ৮ মাস কেটে গেছে। তিনি তারপরেও আমাকে আসতে বলেছেন। কিন্তু আমার চরম গাফিলতি যাব, যাব করেও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আজ সেই আফশোসেই আমার মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। দাফন হয়ে যাওয়ার পরের দিন ২ বৈশাখ মোর্তজা সাহেবের বড় ছেলে কাজি ইয়াসিনের সঙ্গে ফোনে কথা হতে তিনি বললেন, ‘যেদিন আসব বলে, আপনি আসতে পারেননি সেই দিনটা ছিল ১৪ আগস্ট।’ সত্যিই সেটা ১৪ আগস্টই ছিল। ইয়াসিনের স্মৃতিশক্তি দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। উপলব্ধি করলাম যে, প্রয়াত গোলাম আহমদ মোর্তজা তাঁর নিজে হাতে প্রতিষ্ঠা করা ও তিলে তিলে বড় করে তোলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান “মামূন ন্যাশনাল স্কুল” পরিচালনার মূল দায়িত্ব পরিবারের যে মানুষটিকে দিয়ে গিয়েছেন, তিনি এটার প্রকৃত যোগ্য এবং গুণী পিতার উপযুক্ত সন্তান। ইয়াসিন ভাই আমাকে আসতে অনুরোধ করে বললেন, ‘বাবা যখন আপনাকে আসতে বলেছিলেন, তখন একবার অবশ্যই আসুন।’ এবার আর নড়চড় হয়নি।একদিন পরই ছুটে গিয়েছি গোলাম মোর্তজা সাহেবের সুদীর্ঘ কর্মজীবনের শেষ বিশ্রামস্থল মেমারিতে তাঁর গৃহে। বাড়ির সামনেই “মামূন ন্যাশনাল স্কুল”-এর মূল ভবন এবং একটি বড় মাঠ সমেত ১৮ বিঘা জমির ওপর বিশাল ক্যাম্পাস।এটি গড়ে উঠেছে জিলানি চালকল মালিক, গুজরাটি ব্যবসায়ী হাজি কাসেম সিদ্দিক সাহেবের দান করা ১০ কাঠা এবং বাকি সাড়ে ১৭ কাঠা কেনা ও অন্য ভাবে পাওয়া জমির ওপর। সিদ্দিক সাহেবকে সম্মান জানিয়ে স্কুল ক্যাম্পাসের ভিতরের মাঠের একপাশেই রয়েছে লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা এই মহৎ মানুষটির সমাধি। তাঁর পাশেই সমাধিস্থ করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণপুরুষ মরহুম গোলাম আহমাদ মোর্তাজা সাহেবকে। কবরের সামনে দাঁড়িয়ে একরাশ হাহাকারে বুক ভরে গেল যে, এই অখ্যাত মানুষটিকে “একবার বাড়িতে এসো” বলে আর তিনি ডাকতে পারবেন না।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct