আপনজন ডেস্ক: দেশে এক সময় রুটি বিক্রি করেই দিনযাপন হত। সেই জীবন সংগ্রাম চালিয়ে তিনি এখন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট। বিশ্বের মধ্যে মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় নেতা রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের বেড়ে ওঠা কাহিনী নিয়ে এক বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। আপনজন-এর পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হল।
অত্যন্ত সাধারণ জীবন দিয়ে শুরু হলেও রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান বর্তমানে এমন এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন যিনি আধুনিক তুরস্কের জনক মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের শাসনামলের পর অন্য যে কোন নেতার চেয়ে দেশটিকে সবচেয়ে বেশি বদলে দিয়েছেন।
তবে সাম্প্রতিক কয়েক বছরে দেশটির অর্থনীতির অবনতি হয়েছে।মুদ্রাস্ফীতির হার প্রায় ১২% এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে তুর্কী মুদ্রা লিরার মূল্য রেকর্ড পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে তুরস্কের এই অর্থনৈতিক দুর্দশা আরো বেশি খারাপ হয়েছে। ইসলাম নিয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে বাকযুদ্ধে জড়িয়ে বর্তমানে তিনি আলোচিত এক রাজনীতিকে পরিণত হয়েছেন।
এরদোগান ২০০৩ সালের মার্চ মাসে যখন তুরস্কের নেতা নির্বাচিত হন, সেসময় এক ডলারে পাওয়া যেত ১ দশমিক ৬ লিরা। কিন্তু এখন এক ডলারের মূল্য আট লিরারও বেশি।তার শাসনামলের শুরুর দিকে দেশে বড় ধরনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছিল, হয়েছিল ব্যাপক উন্নয়নও।
সামরিক পেশি
সাম্প্রতিক কালে প্রেসিডেন্ট এরদোগান বহির্বিশ্বে তার শক্তি প্রদর্শনের জন্য খুব বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন যা অনেক দেশকে ক্ষুব্ধ করেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা জোট নেটোতে তুরস্কের মিত্র দেশগুলোও তুর্কী প্রেসিডেন্টের এই তৎপরতায় ক্ষুব্ধ।
লিবিয়া ও সিরিয়ার সংঘাতে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছে তুরস্কের সামরিক বাহিনী। ককেশাস অঞ্চলে নাগর্নো-কারাবাখকে কেন্দ্র করে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে যে যুদ্ধ চলছে তাতেও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছে তুরস্ক।
পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ অবজ্ঞা করে মি. এরদোগান উত্তর সাইপ্রাসে তুর্কী জাতীয়তাবাদী নেতাদের স্বঘোষিত সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তুরস্কই একমাত্র দেশ যারা এই স্বীকৃতি দিল।
সম্প্রতি ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রঁ ফ্রান্সে ইসলামপন্থীদের দমনে তৎপর হলে এবং ইসলাম ধর্মের সমালোচনা করলে প্রেসিডেন্ট এরদোগান ফরাসি প্রেসিডেন্টের মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার কথা বলেছেন। ফরাসী পণ্য বয়কটেরও ডাক দিয়েছেন তিনি। এতে ফ্রান্স ক্ষুব্ধ।
সমালোচকরা বলছেন, বহু আগে থেকেই প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বেশ কিছু ইসলামপন্থী এজেন্ডা রয়েছে। মিশরে নিষিদ্ধ-ঘোষিত রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে রয়েছে তার আদর্শগত মিল। মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা-কর্মীদের মতো তিনিও চার আঙ্গুল তুলে স্যালুট দেওয়ার জন্য পরিচিত। এভাবে শুভেচ্ছা জানানোকে বলা হয় ‘রাবা’।
এবছরের জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট এরদোগান ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক একটি ভবন হাইয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরিত করেন। এতে বহু খ্রিস্টান ও পশ্চিমা দেশ ক্ষুব্ধ হয়েছে।
দেড় হাজার বছর আগে এই ভবনটি নির্মিত হয়েছিল গির্জা হিসেবে। অটোমান টার্কের আমলে এটিকে মসজিদে পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু পরে কামাল আতাতুর্ক ভবনটিকে যাদুঘরে পরিণত করেন, যা ধর্মনিরপেক্ষ নতুন তুরস্কের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
অভ্যন্তরীণ রাজনীতি
প্রেসিডেন্ট এরদোগানের নেতৃত্বে ইসলামপন্থী দল জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি বা একেপি ২০১৯ সালে সারা দেশের স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে জয়লাভ করে। কিন্তু বড় তিনটি শহর- ইস্তাম্বুল, রাজধানী আঙ্কারা এবং ইজমিরে তার দল পরাজিত হয়।
ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচনে বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টির কাছে একেপির পরাজয় প্রেসিডেন্ট এরদোগানের জন্য ছিল একটি বড় ধরনের ধাক্কা। কেননা মি. এরদোগান ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এই চার বছর এই শহরের মেয়র ছিলেন। আর এই শহরেই তার দুর্গের পতন ঘটেছে।
মূলত তুরস্কের রক্ষণশীল গ্রামীণ এলাকা এবং আনাতোলিয়ার ছোট ছোট শহরগুলোই প্রেসিডেন্ট এরদোগানের দল একেপির ভোটের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত।
যেখান থেকে শুরু
এই ইস্তাম্বুল শহরেই মি. এরদোগানের উত্থানের শুরু। বর্তমানে এই শহরের জনসংখ্যা দেড় কোটিরও বেশি।
তার প্রেসিডেন্ট হয়ে ওঠার যাত্রার শুরুতে এই শহর ছাড়াও রাজধানী আঙ্কারায় স্থানীয় নির্বাচনে সাফল্য অর্জন করে তারই দল একেপি। এর পর দলটি ধীরে ধীরে তুরস্কের প্রধান রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে মি. এরদোগান ২০০৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান প্রথম দফায় প্রেসিডেন্ট হন ২০১৪ সালের অগাস্ট মাসে। তিনি তুরস্কের দ্বাদশ প্রেসিডেন্ট। ২০১৮ সালের জুন মাসে প্রথম রাউন্ড নির্বাচনে ব্যাপক ভোটে বিজয়ী হয়ে মি. এরদোগান দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এর আগের বছর ২০১৭ সালে সংবিধান সংশোধনের ওপর অনুষ্ঠিত বিতর্কিত এক গণভোটেও তিনি জয়ী হন। ফলে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেন তিনি।
তার বিরোধীদের ওপর এই দমন অভিযান শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বিরুদ্ধে পরিচালিত এক অভ্যুত্থান চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর। ২০১৬ সালের ওই ব্যর্থ অভ্যুত্থানে কমপক্ষে ২৪০ জন নিহত হয়। সেসময় প্রেসিডেন্ট এরদোগান মারমারিসের একটি অবকাশ কেন্দ্রে ছুটি কাটাচ্ছিলেন এবং বলা হয় যে তিনি অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন।
মি. এরদোগান জাতীয় পর্যায়ে ক্ষমতায় আসেন ২০০৩ সালে। সরাসরি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালের অগাস্ট মাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে ১১ বছর তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
ক্ষমতার উত্থান
রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের জন্ম ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। একজন উপকূল-রক্ষীর সন্তান তিনি। বেড়ে উঠেছেন তুরস্কের কৃষ্ণ সাগর সমুদ্র উপকূলে।
তার বয়স যখন ১৩, তার পিতা সন্তানদের আরো ভালো লেখাপড়া করানোর স্বপ্ন নিয়ে ইস্তাম্বুলে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। কিশোর এরদোগান বাড়তি কিছু অর্থ রোজগারের জন্য রাস্তায় লেবুর শরবত এবং রুটি বিক্রি করতেন।
ইসলামিক স্কুলে লেখাপড়া করেছেন তিনি। পরে ইস্তাম্বুলের মারমারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। একজন পেশাদার ফুটবলারও ছিলেন তিনি।
মুসলিম পুনর্জাগরণ
প্রেসিডেন্ট এরদোগান ইসলামি মূল্যবোধ আরোপের চেষ্টা করছেন- সমালোচকদের এই অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, ধর্মনিরেপক্ষতার বিষয়ে তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে তিনি বলেছেন, তুর্কীরা যাতে আরো খোলামেলাভাবে তাদের ধর্ম পালন করতে পারেন, সেই অধিকারকে তিনি সমর্থন করেন।
প্রেসিডেন্ট এরদোগানের অনেক সমর্থক তাকে “সুলতান” নামে ভূষিত করেছেন যা অটোমান সাম্রাজ্যের সময়ে ব্যবহার করা হতো।
তুরস্কের রাষ্ট্রীয় অফিসগুলোতে নারীদের হিজাব পরার ওপর কয়েক দশক ধরে যে নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল সেটা ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। তবে বিচার বিভাগ, সামরিক বাহিনী এবং পুলিশ নতুন এই আইনের বাইরে ছিল।
এছাড়াও মি. এরদোগান ব্যভিচারকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করার উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন, চালু করার চেষ্টা করেনে “অ্যালকোহলমুক্ত এলাকা”- সমালোচকরা বলছেন, এসবই এরদোগানের ইসলামপন্থী আকাঙ্ক্ষাকে প্রমাণ করে।
ব্যক্তিগত জীবন
একটি বিলাসবহুল প্রাসাদে থাকেন তুর্কী প্রেসিডেন্ট। সমালোচকরা বলেন, এটাও তার উচ্চাকাঙ্ক্ষী মনোভাবের প্রতীক। বিশাল আয়তনের এলাকায় প্রচুর অর্থ খরচ করে এই ভবন নির্মাণের কারণেও তিনি সমালোচিত হয়েছেন।
চার সন্তানের পিতা মি. এরদোগান বলেছেন, কোন মুসলিম পরিবারের জন্ম নিয়ন্ত্রণ করা উচিত নয়। ২০১৬ সালের মে মাসে তিনি একবার বলেছিলেন, “আমরা আমাদের বংশধরের সংখ্যা বহুগুণে বৃদ্ধি করব।”
মাতৃত্বের উচ্চ প্রশংসা করেন মি. এরদোগান। নারীবাদীদের সমালোচনা করেন। তবে তিনি বলেন, নারী ও পুরুষকে সমানভাবে দেখা উচিত নয়।
টাইম লাইন
১৯৪৫: রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগানের জন্ম।
১৯৭০-১৯৮০: ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোতে সক্রিয় ছিলেন, নেকমেতিন এরবাকান্স ওয়েলফেয়ার পার্টির সদস্য।
১৯৯৪-১৯৯৮: ইস্তাম্বুলের মেয়র ছিলেন, সামরিক কর্মকর্তাদের ক্ষমতা দখলের আগ পর্যন্ত, ওয়েলফেয়ার পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়।
১৯৯৯: জনসমক্ষে জাতীয়তাবাদী একটি কবিতা পড়ার জন্য তার চার মাসের জেল হয়েছিল। কবিতার কয়েকটি লাইন ছিল এরকম: “মসজিদগুলো আমাদের ব্যারাক, গম্বুজগুলো আমাদের হেলমেট, মিনারগুলো আমাদের বেয়নেট এবং বিশ্বাস হলো আমাদের সৈন্য।”
অগাস্ট ২০০১: আব্দুল্লাহ গুলকে সাথে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ইসলামপন্থী দল একেপি।
২০০২-২০০৩: পার্লামেন্ট নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে একেপি, এরদোগান প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
জুন ২০১৩: ইস্তাম্বুলে গেজি পার্কে ভবন নির্মাণের একটি প্রকল্পের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। প্রতিবাদকারীদের ওপর আক্রমণ করে নিরাপত্তা বাহিনী।
ডিসেম্বর ২০১৩: এরদোগান সরকারের বিরুদ্ধে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, তিনজন মন্ত্রীর সন্তানদের গ্রেফতার করা হয়, এরদোগান এজন্য গুলেনপন্থীদের দায়ী করেন।
অগাস্ট ২০১৪: তুরস্কে এই প্রথমবারের মতো সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মি. এরদোগান।
জুলাই ২০১৬: সামরিক বাহিনীর ভেতরে ব্যর্থ অভ্যুত্থান থেকে রক্ষা পান।
এপ্রিল ২০১৭: প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এক গণভোটে জয়ী হন।
(সংক্ষেপিত)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct