বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীজিকে নতুন করে চর্চা করা অত্যন্ত জরুরি কাজ ! মহাত্মা গান্ধী ছিলেন আজীবন অহিংসার পূজারী এবং হিন্দু মুসলিম ঐক্যের কান্ডারী! ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগামী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে একজন এবং প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক নেতা। তাকে নিয়ে লিখেছেন মহ.মোসাররাফ হোসেন...
একশ্রেণির শাসক গোষ্ঠী দেশের বেকারদের কর্মসংস্থান ও অন্যান্য মূল সমস্যা থেকে নজর ঘোরাতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের উস্কানিমূলক মন্তব্য করে আসছেন!কখনো ‘পোশাক দেখে মানুষের জাত চেনা ‘যায়, তো কখনো আবার ‘বাংলা ভাগের নতুন জিগির’ তোলেন!সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করে তারা ভোট তরণী পার হতে চায়! একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেয়ে তারা উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াতে থাকেন!তারা চায় না রবীন্দ্র-নজরুল-বিবেকানন্দের বাংলায় ঐক্যবদ্ধতা বজায় থাক!তাই তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকমের উল্টোপাল্টা মন্তব্য করে থাকেন!
আশ্চর্য তখনই হতে হয় ,যখন মহাত্মা গান্ধীকে কেউ চিনতা না বলে বলে মন্তব্য করেন স্বয়ং দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর দাবি ১৯৮২ সালে ‘গান্ধী’ নামক সিনেমা তৈরির পরে গোটা বিশ্বের মানুষ নাকি মহাত্মাকে চিনতে শুরু করেন!মোদীর কথায়, ‘গান্ধী এক বিশাল ব্যক্তিত্ব ছিলেন।’ গত ৭৫ বছরে গোটা বিশ্বকে তাঁর বিষয়ে জানানোর দায়িত্ব কি ছিল না আমাদের ? তবে তাঁর বিষয়ে কেউ জানত না। যখন তাঁকে নিয়ে সিনেমা তৈরি হল, তখন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হল।
এই পরিস্থিতিতে জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীজিকে নতুন করে চর্চা করা অত্যন্ত জরুরী কাজ ! মহাত্মা গান্ধী ছিলেন আজীবন অহিংসার পূজারী এবং হিন্দু মুসলিম ঐক্যের কান্ডারী ! মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধী ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২রা অক্টোবর গুজরাটের পোরবন্দরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন অন্যতম ভারতীয় রাজনীতিবিদ, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগামী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে একজন এবং প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক নেতা। এছাড়াও তিনি ছিলেন সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। যার মাধ্যমে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জনসাধারণ তাদের অভিমত প্রকাশ করে। এ আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অহিংস মতবাদ বা দর্শনের উপর ভিত্তি করে এবং এটি ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম চালিকা শক্তি, সারা বিশ্বে মানুষের স্বাধীনতা এবং অধিকার পাওয়ার আন্দোলনের অন্যতম অনুপ্রেরণা। অহিংসা সম্পর্কে বিখ্যাত ইংরেজ লেখক রচিত ‘ শেষ পর্যন্ত ‘ -এর রচনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি সত্যাগ্রহ সম্পর্কে তাঁর ধ্যান-ধারণা গড়ে তোলেন।তাঁর সত্যাগ্রহের মূল ভিত্তি হল সত্য ও অহিংসা। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান ৷গান্ধীজি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফিরে আসেন ১৯১৫ সালের ৯ই জানুয়ারি, যা ভারতবর্ষে ২০০৩ সাল থেকে ‘ প্রবাসী ভারতীয় দিবস’ প্রতি বছর ৯ই জানুয়ারি পালিত হয়।তাঁর রাজনৈতিক গুরু গোপাল কৃষ্ণ গোখলে-র পরামর্শে তিনি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করে ভারতীয় সমাজ, জনজীবন ও রাজনীতি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।তিনি ১৯১৬ সালে গুজরাটের আমেদাবাদে সবরমতি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। গান্ধী ভারতে এবং বিশ্ব জুড়ে মহাত্মা এবং বাপু নামে পরিচিত। ভারত সরকার সম্মানার্থে তাকে ভারতের জাতির জনক হিসেবে ঘোষণা করেছ৷ ২রা অক্টোবর তার জন্মদিন ভারতে গান্ধী জয়ন্তী হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়। ২০০৭ সালের ১৫ই জুন জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ২রা অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। জাতিসংঘের সকল সদস্য দেশ এ দিবস পালনে সম্মতি জ্ঞাপন করে।
একজন আইনজীবী হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকায় নিপীড়িত ভারতীয় সম্প্রদায়ের নাগরিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধী প্রথম তাঁর অহিংস এবং শান্তিপূর্ণ নাগরিক আন্দোলনের মতাদর্শ প্রয়োগ করেন। ভারতে ফিরে আসার পরে তিনি কয়েকজন দুঃস্থ কৃষক-দিনমজুরকে সাথে নিয়ে বৈষম্যমূলক কর আদায় ব্যবস্থা, বহুবিস্তৃত বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং দেওবন্দিদের অধীনে খিলাফত আন্দোলন শুরু করেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে আসার পর গান্ধী সমগ্র ভারতব্যাপী দারিদ্র্য দূরীকরণ, নারী স্বাধীনতা, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, বর্ণবৈষম্য দূরীকরণ, জাতির অর্থনৈতিক সচ্ছলতা সহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রচার শুরু করেন। কিন্তু এর সবগুলোই ছিল স্বরাজ অর্থাৎ ভারতকে বিদেশি শাসন থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে। ১৯৩০ সালে গান্ধী ভারতীয়দের লবণ করের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ৪০০ কিলোমিটার (২৪৮ মাইল) দীর্ঘ ডান্ডি লবণ কুচকাওয়াজে নেতৃত্ব দেন, যা ১৯৪২ সালে ইংরেজ শাসকদের প্রতি সরাসরি ভারত ছাড় আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে বেশ কয়েকবার দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভারতে কারাবরণ করেন। মহাত্মা গান্ধী সমস্ত পরিস্থিতিতেই অহিংস মতবাদ এবং সত্যের ব্যাপারে অটল থেকেছেন। তিনি সাধারণ জীবনযাপন করতেন এবং একটি স্বায়ত্তশাসিত আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। তার নিজের পরিধেয় কাপড় ছিল ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় ধুতি এবং শাল, যা তিনি নিজেই চরকায় বুনতেন। তিনি সাধারণ নিরামিষ খাবার খেতেন। শেষ জীবনে ফলমূলই বেশি খেতেন। আত্মশুদ্ধি এবং প্রতিবাদের জন্য তিনি দীর্ঘ সময় উপবাস থাকতেন।
বিশ্বশান্তি ও অহিংসার এক উজ্জ্বল ও বিরলতম ব্যক্তিত্ব মহাত্মা গান্ধীর জন্মের ১৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে রাষ্ট্রসঙ্ঘের ডাক বিভাগের পক্ষ থেকে একটি স্মারক ডাকটিকিটেরও আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করেন।বিংশ শতাব্দীতে মানুষের স্বাধীনতার স্বার্থে মহাত্মা গান্ধীর অসামান্য অবদানের কথা উল্লেখ করেন। সকলের কল্যাণ, বঞ্চিতদের ক্ষমতায়নের পাশাপাশি পরিবেশের বিলুপ্তি প্রতিরোধের ওপর গুরুত্ব দিয়ে মহাত্মা গান্ধীর সকলের ইচ্ছার প্রতি আস্থা, অভিন্ন নিয়তি, নৈতিকতা, গণ-আন্দোলন এবং ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতার বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরেন। দ্বন্দ্ব, সন্ত্রাসবাদ, আর্থিক বৈষম্য, আর্থ-সামাজিক বঞ্চনা ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো ভয়াবহ বিপদগুলি সাধারণ মানুষ, রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। গান্ধীজির মূল্যবোধ নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রে বড় নৈতিকতার ভূমিকা পালন করতে পারে। গান্ধীজি আমাদের যুক্তিসম্মত বিচার ও নীতি রূপায়ণে এক অলৌকিক ক্ষমতা দিয়েছিলেন। গান্ধীজির এই মূল্যবোধকে কাজে লাগিয়ে দরিদ্রতর মানুষের জীবন, মর্যাদা ও ভাগ্যে পরিবর্তন আনা যেতে পারে। শিক্ষা, লিঙ্গ সমতা, স্বচ্ছতা, মহিলাদের ক্ষমতায়ন, ক্ষুধা হ্রাস এবং উন্নয়নের জন্য অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার আদর্শের ওপর ভিত্তি করেই গান্ধীজির জীবন ও কর্ম পরিচালিত হয়েছিল। আজ আমরা যে সুস্থায়ী উন্নয়নের উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছি, তা গান্ধীজি অনেক আগেই উপলব্ধি করেছিলেন। প্রকৃত অর্থে সুস্থায়ী উন্নয়নের উদ্দেশ্যগুলি অর্জনের মধ্যে গান্ধীজির দর্শনতত্ত্ব লুকিয়ে রয়েছে।গান্ধীজির পরম্পরা বহু প্রজন্ম ধরে অক্ষুণ্ণ থাকবে। তাঁরা বলেন, গান্ধীজি জাতি, ধর্ম ও রাষ্ট্রের ভেদাভেদ ভেঙে দিতে পেরেছিলেন ৷ তিনি ছিলেন এক বহুমুখী ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। তিনি একাধারে ছিলেন যতটা জাতীয়তাবাদী, ততটাই আন্তর্জাতিকতাবাদী। সমাজ সংস্কার ও পরিবর্তনে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা তাঁকে জাতীয়তাবাদের বেড়া ভেঙে আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। সারা বিশ্ব মহাত্মাকে কেবল তাঁর অহিংসা ও মানবতাবাদের জন্যই নয়, তাঁর করুণা ও সহমর্মিতার জন্যও মনে রেখেছে ৷প্রেম-প্রীতি,দয়া-মায়া,অহিংসা-সহনশীলতা,ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি,আত্মসংযম ইত্যাদি শুভ চিত্তবৃত্তি গুলি মানুষকে সভ্য করে তোলে ৷ যারা বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য , গণতন্ত্র এবং অহিংসাতে বিশ্বাসী তাদের কাছে মহাত্মা গান্ধী অবশ্যই শ্রেষ্ঠ মানব ৷মহাত্মা গান্ধী হিন্দুত্বের বশ্যতা অস্বীকার করে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের পথে হেঁটেছিলেন৷মানুষের ইতিহাসে যে মহামানবের মর্যাদা অলঙ্ঘনীয়,প্রতিবার নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার সময় যে অহিংসার পূজারী মহাত্মাকে স্মরণ করা হয়!গান্ধিজীকেই ‘জাতির জনক’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন স্বয়ং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং ‘মহাত্মা’ উপাধি দেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৷সাহিত্যিক ও দার্শনিক রোম্যাঁ রোলাঁ গান্ধীজী সম্পর্কে বলেছিলেন “তিনি আমাদের সময়ের যীশু৷”আর বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন---”আগামী প্রজন্ম কি বিশ্বাস করবে যে,তাঁর মতো কেউ একজন রক্তমাংসের মানুষ একসময় আমাদের এই পৃথিবীর বুকে সত্যি পদচারণা করেছেন ?” দেশে-বিদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ নিঃসন্দেহে অনুকরণীয়! ভারতবর্ষের বর্তমান আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ, জীবন ও শিক্ষাকে পুনরায় স্মরণ করতে হবে।
লেখক সহকারী শিক্ষক, আই.সি.আর হাই মাদ্রাসা (উ.মা.)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct